চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিস্ফোরণস্থল বিএম কনটেইনার ডিপো থেকে আধা কিলোমিটার দূরে কেশবপুর মোল্লাপাড়া চায়ের দোকানি মো. হেলালের মাথায় এখন রাজ্যের চিন্তা। আর আয়ে ভাটা পড়ার আশঙ্কার পাশাপাশি মেয়ের চিকিৎসার খরচ জোগানোর চ্যালেঞ্জ এখন তার মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ডিপো থেকে উড়ে আসা এক বস্তু হেলালের দোকানের টেলিভিশন সেটটি ভেঙে দিয়েছে, যে যন্ত্রটি ছিল তার ক্রেতা আকর্ষণের এক অনুষঙ্গ।
হেলালের ব্যবসার রীতি হলো, মুনাফা কম বিক্রি বেশি। পণ্যমূল্য বৃদ্ধির মধ্যেও তিনি ৫ টাকায় চা ও তন্দুর (রুটি) বিক্রি করেন।
অল্প অল্প সঞ্চয়ে একটি পুরোনো ফ্রিজও কিনেছিলেন হেলাল। ঠান্ডা পানীয় বিক্রিও ছিল তার আয়ের একটি উৎস, টেলিভিশনের পাশাপাশি নষ্ট হয়েছে এই যন্ত্রটিও।
হেলালের দোকানে বসে ক্রেতারা টেলিভিশন দেখতে দেখতে আড্ডা দেন, ফাঁকে ফাঁকে খাওয়া-দাওয়া করতেন। সেই টেলিভিশন ভেঙে কয়েক টুকরা, হেলালের দুশ্চিন্তা এবার ক্রেতা পাওয়া যাবে তো?
নিউজবাংলাকে এই দোকানি বলেন, ‘মানুষদের যদি টেলিভিশন না দেখাই আর ঠান্ডা কিছু খাওয়াতে না পারি, তাহলে কাস্টমার আসবে না। টেলিভিশন আর ফ্রিজ কেনার সামর্থ্য আমার নাই। এখন আমার কী হবে?’
গত শনিবার রাতে যখন ডিপোয় বিস্ফোরণ হয়, তখন হেলাল জানতে পারেননি কী হচ্ছে। তবে বিকট শব্দে ভয় পেয়েছিলেন তিনি। কিছুক্ষণ পরই কনটেইনারের উড়ে আসা একটি অংশ তার জীবনকে এলোমেলো করে দেয়।
উড়ন্ত সেই টুকরো দোকানে এসে মেয়ে শারমিন আক্তারের পায়ে পড়ে। এতে তার পা কেটে যায়, যে কারণে দিতে হয়েছে তিনটি সেলাই। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শারমিন।
এই দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৪১ জনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে প্রশাসন। তৈরি পোশাক কারখানার মালিকদের সমিতি বিজিএমইএ জানিয়েছে, তাদের ১১০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য পুড়েছে, টাকার বর্তমান বিনিময় হারের বিবেচনায় তা হাজার কোটি টাকার সমান।
ডিপোর আশপাশে চার থেকে পাঁচ কিলোমিটার এলাকায় হেলালের মতো মানুষদের ক্ষয়ক্ষতি কেমন হয়েছে, সে বিষয়টির কোনো হিসাব কষা অবশ্য সম্ভব নয়।
স্থানীয়রা বলছেন, কদমরসুল এলাকার বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে চারপাশের অন্তত পাঁচ কিলোমিটার এলাকা। অনেক দূরের বাসাবাড়ি এবং মসজিদে গিয়ে দেখা গেছে তার প্রমাণ। ফাটল ধরেছে কয়েকটি ভবনে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসী চায় ক্ষতিপূরণ।
বিএম ডিপোর আশপাশে কেশবপুর, মোল্লাপাড়া, লালবেগসহ কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বসবাসকারীদের বেশির ভাগই শ্রমিক। সবার টিনশেড ঘর। বিস্ফোরণে উড়ে গেছে কারও ঘরের টিন, নষ্ট হয়েছে টিভি-ফ্রিজ-ফ্যানসহ নানা পণ্যসামগ্রী।
সোমবার সকালে দেখা গেছে, স্থানীয়রা অনেকে বিস্ফোরণের এলাকা থেকে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন।
নুর মোহাম্মদ নামে এক বাসিন্দা বলেন, ‘আমার বাড়ির কাচ ভেঙে গেছে। আমার এটির ক্ষতিপূরণ কে দেবে?’
অলিনগর আব্দুল জলিল জামে মসজিদের খতিব মুফতি আজিজ রজভী জানান, মসজিদটির ওপর এবং নিচের সব কাচ ভেঙে গেছে।
নুর উদ্দিন নামে একজন বলেন, ‘আমাদের নিজেদের চলতে কষ্ট হয়। এখন কাজ চলে গেছে। যে ক্ষতি হয়েছে, সে ক্ষতিপূরণ আমাদের দিতে হবে।’
চারতলা ভবনের মালিক আবুল বশরের বাড়ির চারদিকের সব কাচ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘ডিপোর মালিক ব্যবসা করছে আমাদের কী লাভ? আমরা কেন এত বড় ক্ষতির সম্মুখীন হব।’
মো. তারেক নামে এক বাসিন্দা জানান, তার দোকানের ফ্রিজ, ফ্যান, সিলিং এবং ডিম নষ্ট হয়ে গেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা গোলাম রসূল বলেন, বিস্ফোরণের সময় বিকট শব্দের জন্য ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। কালো ধোঁয়া আর কেমিক্যালের পোড়া গন্ধে ছেয়ে যায় পুরো এলাকা।