খুলনার দাকোপ ও বটিয়াঘাটা উপজেলায় বছরে প্রায় ১১ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ করা হয়। যার বাজারমূল্য প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার বেশি। তবে মধ্যস্বত্বভোগীদের জন্য কৃষকরা তরমুজের ন্যায্য দাম পান না।
কৃষকরা তাদের নায্য দাবি ও অধিকার আদায়ের জন্য মঙ্গলবার দুপুরে খুলনার এই দুই উপজেলাকে তরমুজ চাষের জন্য কৃষি অর্থনৈতিক জোন ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন।
ওই অঞ্চলের কৃষকদের দাবি নিয়ে কাজ করে ‘লোকজ মৈত্রী কৃষক ফেডারেশন’ নামের একটি সংগঠন।
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক বিভাষ মণ্ডল বলেন, ‘এ বছর খুলনার দাকোপ ও বটিয়াঘাটা উপজেলায় প্রায় ১১ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজের চাষ হয়েছিল। কৃষকের পাশাপাশি করোনাকালীন অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ এ বছর নতুন করে তরমুজ চাষে যুক্ত হন। এলাকার ৮০ শতাংশ চাষির ভালো ফলন হওয়ার পরও উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি ও বিক্রীত মালের দাম না পাওয়ায় তারা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।’
‘বৈরী আবহাওয়ার কারণে দেরিতে বীজ রোপণ, বীজের দাম বেশি, অনেক ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত মূল্যের থেকেও বেশি দামে সার কেনা, ছত্রাকনাশক-কীটনাশক ও হরমোন জাতীয় ওষুধের লাগামহীন মূল্য, মাটির গুণাগুণ সম্পর্কে ধারণা না থাকা, সেচের পানির অপ্রতুলতা, পরিবহন ও বিপণন ব্যবস্থা মধ্যস্বত্বভোগীদের অবৈধ নিয়ন্ত্রণে থাকায় কৃষকরা এই ক্ষতিতে পড়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘এ বছর আমরা তরমুজ চাষ থেকে শুরু করে বাজারজাত পর্যন্ত পদে পদে বাধার সম্মুখীন হয়েছি। জমির মালিক জমির হারি কয়েক গুণ বৃদ্ধি করেছেন। গত বছর যে জমির হারি ১ থেকে ৩ হাজার টাকার ভেতরে ছিল, তা এবার বৃদ্ধি পেয়ে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকায় উন্নীত হয়েছে। বিশেষত শিক্ষক, ব্যাংকার, এনজিওকর্মী, ব্যবসায়ী, গাড়িচালকসহ অন্যান্য শ্রেণির মানুষের এই চাষে অনুপ্রবেশ ঘটায় সমস্যা আরও বেড়েছে।’
বিভাষ মণ্ডল বলেন, ‘গত বছর ৩৩ শতকের জমি চাষ করতে খরচ হয়েছিল ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা। ডিজেলের মূল্য প্রতি লিটার ১৫ টাকা বৃদ্ধির কারণে এ বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা। সার, বীজ, কীটনাশকের দাম গায়ে উল্লেখিত খুচরা মূল্যের চেয়ে বেশি নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে সার, বীজ, কীটনাশকের দাম বাড়িয়ে কৃষককে ফাঁদে ফেলে বেশি মূল্য আদায় করা হয়েছে।
‘দালাল চক্রের জন্য পাইকারি ক্রেতারা সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে পণ্য কিনতে পারেনি। পাইকার যে ক্ষেতের দাম ৫ লাখ বলেছে, দালাল পাইকারকে বলেছে কি দেখে ৫ লাখ বললেন; এর আগে ২ লাখও কেউ বলেনি। আমি আপনাকে কম টাকায় কিনে দেব, আমাকে একটু খুশি করবেন।’
‘এ ছাড়া পরিবহন সিন্ডিকেট বেশি ভাড়ায় গাড়ি সরবরাহ করেছে। পক্ষান্তরে অন্য কাউকে কম টাকায় গাড়ি সরবরাহ করতে দেয়নি। যে গাড়ি ভাড়া ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা ছিল তা বাড়িয়ে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা আদায় করা হয়েছে।’
বিভাষ মণ্ডল বলেন, ‘অনেক কৃষক লেখাপড়া না জানায় স্থানীয় কীটনাশক বিক্রেতারা ভিন্ন ভিন্ন কোম্পানির একই গ্রুপের কীটনাশক বিক্রি করে কৃষকদের ঠকিয়েছে। তরমুজ বহন শ্রমিকরাও সুযোগ বুঝে পিস প্রতি ১/১.৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩/৫ টাকা করেছে।
‘তরমুজের আড়তদারের কোনো লোকসান নেই। কেনাবেচা উভয় দিকের কমিশন। তারপর ব্যাপারীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে ৮ হাজার টাকার পণ্য ৪ হাজার টাকায় বিক্রিতে বাধ্য করে কৃষককে ঠকানো হয়েছে। বিনিময়ে ব্যাপারীর কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নেয়া ছাড়াও আড়তঘরের নিযুক্ত কমিশন এজেন্ট রয়েছে। এদের কাজ কৃষককে বুঝিয়ে তরমুজের গাড়ি নির্দিষ্ট আড়তে নেয়া ও শতকরা ২ থেকে ৪ ভাগ কমিশন খাওয়া।’
লোকজ মৈত্রী কৃষক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘ব্যাপারীরা সিন্ডিকেট তৈরি করে ইচ্ছেমতো পণ্যের দাম কমিয়েছেন। কৃষক কোনো উপায় না পেয়ে কম মূল্যে পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন।’
সংগঠনের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ মণ্ডল বলেন, ‘কৃষকদের এসব সিন্ডিকেট থেকে মুক্ত করতে হলে খুলনার দাকোপ ও বটিয়াঘাটা উপজেলাকে তরমুজ চাষের জন্য কৃষি অর্থনৈতিক জোন ঘোষণা করতে হবে। তাহলে সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান এখানে কাজ করবে। পক্ষান্তরে কৃষকরাও লাভবান হবেন। ফলে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থার বেশ উন্নয়ন হবে।’