সিলেট নগরের হাওলাদারপাড়ায় একটি টিলার নাম জাগো টিলা। উঁচু এই টিলার ঢালে সারিবদ্ধ কয়েকটি ঘর। ওপরের ঘরগুলোর ঠিক নিচে টিলার পাদদেশেও ঘর রয়েছে কয়েকটি।
সোমবার বিকেলে এলাকাটিতে গিয়ে দেখা যায়, কয়েক দিনের বৃষ্টিতে জাগো টিলার মাটি ধসে পড়ছে। শঙ্কা এখন বড় ধসের। ফলে টিলার ওপর ও ঢালে বসবাস করা সব পরিবারই এখন ঝুঁকিতে। প্রাণের শঙ্কা নিয়েই বছরের পর বছর ধরে এখানে তারা বাস করছে।
যদিও এভাবে বসবাসকারীদের সবাই নিজেকে সান্ত্বনা দেন এই ভেবে যে হাজারও টিলার মাঝে তাদের টিলাটিই ধসে যাবে- এমন অলৌকিক ঘটনা হয় তো ঘটবে না।
সোমবার ভোরে সিলেটের জৈন্তাপুরে একটি টিলা ধসে পড়ে ঢালে থাকা ঘরের ওপর। এতে মারা যান ওই পরিবারের ৪ সদস্য। আহত হন আরও পাঁচজন। ধসের আগে তারাও হয়তো ভাবতেন, দুর্ঘটনাটি তাদের ক্ষেত্রে ঘটবে না।
জৈন্তাপুরে টিলা ধসে সোমবার মৃত্যু হয় একই পরিবারের চার সদস্যের
প্রতি বছরই বর্ষায় সিলেটে টিলা ধসে এভাবে প্রাণহানি ঘটে। আহত আর ক্ষয়ক্ষতি হয় আরও বেশি।
তবু টিলার পাদদেশে বসবাসকারীদের পুনর্বাসনে এখনও কোনো উদ্যোগ নেই। শুধু তা-ই নয়, এভাবে ঝুঁকি নিয়ে যারা বসবাস করছেন তাদের কোনো তালিকাও নেই প্রশাসনের কাছে। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে ধসের ঝুঁকিতে মানুষের নিরাপদে সরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে মাইকিং করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ জেলা প্রশাসনের উদ্যোগ। পুনর্বাসনের উদ্যোগ না থাকায় বাড়ছে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি।
যদিও ২০১২ সালে সিলেটের পাহাড় টিলা সংরক্ষণে এসবের ওপর ও পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করা দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে পুনর্বাসনের নির্দেশনা দেয় উচ্চ আদালত।
জৈন্তাপুরের দুর্ঘটনার আগের দিন রোববার ভোরেও ফেঞ্চুগঞ্জের ঘিলাছড়া এলাকার একটি টিলা ধসে ঢালে থাকা চারটি ঘরের ওপর গিয়ে পড়ে। এতে কোনো প্রাণহানি না ঘটলেও ওই চারটি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এর আগে গত ১৪ মে গোলাপগঞ্জ উপজেলার লক্ষণাবন্দে টিলা ধসে মারা যান অপু লাল রায় নামে এক এনজিও কর্মী। লক্ষণাবন্দের চক্রবর্তী পাড়ার একটি টিলার পাদদেশেই ছিল অপুদের ঘর।
এভাবে অতীতের বিভিন্ন দুর্ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রতিবছরই টিলা ধসে প্রাণহানি ঘটে সিলেটে।
নগরের হালদারপাড়ায় জাগোটিলার ওপর ঘর বানিয়ে বাস করা শামসুল ইসলাম বলেন, ‘এটি সরকারি টিলা। ভাড়া দিতে হয় না। তাই আমরা এখানে থাকি।’
ঝুঁকি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ভয় তো আছেই। বৃষ্টি হলে ভয় আরও বেড়ে যায়। কিন্তু আমরা গরিব মানুষ। জায়গা কেনার সামর্থ্য নাই। ঘর ভাড়া করাও অনেক খরচের। তাই ঝুঁকি নিয়েই এখানে থাকি।’
শামসুল ইসলাম জানান, স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা ওই টিলায় তাদের ঘর বানিয়ে থাকার সুযোগ করে দিয়েছেন।
খোঁজ নিয়েও দেখা গেছে, এভাবে ঝুঁকি নিয়ে বসবাসকারীদের বেশির ভাগই দরিদ্র। স্থানীয় প্রভাবশালীরা টিলার মাটি কাটা ও দখলের জন্য দরিদ্র এসব মানুষকে ঘর বানিয়ে থাকার সুযোগ করে দেন।
এ ছাড়া কম দামে পেয়ে টিলার পাদদেশে জমি কিনেও ঘর বানিয়েছেন অনেকে। সোমবার জৈন্তাপুরে নিহত পরিবারটিও টিলার পাদদেশে জমি কিনে ঘর তুলেছিল।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) তথ্য মতে, সিলেট নগর, সদর, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, ফেঞ্চুগঞ্জ, জৈন্তাপুর ও গোয়াইনঘাট উপজেলায় প্রায় ৪০০ পাহাড়-টিলা রয়েছে। এসবের ঝুঁকিতে কত সংখ্যক মানুষ বসবাস করছেন সরকারি হিসেবে তা না থাকলেও পরিবেশবাদী সংগঠন ‘সেভ দ্য হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’ এ নিয়ে একটি জরিপ চালিয়েছিল।
সংস্থাটির প্রধান সমন্বয়ক আবদুল হাই বলেন, ‘আমরা বছর চারেক আগে জরিপ চালিয়ে দেখেছিলাম, জেলায় টিলার পাদদেশে প্রায় ১০ হাজার মানুষ ঝুঁকিপূর্ণভাবে বাস করছেন। এখন এই সংখ্যাটি আরও বেশি।’
তিনি জানান, বসবাসের বাড়ি নির্মাণ করতে অনেকেই টিলার ঢাল কিংবা গোড়ার দিকে মাটি কেটে ফেলেন। এতে টিলাগুলোর ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ছে। ফলে বর্ষা মৌসুমে এগুলো ধসে পড়ে প্রাণহানি ঘটছে।
অপরিকল্পিতভাবে টিলার মাটি কাটা, বৃক্ষ উজাড় ও টিলার পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাসের কারণে বৃষ্টি হলেই টিলা ধসে পড়ছে বলে মনে করছেন পরিবেশকর্মীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেট নগরের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন টিলার পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে কয়েক শ পরিবার বাস করছে। এ ছাড়া বিভিন্ন উপজেলায় টিলা ও পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বাস করছে সহস্রাধিক পরিবার।
ঝুঁকিতে থাকা মানুষের সংখ্যা নিয়ে তথ্য নেই জানিয়ে জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল বশিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নে টিলার পাদদেশে অনেক লোক বাস করেন। আমরা বর্ষা শুরুর আগেই তাদের নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার জন্য মাইকিং করি। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের দিয়ে প্রচারণা চালাই। তবু তারা সরেন না।’
ইউএনও আরও বলেন, ‘জৈন্তাপুরে আগে এমন দুর্ঘটনা ঘটেনি। তাই ঝুঁকিপূর্ণদের কোনো তালিকা করা হয়নি। তাদের নিরাপদ জায়গায় সরানো বা অপসারণেরও কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এখন এ ব্যাপারে ভাবতে হবে।’
একই ধরনের তথ্য জানিয়ে জৈন্তাপুরের চিকনাগুল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘টিলার পাদদেশে যারা আছেন, তাদের সরে যাওয়ার জন্য আমরা প্রতি বছরই প্রচারণা চালাই। কিন্তু তারা যেতে চায় না।’
এই জনপ্রতিনিধি আরও বলেন, ‘টিলার নিচে কম টাকায় জমি কিনে অনেকে ঘর বানায়। কেউ কম ভাড়ায়, আবার কেউ বিনা ভাড়ায়ও থাকে। ফলে তারা অন্যত্র যেতে চায় না। টাকা বাঁচানোর জন্য তারা জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে। প্রত্যেকেই ভাবে তার কিছু হবে না। অথচ আজকেও চারজন মারা গেল।’
প্রাণহানির জন্য প্রশাসনের গাফিলতিকে দায়ী করেছেন বাংলাদেশ পরিবশে আইনবিদ সমিতি (বেলা) সিলেটের সমন্বয়ক শাহ শাহেদা আক্তার।
তিনি বলেন, ‘২০১২ সালে আমাদের একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত সিলেটে পাহাড়টিলা কাটায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। একই সঙ্গে পাহাড়টিলা সংরক্ষণ ও এর পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ দরিদ্র মানুষজনকে পুনর্বাসনের নির্দেশনা দেন। কিন্তু রায়ের ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত ওই নির্দেশনা বাস্তবায়ন হয়নি।’
শাহেদা বলেন, ‘টিলা সংরক্ষণে সরকারি কোনো উদ্যোগ নেই। বরং টিলা ধ্বংস করার অনেক প্রকল্প আছে।’
সোমবার জৈন্তাপুরের দুর্ঘটনার পর হতাহতদের দেখতে ঘটনাস্থলে যান সিলেটের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ইমরুল হাসান। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘টিলার ওপর ও পাদদেশে যারা বসবাস করেন তাদের অনেকেই নিজের জমিতে ঘর বানিয়ে থাকেন। চেষ্টা করেও তাদের অন্যত্র সরানো যায় না। এ বছরও আমরা সব ইউএনওর মাধ্যমে মাইকিং করিয়ে টিলার পাদদেশে বসবাসকারীদের নিরাপদে সরে যেতে বলেছি। কিন্তু কেউ কথা শুনেনি।’
তালিকার বিষয়ে ইমরুল হাসান বলেন, ‘এমন কোনো তালিকা আমাদের নেই। তবে তাদের মধ্যে কেউ ভূমিহীন হলে প্রশাসন বা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে তাদের সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করা হবে।’
ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের সরানো যায় না বলে দাবি করেছেন সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমানও। তিনি বলেন, ‘এটা একটা বড় সমস্যা। আজকেও দুর্ঘটনা ঘটল। তাদের কিভাবে সরানো যায় ও পুনর্বাসন করা যায় তা নিয়ে ভাবছি।’