খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ছোটন দেবনাথের বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করেছে বিশ্ববিদ্যালয়। তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছিলেন এক সহকর্মী।
বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক খান গোলাম কুদ্দুস মঙ্গলবার বিকেলে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, অভিযোগের তিনটি ধারার মধ্যে তারা দুটির তদন্ত করেছে। এ দুটির সত্যতা না পাওয়ায় ছোটনকে তার পদে বহাল করা হয়েছে। আরেকটি ধারার অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাবহির্ভূত হওয়ায় এর তদন্ত হয়নি।
প্রায় ১০ মাস আগে ছোটনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনা ওই নারী শিক্ষকের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার মূল অভিযোগেরই তদন্ত করেনি।
ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার বলেন, ‘অভিযুক্ত শিক্ষক ছোটন দেবনাথের বিরুদ্ধে ৩.১ (গ) ও ৩.১ (ঘ) ধারায় আনা অভিযোগ তদন্তে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। এ কারণে তাকে অভিযোগের দায় থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তবে আইনের ৩.১ (ট) ধারায় আনা অভিযোগ বিচারের আওতাবহির্ভূত হওয়ায় অভিযোগ বিবেচনা করা হয়নি।
‘তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন সাপেক্ষে সিন্ডিকেটের সভায় ওই শিক্ষককে অভিযোগ থেকে দায়মুক্ত করা হয়। একই সঙ্গে তার বরখাস্তাদেশও প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। এখন ওই নারী শিক্ষক চাইলে আদালতে গিয়ে আইনের আশ্রয় নিতে পারবেন।’
‘উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ নীতিমালা, ২০০৮’- এর ৩ নম্বর ধারায় যৌন হয়রানির সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে।
৩.১ (গ)- এ যৌন হয়রানি হিসেবে বলা হয়েছে, চিঠিপত্র, টেলিফোন, মোবাইল ফোন, ই-মেইল, এসএমএস, পোস্টার, দেয়াল লিখন, বেঞ্চ/চেয়ার/টেবিল/নোটিশ বোর্ড লিখন, নোটিশ, কার্টুন ইত্যাদির মাধ্যমে হেয় করা, উত্ত্যক্ত করার চেষ্টা বা উত্ত্যক্ত করা।
৩.১ (ঘ)- এ বলা হয়েছে, যৌন উসকানিমূলক, বিদ্বেষমূলক বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে কুৎসা রটনা করা এবং/অথবা সেই উদ্দেশ্যে ছায়াছবি/স্থিরচিত্র, ডিজিটাল ইমেজ, কার্টুন, প্রচারপত্র, উড়োচিঠি, মন্তব্য বা পোস্টার ইত্যাদি প্রদর্শন বা প্রচার এবং স্থির বা ভিডিওচিত্র ধারণ, প্রেরণ, প্রদর্শন ও প্রচার।
৩.১ (ট)-তে যৌন হয়রানি বলতে বোঝানো হয়েছে, যৌন কামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে শরীরের যে কোনো অংশে যে কোনোভাবে স্পর্শ করা বা আঘাত করা।
রেজিস্টারের কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, ২০২১ সালের ২৬ আগস্ট ওই নারী শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন প্রতিরোধ কেন্দ্রে অভিযোগ দেন। এতে বলা হয় ২০২১ সালে ২৬ জানুয়ারি ওই নারী শিক্ষক ছোটন দেবনাথের বাসায় গিয়ে যৌন নির্যাতনের শিকার হন। পরে ছোটন দেবনাথ বিভিন্ন সময়ে তাকে হুমকি ও ভয়ভীতি দেখাতে থাকেন।
‘উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ নীতিমালা, ২০০৮’ অনুযায়ী খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ কেন্দ্র অভিযোগটি আমলে নিয়ে তদন্ত শুরু করে।
৬০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়ে অভিযোগ প্রমাণ হওয়া সাপেক্ষে শাস্তির সুপারিশের কথা থাকলেও ১০ মাস পর তদন্তের প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়। এই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের ২১৯তম সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
সহকর্মীর বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ওই নারী শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘এতদিন লড়ছিলাম আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া জঘন্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে। বিচার চাইতে গিয়ে এবার নতুন করে আরেক প্রহসনের শিকার হলাম। আমার মূল অভিযোগ ছিল ৩.১ (ট) ধারায়, অর্থাৎ যৌন হয়রানির। সেই বিষয়টি তারা আমলেই নিল না। আর আমাকে জানালো ১০ মাস পর।
‘যে ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটির তদন্তের এখতিয়ারভুক্ত নয় বলা হচ্ছে, তাহলে ওই বিষয়ে সব ধরনের তদন্ত কেন করা হলো? ঘটনাস্থলে যাওয়া, সাক্ষীদের এ বিষয়ে প্রশ্ন করা, অভিযুক্ত ও অভিযোগকারীকে মুখোমুখি করে কল রেকর্ড শোনা হলো কেন?’
তিনি আরও বলেন, ‘যেসব তথ্য, প্রমাণ, নথিপত্র অভিযোগকারীর পক্ষে যায় সেগুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে, যেসব তথ্য অভিযুক্তের পক্ষে যায় সেগুলোই গোঁজামিল দিয়ে সামনে এনে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন প্রতিরোধ কেন্দ্রের সভাপতি অধ্যাপক তাসলিমা খাতুন বলেন, ‘কোনো ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে সংঘটিত হলে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী তা বিশ্ববিদ্যালয়ের এখতিয়ারবহির্ভূত। ওই শিক্ষকের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিবাদীর প্রমাণাদি এবং সার্বিক বিষয় বিশ্লেষণ করে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। এসব কারণে অভিযোগ তদন্ত ও বিশ্লেষণের জন্য ১০ মাস সময় লেগে গেছে।’
ওই শিক্ষকের মূল অভিযোগ যে বিচারের আওতাবহির্ভূত তা জানাতে কেন ১০ মাস সময় লাগল সে প্রশ্নে অধ্যাপক তাসলিমা জানান, বিভিন্নজনের সাক্ষাৎকার ও তথ্য জোগাড় করতে দেরি হয়েছে।
বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহারের পর ছোটন দেবনাথ বলেন, ‘আমি প্রথম থেকেই বলে আসছি, আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ষড়যন্ত্রমূলক এবং সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট, ভিত্তিহীন। তদন্তেও অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
‘মূলত আমাকে সামাজিকভাবে হেয় ও হেনস্থা করার হীন উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে এই অভিযোগ করা হয়েছিল। অভিযোগটি আমলে নেয়ার কারণে ও তদন্ত কমিটি বিচার কাজ দীর্ঘায়িতের ফলে আমি মানসিক, সামাজিক, পেশাগত ও আর্থিকভাবে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।’