নারকেলি চেলা ও তিতপুঁটি; বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় প্রজাতির এই দুই জাতের মাছ নিয়ে সুখবর দিলেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) বিজ্ঞানীরা।
সে অনুযায়ী, আবারও বাঙালির খাবারের পাতে ফিরবে বিলুপ্তির পথে হাঁটা নারকেলি চেলা (Salmostoma bacaila) ও তিতপুঁটি (Pethia ticto)।
এই দুই জাতের মাছের কৃত্রিম প্রজনন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সফল হয়েছেন বিএফআরআই বিজ্ঞানীরা। এক বছরের গবেষণায় এ সাফল্য পেয়েছেন তারা। ফলে মাছ দুটির পোনাপ্রাপ্তি ও চাষ সহজতর হবে এবং বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবে বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা।
নারকেলি চেলা মাছের প্রজনন গবেষণায় ছিলেন প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. খোন্দকার রশীদুল হাসান, ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. ইশতিয়াক হায়দার, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তাশরিফ মাহমুদ মিনহাজ ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শ্রীবাস কুমার সাহা।
অন্যদিকে তিতপুঁটির গবেষণায় ছিলেন মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. অনুরাধা ভদ্র, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. শাহীন আলম ও ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সেলিনা ইয়াসমিন।
বিএফআরআই সূত্র জানায়, নারকেলি চেলা কোনো কোনো অঞ্চলে কাটারি নামেও পরিচিত। মাছটি বাস করে নদী, পুকুর, বিল, হ্রদ ও খালের তলদেশে। সুস্বাদু হওয়ায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাছটি বেশ জনপ্রিয়। এ মাছের প্রাচুর্যতাও প্রকৃতিতে ব্যাপকভাবে কমেছে।
প্রজাতিটিকে বিপন্নের হাত থেকে বাঁচাতে স্বাদুপানি উপকেন্দ্র সৈয়দপুরের বিজ্ঞানীরা ২০২১ সালে উত্তরাঞ্চলের তিস্তা ও চিকলী নদী থেকে ৫ থেকে ৭ গ্রাম ওজনের নারকেলি চেলা মাছ সংগ্রহ করে উপকেন্দ্রের পুকুরে গবেষণা শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি মাছটির কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদনে সফলতা পেয়েছেন তারা।
এ ছাড়া তিতপুঁটি মাছটি একসময় বাংলাদেশের নদীনালা, খালবিল, হাওর, বাঁওড় ও পুকুরে প্রচুর পাওয়া যেত। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) ২০১৫-এর তথ্য অনুযায়ী, মাছটি বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। মাছটিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষায় ২০২১ সালে ময়মনসিংহের স্বাদুপানি কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জের হাওর ও ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে পুঁটি সংগ্রহ করে কেন্দ্রের পুকুরে গবেষণাকাজ শুরু করেন। গত মে মাসে তিতপুঁটি মাছের কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদনে সফলতা পাওয়া যায়।
নারকেলি চেলা মাছের কৃত্রিম প্রজননের উদ্ভাবক ও প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. খোন্দকার রশীদুল হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মাছটিতে মানবদেহের জন্য উপকারী ভিটামিন এ ও জিঙ্ক রয়েছে। এ মাছের প্রাচুর্যও বর্তমানে প্রকৃতিতে ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ফলে এ প্রজাতিটিকে বিপন্নের হাত থেকে রক্ষা করতে আমাদের গবেষণা শুরু হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ মাছটি অন্য মাছের মতো বর্ষা ঋতুতে হালকা স্রোতযুক্ত জলাশয়ে প্রজনন করে থাকে। সবচেয়ে বেশি দেখা যায় নদী, খালবিল, হাওর, প্লাবিত ধান ও পাটক্ষেতে। স্বল্প জলজ উদ্ভিদপূর্ণ পরিষ্কার পানির উপরিভাগে এরা থাকতে ভালোবাসে। এরা জলজ পোকামাকড়, পোকামাকড়ের শূককীট ও প্ল্যাংকটন (জীবাণুবিশেষ) খেয়ে থাকে। পূর্ণাঙ্গ অবস্থায় দৈর্ঘ্যে প্রায় ১৪ সেন্টিমিটারের বেশি হলেও সচরাচর ৬ থেকে ৮ সেন্টিমিটার আকারের মাছগুলোকেই বেশি দেখা যায়।’
তিতপুঁটি মাছের কৃত্রিম প্রজননের উদ্ভাবক ও ও মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. অনুরাধা ভদ্র বলেন, ‘এ মাছ মানবদেহের প্রয়োজনীয় পুষ্টি, ভিটামিন, মিনারেল ও খনিজ লবণের চাহিদা পূরণ করে। অ্যাকুরিয়ামের বাহারি মাছ হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। এ ছাড়া সিদল ও শুঁটকি তৈরিতেও তিতপুঁটি ব্যবহৃত হয়।’
মাছটি একসময় নদীনালা, খালবিল, হাওর, বাঁওড় ও পুকুরে পাওয়া যেত জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তিতপুঁটি মাছের চচ্চড়ি দিয়ে অনেকের রসনা পূরণ হতো। একসময় বাংলাদেশসহ ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডে পাওয়া গেলেও বর্তমানে বিপন্নের তালিকায় রয়েছে।’
আরও বলেন, ‘এ মাছের কৃত্রিম প্রজনন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সফলতা পাওয়ায় পোনাপ্রাপ্তি ও চাষ সহজতর হবে এবং মাছটি বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবে। পাশাপাশি মাছের জীববৈচিত্র্য সুরক্ষিত হবে।’
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিপন্ন প্রজাতির দেশীয় মাছ সুরক্ষায় বর্তমান সরকার বদ্ধপরিকর। দেশে বিপন্ন ৬৪ প্রজাতির মাছের মধ্যে নারকেলি চেলা, তিতপুঁটিসহ মোট ৩৬ প্রজাতির মাছের কৃত্রিম প্রজনন সম্ভব হয়েছে। বাকি দেশীয় বিপন্ন মাছকে পর্যায়ক্রমে চাষের আওতায় আনতে গবেষণা চলছে।’