সুনামগঞ্জ পৌর শহরের নূতনপাড়া এলাকায় নিজেদের চারতলা বাড়িতে থাকেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সঞ্চিতা দে এবং স্বামী কাজল দে। বাড়ির নিচতলা পুরোটাই ডুবে গেছে বন্যার পানিতে।
তাদের দুই মেয়ের মধ্যে শর্মি দে মৌলভীবাজারের একটি হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত। আরেক মেয়ে ঊর্মি দে সিলেটে থেকে পড়াশোনা করেন। তারা জানান, বাড়ির নিচতলায়ই থাকতেন তাদের বাবা-মা। তলিয়ে যাওয়ায় তারা এখন উঠেছেন ওপরের তলায়। এ বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন আশপাশের কয়েকটি বাসার মানুষও।
বিদ্যুৎহীনতা, ইন্টারনেট ও নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্নতায় গত ৪৮ ঘণ্টা মা-বাবার সঙ্গে যোগাযোগ নেই দুই মেয়ের। তবে তারা অন্তত জানেন মা-বাবা বাড়িতে অবস্থান করছেন। কিন্তু অনেকে জানেনই না কোথায় আছে তার পরিবার।
এমনই একজন তাবাসসুম তালুকদার। তিনিও থাকেন সিলেটে। পেশায় শিক্ষক বাবা জসীম উদ্দিনের খোঁজ পেতে শনিবার সকাল ১০টায় ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, ‘কেউ কি আজ সুনামগঞ্জ যাবেন? গেলে কাইন্ডলি আমার আব্বুর একটু খোঁজ নিতে পারবেন? দুই দিন ধরে খুব অসহায় অবস্থায় আছি। একটা খোঁজখবর পাচ্ছি না।’
‘গতকাল (বৃহস্পতিবার) আব্বু জানিয়েছিলেন আমাদের বাসা পুরো ডুবে গেছে। আব্বু আশ্রয় নিয়েছেন ষোলঘর মাদ্রাসার পাশে পানি উন্নয়ন বোর্ডে। কিন্তু গতকাল (শুক্রবার) থেকে আর কোনো খবর পাচ্ছি না।
তাবাসসুম আরও বলেন, ‘কেউ সুনামগঞ্জ গেলে আমার বাবার একটু খোঁজ নিয়ে জানাইয়েন, প্লিজ। আমার বাবার নাম জসীম উদ্দিন। উনি প্রাইমারি স্কুলের টিচার।’
সিলেট লিডিং ইউনিভার্সিটির লেকচারার প্রীতিরাজ ভট্টাচার্য্য। তিনিও তার বাবার খোঁজ চেয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেছেন।
১২ ঘণ্টা আগে অর্থাৎ শুক্রবার রাতে দেয়া পোস্টে তিনি লেখেন, ‘বাবার সঙ্গে লাস্ট কথা শুক্রবার রাত সাড়ে ৪টার দিকে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে এই বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হবে, এক রাতের ব্যবধানে কল্পনার অতীত ছিল। কার কাছে যাব, কী করব, কোথায় যাব কিছুই জানি না। সারা দিন ঘোরাঘুরি করলাম কিছু তথ্য পাওয়ার আশায়। বাসায় এখন এসে হতাশ। এখন এটুকু চাওয়া সবাই আমার বাসার সবার জন্য প্রার্থনা করবেন, আশীর্বাদ রাখবেন। ভগবান তাদের বিপদ থেকে রক্ষা করুন, এটাই চাওয়া।’
‘আমি কালকে রওনা হব এই সিদ্ধান্ত নিতে হিমশিম খাচ্ছি। আদৌ পৌঁছতে পারব কি না বা নিজেও নেটওয়ার্কের বাইরে গেলে কী পরিস্থিতি দাঁড়ায় ভগবান জানেন। এর পরও চেষ্টা করব।’
তিনি আরও লেখেন, ‘কোনো হৃদয়বান ব্যক্তি যদি সুনামগঞ্জ সদরের হোসেন বখত চত্বরে (বক পয়েন্ট) ধীরেন্দ্র ডাক্তারের বাসার ভেতরের বাসার যদি একটা খবরও জেনে থাকেন, কারও মাধ্যমে আমাকে একটু জানাবেন। অ্যাটলিস্ট বাসাটা খালি আছে জানলেও ভরসা পেতাম যে, তারা একটা জায়গায় শিফট হয়েছেন। রাতটা খুব ভয়ংকর। হাজার বছরের রাত।’
তাবাসসুম ও প্রীতিরাজের এই ফেসবুক পোস্ট এবং আরও বিষয়ে জানতে পরে তাদের সঙ্গে ফেসবুকে মেসেঞ্জারে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে তারা সাড়া দেননি।সুনামগঞ্জ এই মুহূর্তে বিচ্ছিন্ন। বন্যায় সারা জেলায় বিদ্যুৎ নেই, ইন্টারনেট নেই। দুই-একটি এলাকা ছাড়া বাকি জায়গায় মোবাইল নেটওয়ার্কও নেই। সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়েছে। দেখা দিয়েছে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট।
এমন পরিস্থিতিতে জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিসকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় জলমগ্ন এলাকাগুলোতে নৌকা সংকট দেখা দিয়েছে। নৌকার অভাবে ঘর ছেড়ে মানুষজন আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারছেন না বলে খবর পাওয়া গেছে।
এদিকে ভয়াবহ পরিস্থিতিতে দুর্গতদের উদ্ধারকাজে নামছেন নৌবাহিনীর সদস্যরা। তাদের সঙ্গে থাকছে বিমানবাহিনীর দুটি হেলিকপ্টার ও কোস্টগার্ডের দুটি ডুবুরি দল। শুক্রবার থেকে বন্যাকবলিতদের সহায়তায় কাজ করছে সেনাবাহিনী।