খুলনা মহানগরীর অবস্থান ভৈরব ও রূপসা নদীর মিলনস্থলে। আর রূপসা নদী থেকে একটি শাখা বেরিয়ে ময়ূর নদ নামে প্রবেশ করেছে এ শিল্প শহরের ভেতরে।
সঠিক উদ্যোগ ও পরিকল্পনার অভাবে এই তিন নদী বিশেষ করে ময়ূর নদ ভাগাড়ে পরিণত হতে চলেছে। অন্য দুটিতেও জোয়ার-ভাটার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে বর্জ্য। ঘটছে পরিবেশ দূষণ। পানি দূষিত হয়ে পড়ায় অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ।
এমন বাস্তবতায় সারা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশেও আজ রোববার পালিত হচ্ছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস।
নগরে সৃষ্ট বর্জ্যের সবটুকু নিষ্কাশনের সক্ষমতা নেই খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি)। ফলে প্রতিদিন কঠিন বর্জ্যের একটি বড় অংশ নালা-নর্দমার মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে মিশে যাচ্ছে এই তিন নদীতে। ফলে নদীর পানির দূষণ মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এর মধ্যে ময়ূর নদ বদ্ধ থাকায় সেখানে দূষণের মাত্রাও কয়েক গুণে বেশি।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃথক দুটি গবেষণাপত্র ও পরিবেশ অধিদপ্তর খুলনা কার্যালয়ের ‘রিভার ওয়াটার এনালাইসিস শিট’ থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা-১৯৯৭ অনুসারে অভ্যন্তরীণ ভূ-পৃষ্ঠের পানির বিশুদ্ধতার মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয় সাধারণত পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ, প্রাণরাসায়নিক অক্সিজেনের চাহিদা ও পানিতে দ্রবীভূত ভৌত উপাদানের মাত্রার ওপর ভিত্তি করে।
গত এপ্রিল মাসে ময়ূর নদ থেকে পরিবেশ অধিদপ্তরের সংগ্রহ করা নমুনার জরিপে দেখা যায়, পানি বিশুদ্ধতার মানদণ্ড ও আদর্শ সীমার সঙ্গে ওই নদের পানির ব্যাপক তারতম্য রয়েছে।
দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ (ডিও)
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বর্তমানে ময়ূর নদের পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা প্রতি লিটারে দশমিক ২ থেকে দশমিক ৬ মিলিগ্রাম। অথচ ডিওর আদর্শ মাত্রা বিবেচনায় প্রতি লিটার পানিতে ৫ মিলিগ্রামের বেশি হওয়া উচিত। পানিতে ডিওর মাত্রা কম হওয়ায় এই নদীর পানি জলজ প্রাণী ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
ময়ূর নদে প্রতিদিন যেসব কঠিন বর্জ্য মিশে যাচ্ছে, তা জারনের মাধ্যমে বিনষ্ট হতে প্রচুর পরিমাণ দ্রবীভূত অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। ফলে ওই পানির ডিও দিন দিন কমে যাচ্ছে।
প্রাণ রাসায়নিক অক্সিজেন চাহিদা (বিওডি)
পানিতে মিশ্রিত বর্জ্য বিয়োজিত করতে অণুজীবগুলোর যে পরিমাণ অক্সিজেন দরকার হয়, তাকে বিওডি বলা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, পানির আদর্শ বিওডি হলো প্রতি লিটারে ৬ মিলিগ্রাম। এই মান ১০-এর ওপরে গেলে সেই পানিকে দূষিত পানি হিসেবে ধরা হয়। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বর্তমানে ময়ূর নদের পানির বিওডির মাত্রা প্রতি লিটারে ৭৮ থেকে ৮৬ মিলিগ্রাম, যা আদর্শ মানদণ্ডের সীমা থেকে বহুগুণে বেশি।
পানিতে দ্রবীভূত ভৌত উপাদান (টিডিএস)
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, পানিতে দ্রবীভূত ভৌত উপাদানের আদর্শ পরিমাণ (টিডিএস) প্রতি লিটারে ৩০০ মিলিগ্রাম। এই মাত্রা এক হাজারের ওপরে গেলে সেই পানি মানুষের ব্যবহারের অনুপযোগী ধরা হয়। আর পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ময়ূর নদের প্রতি লিটার পানিতে সর্বোচ্চ ৬০৬০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত টিডিএস পাওয়া গেছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের খুলনা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. এমদাদুল হক বলেন, ‘খুলনায় সবচেয়ে বেশি দূষণ এখন পানিতে। বিশেষ করে শহরের পার্শ্ববর্তী নদীর পানির মান অনেক বেশি খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আর ময়ূর নদের পানির দূষণের মাত্রা অনেক বেশি।’
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা
ময়ূর নদের পানি নিয়ে ২০১৩ ও ২০২০ সালে পৃথক দুটি গবেষণা করেছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। গবেষণা দুটির নেতৃত্বে ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক দিলীপ কুমার দত্ত।
তিনি বলেন, ‘২০১৩ সালের গবেষণায় আমরা পেয়েছিলাম, ময়ূর নদের পানিতে অতিমাত্রায় টিডিএস রয়েছে। ফলে ওই পানি বেশ দূষিত ও গন্ধযুক্ত ছিল। তবে ওই নদের মাটির পুষ্টি গুণাগুণ বেশ ভালো পাওয়া গিয়েছিল।
‘সেখানে মাটির যেসব গুণাগুণ পাওয়া গিয়েছিল তা কৃষিকাজের জন্য বেশ উপযোগী ছিল। কেসিসি বর্জ্য ফেলা থেকে বিরত থাকলে এ নদীর পরিবেশ ভালো থাকত।’
অধ্যাপক দিলীপ বলেন, ‘২০২০ সালে আমাদের গবেষণাটি ছিল মূলত খুলনা শহরের পানির নিরাপত্তা নিয়ে। এ গবেষণায় আমরা পেয়েছিলাম, খুলনা শহরের পানির চাহিদা মেটাতে ময়ূর নদকে বিশুদ্ধ পানির আধার হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে।’
তিনি জানান, খুলনার বিল পাবলা এলাকা থেকে রূপসার আলুতলা পর্যন্ত ময়ূর নদের দৈর্ঘ্য প্রায় ১১ কিলোমিটার। আলুতলায় ১০ বেন্টের একটি গেট তৈরি করে এটির প্রবাহ বন্ধ করে রাখা হয়েছে। ফলে এখানে কোনো জোয়ার-ভাটা হয় না। খুলনা শহরের মধ্যে এই নদের ৬টি শাখা ছড়িয়ে আছে। শহরের গৃহস্থ ও বর্জ্য মিশ্রিত দূষিত পানির ৮০ শতাংশ ২২টি ড্রেনের মাধ্যমে এই নদে পড়ছে। ফলে এখানে দূষণের মাত্রা অনেক বেশি।
দিলীপ কুমার দত্ত বলেন, ‘নদটি সংস্কার করে বর্ষা মৌসুমে স্বাদু পানি ধরে রাখা যেতে পারে। পরবর্তী সময়ে বছরজুড়ে সেই পানি দিয়ে শহরের মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানো যাবে।’
শহরের বর্জ্য পড়ছে নদীতে
খুলনা সিটি করপোরেশনের প্রধান কনজারভেন্সি অফিসার আব্দুল আজিজ বলেন, ‘শহরে প্রতিদিন ১২০০ থেকে ১২৫০ টন কঠিন বর্জ্য তৈরি হয়। এর মধ্যে মেডিক্যাল বর্জ্যই থাকে ৪ থেকে সাড়ে ৪ টন।’
‘সিটি করপোরেশনের কর্মীরা প্রতিদিন ৮০০ টন বর্জ্য সংগ্রহ করে শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে ফেলে আসেন। বাকি ৪০০ থেকে ৪৫০ টন বর্জ্য ড্রেন বা ফাঁকা জমিতে শহরের মানুষ ফেলে দেয়।’
‘শহরের সব বর্জ্য সংগ্রহের জন্য আমাদের পর্যাপ্ত লজিস্টিক সাপোর্ট ও কর্মী নেই। আমাদের ৩১টি ওয়ার্ডের সেকেন্ডারি ট্রান্সপোর্ট স্টেশন থেকে প্রতিদিন ১৯৮ জন স্থায়ী ও ৭১০ জন অস্থায়ী কর্মী বর্জ্য অপসারণ করেন। নগরবাসীর উচিত, ড্রেনে বা ফাঁকা জমিতে ময়লা না ফেলে কেসিসির সেকেন্ডারি ট্রান্সপোর্ট স্টেশনে ফেলা।’
খুলনাঞ্চলের নদ-নদী ও পরিবেশ নিয়ে প্রায় ২৫ বছর ধরে গবেষণা করছেন গৌরাঙ্গ নন্দী। তিনি বলেন, ‘কেসিসি যেসব বর্জ্য সংগ্রহ করে না, তা কোনো না কোনোভাবে ড্রেনের মাধ্যমে ময়ূর, ভৈরব ও রূপসা নদীতে গিয়ে পতিত হয়। এতে নদীর পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে, পানিতে দূষণের মাত্রাও বাড়ছে।’
‘ভৈরব ও রূপসা নদীতে এখনো জোয়ার-ভাটা হয়। তাই সেখানে পতিত বর্জ্য বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে। অন্যদিকে ময়ূর নদটি বদ্ধ হওয়া পতিত বর্জ্য সেখানে দূষণ বাড়াচ্ছে। শহরের পরিবেশ রক্ষার জন্য অবিলম্বে নদটি সংস্কার করে স্বাদু পানির আধার হিসেবে গড়ে তোলা উচিত।’