স্বৈরাচার আইয়ুব খান সরকারের শাসন-শোষণের প্রতিবাদে ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলগুলোর সম্মেলন শুরু হয়। চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর বাসভবনে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন কাউন্সিল মুসলিম লীগের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আফজাল।
সাবজেক্ট কমিটির এই সভায় বাঙালির অধিকার আদায়ে ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেদিন ওই প্রস্তাব গৃহীত না হলেও পরবর্তী সময়ে এই ৬ দফা হয়ে ওঠে এক দফা, স্বাধিকার আন্দোলন রূপ নেয় স্বাধীনতার সংগ্রামে। বাঙালির মুক্তির সনদ হয়ে ওঠে ৬ দফা। আর এর প্রবক্তা শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন বাঙালির একক নেতা।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন আজন্ম গণতন্ত্রপ্রেমী। ১৯৬২ সালের ২৪ জুন ৯ জন বাঙালি নেতা পাকিস্তানে সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে বিবৃতি দেন। তাদের একজন ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। চার বছরের ব্যবধানে ৬ দফা দেয়ার পর তিনি আর ৯ জন নেতার একজন রইলেন না; হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারার এক নম্বর মুখপাত্র। আর সেটিই হয়ে ওঠে তার নেতৃত্বে রাজনীতির মূল ধারা। বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন অবিসংবাদিত জননেতা।
বার্তা সংস্থা বিবিসির এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ৬ দফা ঘোষণার পর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) পূর্ব পাকিস্তান প্রধান অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ শেখ মুজিবুর রহমানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনি এই যে ৬ দফা দিলেন তার মূল কথাটি কী?’ আঞ্চলিক ভাষায় এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন শেখ মুজিব- ‘আরে মিয়া বুঝলা না, দফা তো একটাই। একটু ঘুরাইয়া কইলাম।’
লাহোরে বিরোধী দলগুলোর ওই সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু উত্থাপিত ৬ দফা দাবি প্রত্যাখ্যাত হয়। ৬ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকটি পত্রিকায় এ দাবির উল্লেখ করে লেখা হয়- পাকিস্তানের দুটি অংশ বিচ্ছিন্ন করার জন্যই ৬ দফা দাবি আনা হয়েছে। ১০ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু সংবাদ সম্মেলন করে এর জবাব দেন। ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। বিমানবন্দরেই সাংবাদিকদের সামনে ৬ দফা সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরেন তিনি।
বঙ্গবন্ধুর ৬ দফায় পাকিস্তানের প্রত্যেক প্রদেশকে স্বায়ত্তশাসন দেয়ার প্রস্তাব ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের অন্যান্য রাজনৈতিক দল এ দাবি গ্রহণ তো দূরের কথা, আলোচনা করতেও রাজি হয়নি।
বঙ্গবন্ধু ঢাকায় ফেরার পর আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটিতে ৬ দফা দাবি পাস করা হয়। আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে এ দাবি গ্রহণ করা হয়। ব্যাপকভাবে এ দাবি প্রচারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর ওপর বঙ্গবন্ধুর লেখা একটি পুস্তিকা দলের সাধারণ সম্পাদকের নামে প্রকাশিত করা হয়। ছয় দফার ওপর প্রথম যে প্রচারপত্রটি প্রকাশিত হয় তার শিরোনামও ‘আমাদের বাঁচার দাবি: ৬-দফা কর্মসূচি’ (শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রোজনামচা, ২০১৭, পৃ: ৩০৮-৩২০)।
৬ দফার পক্ষ-বিপক্ষে সারা দেশে বক্তৃতা-বিবৃতি শুরু হয়। খান এ সবুর, মোনায়েম খাঁ ও প্রাদেশিক কিছু মন্ত্রী সংসদে ৬ দফার বিরোধিতা করে বক্তব্য দেন। এমনকি ৬ দফা ইস্যুতে আওয়ামী লীগও দুই ভাগ হয়ে যায়। যদিও ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সভায় আনুষ্ঠানিকভাবে ৬ দফাকে অনুমোদন দেয়া হয়।
১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ৬ দফা আওয়ামী লীগের দলীয় ইশতেহারে পরিণত হয়। এরপর ৬ দফার সমর্থনে দেশের সর্বত্র জনসভা-সমাবেশ হতে থাকে। ২৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে ৬ দফার সমর্থনে প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। লিফলেট, প্যাম্ফলেট, পোস্টার ইত্যাদির মাধ্যমেও এ দাবিনামা জনগণের কাছে তুলে ধরা হয়। বাংলার মানুষ লুফে নেয় এসব দাবি।
তৎকালীন সরকার ৬ দফার ভয়ে পর পর ৮ বার বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে। ১৯৬৬ সালের ৮ মে নারায়ণগঞ্জে জনসভা শেষে ঢাকায় ফিরে আসার পর ধানমণ্ডির বাড়ি থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয়। পরদিন ৯ মে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। একই সঙ্গে একের পর এক মামলা দিতে থাকে সরকার।
আওয়ামী লীগ ১৯৬৬ সালের ১৩ মে প্রতিবাদ দিবস পালন উপলক্ষে জনসভা করে। ৭ জুন প্রদেশব্যাপী হরতাল ডাকা হয় এবং হরতাল সফলে সর্বাত্মক উদ্যোগ নেয়া হয়।
বাংলাদেশের মানুষ ৭ জুন সফলভাবে হরতাল পালন করে ৬ দফার প্রতি তাদের সমর্থন জানিয়ে দেয়। শাসন-শোষণের উপযুক্ত জবাব পায় পাকিস্তান সরকার। বিনা উসকানিতে জনতার ওপর পুলিশ গুলি চালায়। শ্রমিক নেতা মনু মিয়াসহ ১১ জন নিহত হন।
স্বৈরাচার সরকার আওয়ামী লীগ ও ন্যাপে ভাঙন ধরানোর চক্রান্তে নামে। ৬ দফা আন্দোলন দুর্বল করতে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপকে বাদ দিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম)। ৮ দলীয় এই জোটে ছিল নূরুল আমীন ও আতাউর রহমান খানদের জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, খাজা খয়ের উদ্দিনদের কাউন্সিল মুসলিম লীগ, গোলাম আযমের জামায়াতে ইসলামী, নসরুল্লাহ খান ও সালাম খানের পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এবং মৌলবী ফরিদ আহমদের নেজামে ইসলাম পার্টি। ৬ দফার পাল্টা তারা ৮ দফা সামনে নিয়ে আসে।
ক্ষমতাসীনদের চক্রান্তের সেই দুর্দিনে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আমেনা বেগম পিডিএমের ৮ দফা প্রত্যাখ্যান করে ২৯ মে এক বিবৃতি দিয়ে ৬ দফার সমর্থনে ৭ জুন হরতাল পালনের আহ্বান জানান।
ওই দিনের হরতাল সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু কারাগারে বসে লেখেন, ‘১২টার পর খবর পাকাপাকি পাওয়া গেল যে, হরতাল হয়েছে। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেছে। তারা ৬ দফা সমর্থন করে মুক্তি চায়। বাঁচতে চায়, খেতে চায়, ব্যক্তিস্বাধীনতা চায়, শ্রমিকের ন্যায্য দাবি ও কৃষকের বাঁচার দাবি চায়, এর প্রমাণ এই হরতালের মধ্যেই হয়ে গেল।’ (কারাগারের রোজনামচা, পৃ: ৬৯)।
অবশ্য আরেক জায়গায় তিনি লেখেন, “মওলানা ভাসানী সাহেবও ছয় দফার বিরুদ্ধে বলেছেন, কারণ দুই পাকিস্তান নাকি আলাদা হয়ে যাবে। (শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রোজনামচা, ২০১৭, পৃ: ৫৭)।
রংপুরের মশিয়ুর রহমান যাদু মিয়া তখন মওলানা ভাসানীর ডেপুটি। ৬ দফার ওপর মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘৬ দফা কর্মসূচি কার্যকর হইলে, পরিশেষে উহা সমস্ত দেশে এক বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব জাগাইয়া তুলিবে।’ (শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রোজনামচা, ২০১৭, পৃ: ৫৭)। তিনি আরও যোগ করেন, তিনি যদি প্রেসিডেন্ট হতেন তাহলে ৬ দফা বাস্তবায়িত হতে দিতেন না। যাদু মিয়ার এ বিবৃতি ফলাও করে প্রকাশিত হয় ১৯৬৬ সালের ২ জুনের ‘মর্নিং নিউজ পত্রিকায়।
৬ দফা সৃষ্টির পেছনে মূল কারণ ছিল মূলত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক বৈষম্য। জন্মের পর থেকে পাকিস্তান যেসব বৈদেশিক সাহায্য পেয়েছে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও তার বেশির ভাগ ব্যয় হয় পশ্চিম পাকিস্তানে।
পূর্ব পাকিস্তানের ‘সোনালি আঁশ’ পাট বিদেশে রপ্তানি করে যে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হতো সেটাও চলে যেত পশ্চিম পাকিস্তানে। বৈদেশিক বাণিজ্যের ৬০ শতাংশ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের। কিন্তু প্রায় পুরো অর্থ ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানে।
পাকিস্তান সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের ১৯৭০ সালের রিপোর্টে দেখা যায়- উন্নয়ন ও রাজস্ব খাতে পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানে ৬০ শতাংশ বেশি ব্যয় করা হয়েছে। ফলে পশ্চিমের মাথাপিছু আয়ও বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘১৭ দিনের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় ৬ দফার আশু পটভূমি তৈরি হয়েছিল। এই যুদ্ধের সময় লক্ষ্য করা গিয়েছিল, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সামরিক দিক থেকে সম্পূর্ণ অরক্ষিত। সে কারণে এই অঞ্চলের রাজনীতিবিদ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়।’
এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর একটি বক্তব্য ‘যুদ্ধের পর পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি নতুন গুরুত্ব পেয়েছে। আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে’ উল্লেখ করেন সৈয়দ আনোয়ার হোসেন।
রাজনৈতিক ইতিহাসবিদ মহিউদ্দিন আহমদ তার ‘আওয়ামী লীগ: উত্থানপর্ব ১৯৪৮-১৯৭০’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ছয় দফা হঠাৎ করে আসমান থেকে পড়েনি। দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি ও ধারাবাহিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এর তাত্ত্বিক ভিত্তি তৈরি হচ্ছিল। একই সঙ্গে তৈরি হয়েছিল রাজনীতিবিদদের সঙ্গে অর্থনীতিবিদদের যুগলবন্দি, স্বাধিকারের দাবিতে যারা এক মোহনায় মিলেছিলেন।’
২০২০ সালের ৭ জুন এক কুইজ প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে ৬ দফা নিয়ে স্মৃতিচারণা করেন বঙ্গবন্ধুর বড় কন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একটি সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী তিনি বলেন, ‘ঐতিহাসিক ৬ দফার দাবিগুলো ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিজস্ব চিন্তার ফসল এবং ঐতিহাসিক এ বিষয় গঠনে অন্য কেউ জড়িত ছিলেন না, যা দেশকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল স্বাধীনতার দিকে।
‘আমি জানি যে এটি অবশ্যই তার (বঙ্গবন্ধু) নিজস্ব চিন্তা-ভাবনার ফসল ছিল।’
৬ দফা দাবি পালন উপলক্ষে আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন, ‘১৯৫৮ সালে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং ১৯৫৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর তিনি মুক্তি পান। তখন রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। বঙ্গবন্ধু ঢাকার বাইরে যেতে পারেননি। এ সময় তিনি আলফা বীমা সংস্থায় যোগদান করেন। তাজউদ্দীন আহমদও ওই সময় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন এবং মুক্তি পাওয়ার পর তিনি তার কাজের জন্য নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় চলে যান। পরে বঙ্গবন্ধু নিজেই নারায়ণগঞ্জে গিয়ে তাজউদ্দীন আহমদকে ঢাকায় নিয়ে এসে আলফা বীমা সংস্থায় চাকরি দিয়েছিলেন। এ ছাড়া মোহাম্মদ হানিফকে বঙ্গবন্ধু আলফা বীমা সংস্থায় নিজের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন।’
শেখ হাসিনা সেদিন আরও বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু সব সময় চিন্তা করতেন। সেই চিন্তা-ভাবনাগুলো লিখে রাখতেন এবং ওই লেখাগুলো হানিফকে দিতেন টাইপ করার জন্য। এ জন্য কেবল হানিফই এ (৬ দফা দাবি) সম্পর্কে জানতেন। কারণ তিনি সেটি টাইপ করেছিলেন। অন্যথায় এটি সম্পর্কে কেউ জানত না।