বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

এখনও কবিরাজ আর ঝাড়ফুঁকে ভরসা

  •    
  • ১৩ জুন, ২০২২ ০৮:২৭

উত্তরের প্রান্তিক জনপদ কুড়িগ্রামে এখনও ঝাড়ফুঁকই চালু চিকিৎসা পদ্ধতিতে। জিন-পরি নামানো থেকে শুরু করে পক্ষাঘাত, শরীরে ভাঙা-মচকা এবং চর্ম রোগেরও চিকিৎসা করে থাকেন কবিরাজ।

চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই অগ্রগতির যুগেও কুড়িগ্রামে কবিরাজ ও ফকিরের ঝাড়ফুঁকের দ্বারস্থ হন অনেক মানুষ। হাতুড়ে ডাক্তার, কবিরাজ ও ফকিরের ঝাড়ফুঁকের ওপর তাদের আস্থায় ভাটা পড়ছে না। তবে কুসংস্কার থেকে গ্রামের সহজ-সরল লোকজনকে বের করে আনতে কাজ করছে স্বাস্থ্য বিভাগ।

কুড়িগ্রামে ধরলা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও দুধকুমারসহ ১৬টি নদ-নদীর ৩১৬ কিলোমিটার নৌপথের মধ্যে প্রায় ৫ শতাধিক চরাঞ্চল আছে। এসব চরে প্রায় ৭ থেকে ৮ লাখ মানুষের বসবাস।

জেলার ৯টি উপজেলার ৭৩টি ইউনিয়ন এবং তিনটি পৌরসভার মধ্যে প্রায় ৬৫টি ইউনিয়ন। প্রায় প্রতিটি পৌরসভার সঙ্গে নদ-নদীর সংযোগ আছে। মূল ভূখণ্ড থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন আটটি ইউনিয়ন।

সরেজমিনে কয়েকটি গ্রামে দেখা যায়, বাদ্যযন্ত্রের তালেতালে শ্লোক বলে নাচছে একদল লোক। এ দৃশ্য দেখে অনেকে ভুল করে মনে করতে পারে এগুলো গ্রাম্য যাত্রাপালা কিংবা জারি গানের কোনো আসর।

বাস্তবে এগুলো হচ্ছে গ্রামের প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি ‘বাঁশলি ঝাড়া’। প্যারালাইজড বা পক্ষাঘাতগ্রস্ততা গ্রামে ‘বাঁশলি রোগ’ নামে পরিচিত এখানে। এ রোগে আক্রান্ত এক নারী রোগীকে নেচে-গেয়ে এভাবে চিকিৎসা দিচ্ছেন কবিরাজ।

জেলার রাজারহাট উপজেলার ছিনাই ইউনিয়নের পূর্ব দেবত্তর মোগলটারী গ্রামের বাসিন্দা চৌকিদার আব্দুল হাকিমের স্ত্রী রহিমা বেগম প্রায় দুই মাস ধরে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে শয্যাশায়ী। অভাবের সংসারে স্ত্রীর চিকিৎসা করাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত স্বামী হাকিম। এখন পরিবারটির শেষ ভরসা এই কবিরাজি চিকিৎসা।

কবিরাজ গানের সুরে বলছেন, ‘নবী বলে দোস্ত তোমার উম্মতরই কষ্ট/ নবী বিনে কে শাফায়েত করিবে রে/ আরে আল্লা-আল্লা বলিয়া নামানু ঝাড়িয়া/ আরে মস্তক হতে বিষ ওঠে জবানে নামিলো/ আরে জবান না নামিলো, জবান বোবা হইল/ আরে দীনের নবী নামে দাইয়া নামাও জোরে, আরে হযরত আলীর নামে দাইয়া নামাও জোরে।’

বিভিন্ন শ্লোক গেয়ে বৃদ্ধ-শিশুরা দল বেঁধে খাটে শোয়ানো রোগীর চারপাশে ঘুরছে।

উত্তরের প্রান্তিক জনপদ কুড়িগ্রামে এখনও ঝাড়-ফুঁকই চালু চিকিৎসায় পদ্ধতি। জিন-পরি নামানো থেকে শুরু করে পক্ষাঘাত, শরীরে ভাঙা-মচকা এবং চর্ম রোগেরও চিকিৎসা করে থাকেন কবিরাজ।

কুড়িগ্রামে চরাঞ্চল এলাকা। বন্যার সময় নৌকায় আর শুস্ক মৌসুমে শীর্ণ নদীর বালুচর ধরে হেঁটে যেতে হয়। ফলে অসুস্থ শরীরে কারও পক্ষে সরকারি চিকিৎসা সেবা নেয়া সম্ভব হয় না।

হাতুড়ে ডাক্তার-কবিরাজের চিকিৎসা কিংবা ফকিরের ঝাড়-ফুঁকের ওপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য হয় গ্রামবাসী। মূল ভূ-খণ্ডের জেলা-উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। সে কারণে হাসপাতাল বা আধুনিক ডাক্তারের সেবা থেকে বঞ্চিত এসব প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ। এ ছাড়া অর্থনৈতিকভাবেও অসচ্ছলতার কারণে ভালো চিকিৎসাসেবা ভাগ্যে জোটে না তাদের।

অসুস্থ রহিমা বেগম বলেন, ‘রোজার মধ্যে স্টোক করিয়া বিছানাত পড়ি। উঠপার পাই না। প্রসাব-পায়খানা সবকিছুই বিছানাতে। এখন কবিরাজি চিকিৎসা নিচ্ছি।’

রহিমার স্বামী আব্দুল হাকিম বলেন, ‘মোর বউয়ের পিছনোত ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা শ্যাষ করি ফেলাইছি। কোনো উপকার হয় নাই। কুড়িগ্রাম-রংপুর গেছি, কোনো কাজ হয় নাই। পরে কবিরাজ দিয়া বাঁশলি ঝাড়া শুরু করি। সাত দিনে মোটামুটি বউ মোর চলাফেরা করবার পায়। কবিরাজের সঙ্গে মোর চুক্তি হইছে, অসুখ ভালো করি দিবে ৩০ হাজার টাকা নিবে।’

রাজারহাটের বোতলা বাজারের কবিরাজ আবুল হোসেন বলেন, ‘প্রায় ২৫ বছর যাবৎ বাঁশলি ঝাড়া-ফুঁকা করি। অনেক রোগী ভালো হয়। আবার অনেকেই হয় না। পল্লী আর হাসপাতালের (এমবিবিএস) ডাক্তার বেশি হওয়ায় আগের মতো রোগ পাই না। গরিব রোগী যারা টাকা-পয়সা খরচ করতে পারে না, তারাই আসে কবিরাজি চিকিৎসা নিতে।’

কবিরাজের সহযোগী আব্দুল আউয়াল বলেন, ‘আমি ওস্তাদের সঙ্গে প্রায় ১৬-১৭ বছর ধরে কাজ করছি। এখন জঙ্গল নাই। গাছ নাই, তাই ওষুধও তেমন পাওয়া যায় না। এলোপ্যাথি দিয়ে চিকিৎসা করা লাগে। একজন রোগীর সাত দিন থেকে এক মাসও লাগে। এতে ১০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা খরচ করতে হয় রোগীকে।’

অপর সহযোগী আবু হানিফ বলেন, ‘বাঁশলি ঝেড়ে এক জোড়া কবুতর, নারকেল, জাম্বুরা, কলাসহ সাজানো একটি কলার ভেলায় করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়।’

শ্লোক বলা নৃত্যে অংশ নেয়া পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী মোনালিসা বলেন, ‘আমরা পাঁচ জন মেয়ে গানের দলে অংশ নিয়ে রোগীর চারপাশে দুই বেলা নাচি। এ জন্য আমাদের কষ্ট হলেও রোগীর ভালো হওয়ায় খুশি হই।’

সদর উপজেলার পাঁচগাছী ইউনিয়নের উত্তর নওয়াবশ গ্রামের দিনমজুর ফুলমুদ্দি বলেন, ‘আমার স্ত্রী লিলি বেগম কোমর ব্যথায় অসুস্থ হয়ে পড়ে। টাকা-পয়সার অভাবে ডাক্তার দেখাতে পারি নাই। তাই কবিরাজকে দেখাই দেড় হাজার টাকায়। ঝাঁড়-ফুক করে মোটামুটি রোগী এখন ভালো আছে।’

একই ইউনিয়নের ছড়ারপাড় গ্রামের বাসিন্দা ময়না বেগম বলেন, ‘আমার মা রাবেয়া বেগমের এক হাত-পা এবং মুখ অবশ হয়ে গেছে। প্রথমে কবিরাজ দিয়ে চিকিৎসা করাইছি। কোনো উপকার হয় না। এলা টাকা-পয়সা জোগাড় করে হাসপাতালের ডাক্তার দেখামো।

এলাকার বাসিন্দা আব্দুল জলিল বলেন, ‘হামার চর কিংবা গ্রাম কন, সেটা এলাও কবিরাজ, ফকির বিশ্বাস করে। কারো জিন-পরি ধরলে ফকির আনে। ফকির বাটি চালান দেয় আর পানি ফুঁক দেয়। এতে অনেকেই ভালো হয়। আর যারা ভালো হয় না, তারা বড় ডাক্তারের কাছত যায়। খরচ কম হওয়ায় রোগীর প্রথম চিকিৎসা নিতে কবিরাজ বা ফকিরের ওপর নির্ভর করেন গ্রামাঞ্চলের মানুষ।’

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে সিভিল সার্জন ডা. মনজুর এ-মুর্শেদ বলেন, ‘চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বাঁশলি বা ঝাড়ফুঁকের কোনো ভিত্তি নেই। উল্টো ক্ষতির শঙ্কা থাকে বেশি। তবে মানুষকে এসব কুসংস্কার এবং প্রাচীন এসব চিকিৎসাসেবা না নেবার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ।’

এ বিভাগের আরো খবর