বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্ব নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সাজাপ্রাপ্ত হয়েও তিনি কীভাবে বিদেশি নাগরিকত্ব নিলেন, সেটি নিয়ে খোঁজ করতে গণমাধ্যমকর্মীদের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
বুধবার দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ডাকা সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে সরকারপ্রধান এ কথা বলেন।
শুরুতে শেখ হাসিনা একটি বক্তব্য রাখেন। এরপর গণমাধ্যমকর্মীরা নানা বিষয়ে প্রশ্ন রাখেন। একটি প্রশ্ন ছিল আগামী জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে কি না।
এর জবাবে আওয়ামী লীগ প্রধান গত জাতীয় নির্বাচনের উদাহরণ টানার পাশাপাশি তারেকের যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্ব নেয়ার বিষয়টি তুলে ধরেন।
ঢাকার তেজগাঁওয়ে নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: সংগৃহীত
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারা (বিএনপি) যে ইলেকশন করবে, তারা কাকে দেখাবে? সাজাপ্রাপ্ত ফিউজিটিভকে (পলাতক)? আর সে (তারেক রহমান) তো এ দেশের নাগরিকত্ব বাতিল করে এখন ব্রিটিশ নাগরিক হয়ে বসে আছে। কত টাকা ইনভেস্ট করলে সহজে ব্রিটিশ নাগরিক হওয়া যায়? একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামি হয়ে কীভাবে ব্রিটিশ নাগরিক হলো- সেটা একটু খোঁজ করবেন?
‘সেটা একটু খোঁজ করেন না। সেটা তো আপনারা করেন না। সেটা করলে তো বের হয়ে আসে। এই নিয়ে তারা কী ইলেকশনটা করবে? সেটাই তো বড় কথা। এখানে গণতন্ত্রের দোষটা কোথায়।’
২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গ্রেপ্তার হওয়ার পরের বছর প্যারোলে মুক্তি নিয়ে চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যে যান তারেক রহমান। তিনি সুস্থ হয়ে ফিরবেন, এমন কথা জানালেও প্রায় দেড় দশকেও ফেরেননি।
তারেক দেশের বাইরে থাকার সময় বিদেশে অর্থ পাচার, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, বঙ্গবন্ধুকে কটূক্তির মামলায় তার সাজা হয়েছে।
এর মধ্যে ২০০৪ সালে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা মামলায় সর্বোচ্চ সাজা হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। দেশের বাইরে থাকায় কোনো মামলাতেই তিনি আপিল করতে পারেননি।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির যে মামলায় বিচারিক আদালত বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়, একই আদালত তারেক রহমানকে দেয় ১০ বছরের সাজা। রায়ের পর খালেদা জিয়া কারাগারে গেলে বিএনপি তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করে।
কয়েক বছর আগে তারেক রহমানের যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করার বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় হয়। বিএনপি প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে বিষয়টি স্বীকার করে নেয়। তবে সেই আবেদনের বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারের সিদ্ধান্ত পরে আর গণমাধ্যমে আসেনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ওদের (বিএনপি) জন্য কান্নাকাটি করে লাভ নেই। ওরা ইলেকশনটা করবে কী নিয়ে? পুঁজিটা কী, সমস্যাটা তো ওইখানেই। বাংলাদেশে কি একটাও যোগ্য নেতা নেই যাকে তারা দলের চেয়ারম্যান করতে পারে। তাহলে তো তাদের এই দুরবস্থা হয় না।’
সাংবাদিকদের উদ্দেশে হাসতে হাসতে বলেন, ‘আপনারা দল করেন। পার্টিসেপিটরি করে দেব। একটা কথা মনে রাখবেন, জনগণের ভোট কেড়ে নিয়ে ক্ষমতায় থাকতে চাই না। সেটা থাকব না।’
তারা তো এক দিনে তিনবার নমিনেশন পাল্টায়
নির্দলীয় সরকারের অধীনে না হলেও বিএনপির আগামী জাতীয় নির্বাচন বর্জনের হুমকির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী উদাহরণ টানেন ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনের বিষয়টি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিএনপি একেকটা সিটে কয়জনকে নমিনেশন দিয়েছিল, সেটা কি আপনাদের মনে আছে? এক সিটে একজনকে সকালে দেয়, দুপুরে সেটা পরিবর্তন হয়ে আরেকজন হয়। তারপর তৃতীয় দফায় আরেকজনের নাম দেয়। যে যত বেশি টাকা দিচ্ছে তাকে নমিনেশন দিয়ে দিচ্ছে।
‘এই অবস্থায় যখন একটা দল তাদের নির্বাচনে প্রার্থী দেয়, ঢাকা থেকে তাদের এক নেতা একজনকে দিচ্ছে তো লন্ডন থেকে আরেকজনকে দিচ্ছে বা অমুকের কাছে টাকা চাচ্ছে, এই টাকা না দিলে সে নমিনেশন পাবে না। দিনে যদি আপনি তিনবার নমিনেশন বদলান, তারপর দেখা গেল মাঝখানে নির্বাচন ছেড়ে চলে গেল। এটা কি অস্বীকার করতে পারবে বিএনপি? তাহলে এটা পার্টিসিপেটরি ইলেকশন হয়নি এটা কীভাবে বলেন।
‘আর যখন আপনি নির্বাচনের মাঝপথে চলে যান, তখন তো মাঠ ফাঁকা। তখন পাবলিকে যা খুশি তাই করতে পারে। সেই দোষটা কাকে দেবেন? সেটা তো আওয়ামী লীগকে দিতে পারেন না। আর সেই বাস্তবতা সবাই ভুলে যায়।’
সেই নির্বাচনে বিএনপির জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী কে- এই বিষয়টি স্পষ্ট না থাকা নিয়েও কথা বলেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘একটা দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে তখনই, আর মানুষের আস্থা বিশ্বাস অর্জন করবে তখনই, যখন তাকে দেখাতে হবে সেই দল নির্বাচন করে জয়ী হলে কে হবে সরকারপ্রধান। এটা তো মানুষ আগে বিবেচনা করে, করে না? এটা শুধু আমাদের দেশে না, পৃথিবীর সব দেশেই।’
বিএনপির সাংগঠনিক ‘দুর্বলতা’ নিয়েও কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘দলেরও তথৈবচ অবস্থা। সাংগঠনিক তৎপরতা নেই।’
বামদের সেমিকোলন বলে কটাক্ষ
দেশে বামপন্থি দলগুলোর ভাঙনপ্রবণতা নিয়েও কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘তারা তো ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র হতে হতে মানে দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন…দাঁড়ি বসবে না কমা বসবে, কমা বসবে না সেমিকোলন এই করতে করতে ভাঙতে ভাঙতে তাদের এই অবস্থা।
‘তারা বাম হয়ে কখনও ডানে কাত হয়, কখনও বামে কাত হয়- তাদের তো এই অবস্থা। আছে কে সেটা বলেন না? একটা ভালো শক্তিশালী দল করে দেন। আমরা ঠিকাছে, মাঠেই দেখা হবে। মাঠে আমরা দেখব কম্পিটিশনে। ঠিকাছে জনগণ যাকে চায়।’
‘সুযোগ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হইনি কখনও’
কখনও কোনো সুযোগ নিয়ে ক্ষমতায় আসেননি বলেও জানান শেখ হাসিনা। বলেন, ‘একটা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ অনেক থাকে। ওই রকম সুযোগ নিয়ে তো আমি প্রধানমন্ত্রী হইনি কখনও। ৯১ সালেও হতে পারতাম। জাস্টিস সাহাবুদ্দিন আহমদ তখন কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান। তিনি যখন আমাকে ডেকে বলেছিলেন জামায়াত, জাতীয় পার্টি এবং আওয়ামী লীগ মেজরিটি। আপনি সরকার গঠন করেন। আমি মাফ চেয়ে চলে এসেছিলাম, জি না, আমি এভাবে ক্ষমতায় যাব না। সিট যখন পাইনি, যাব না।
‘ক্ষমতায় যাব তখনই, যখন আমার কাছে অ্যাবসলিউট পাওয়ার থাকবে। অর্থাৎ আমার ক্ষমতার ইচ্ছে আমার দেশের উন্নতি করা। সেটা কি আমি প্রমাণ করিনি, আপনারা বলেন? আপনারা বাংলাদেশের চেহরাটা চিন্তা করেন তো? বেশি না ১৩ বছর আগের চেহারাটা চিন্তা করেন।’
দেশের সম্পদ বেচেও ক্ষমতায় যাননি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যেনতেনভাবে ক্ষমতায় যাওয়া আমার লক্ষ্য না। আমার লক্ষ্য একটাই ছিল। কেয়ারটেকারের আমলে আমাকে যখন অ্যারেস্ট করা হয় তখনও আমাকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল, আপনি ইলেকশন করবেন না। আপনাকে প্রাইম মিনিস্টারের মর্যাদা দেয়া হবে। এই মর্যাদা তো আমি চাই না।
‘যে ব্রিগেডিয়ার আমার কাছে গিয়েছিল প্রস্তাব নিয়ে, তাকে বলেছিলাম আপনার আর্মি চিফকে বলে দিয়েন, ৫৪ সালে তার জন্ম। ৫৪ সালে আমার বাপ মন্ত্রী ছিল। আমরা মন্ত্রীর মেয়ে ছিলাম, আমরা মিন্টো রোডে থাকতাম। কাজেই ক্ষমতার লোভ আমাকে দেখিয়ে লাভ নেই। আমি ইলেকশন চাই। আমি ক্ষমতায় যেতে চাই আমার দেশের উন্নয়নের জন্য। সোজা কথা।’