দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার করা হচ্ছে না বরগুনার শতাধিক কমিউনিটি ক্লিনিক। অধিকাংশ ভবনের দরজা-জানালা খুলে গেছে, ছাদে ফাটল ধরেছে ও পলেস্তারা খসে পড়েছে। বৃষ্টির সময় ছাদ চুয়ে পানি পড়ে। এতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সেবাগ্রহীতাদের।
বরগুনা জেলা সার্জন অফিস থেকে জানা যায়, জেলায় প্রতি ছয় হাজার মানুষের জন্য একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক। শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছাড়া ক্লিনিকগুলো সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
একেকটি ক্লিনিকে সপ্তাহে ছয়দিন বসেন একজন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) এবং তিন দিন করে বসেন একজন স্বাস্থ্য সহকারী। স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা ছাড়াও ইপিআই কর্মসূচির সব কার্যক্রম এসব কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে বাস্তবায়ন করা হয়।
১৯৯৯ সালে প্রতি ওয়ার্ডে একটি করে মোট ১১৬টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়। ২০২১ সালে আমতলীতে ব্যক্তিগত অনুদানে আরও দুটি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ করা হলে এর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১৮টিতে।
বরগুনা সদর উপজেলার ঢলুয়া ইউনিয়নের কাঁঠালতলী কমিউনিটি ক্লিনিকে বুধবার সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, নারী ও শিশুসহ প্রতিদিন গড়ে ৩৫-৪০ জন রোগী আসছেন এ ক্লিনিকে স্বাস্থ্যসেবা নিতে। কিন্তু ভবনের বেহাল দশার কারণে স্বাস্থ্যসেবা নিতে আাসা গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
ক্লিনিকটিতে সম্প্রতি প্রসূতি সেবা নিতে আসা কাঁঠালতলী গ্রামের গৃহবধূ সালমা বলেন, ‘আমাদের ক্লিনিকের ভবনটা এহন যদি না ঠিক করে তয় ভাইঙ্গা পইর্যা যাবার সম্ভাবনা আছে। মোরা এইহানে ভালোই সেবা পাই, মোগো এইডারে সরকার একটু ঠিক কইর্যা দিউক।’
কাঁঠালতলী কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্য সহকারী মো. রিয়াজুল কবীর রিয়াজ বলেন, ‘রাস্তা থেকে ক্লিনিকে যাওয়ার সংযোগ সড়ক নেই। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে এই ক্লিনিকসেবা নিতে আসা রোগীরা বেশি ভোগান্তির শিকার হন। বৃষ্টির সময় ক্লিনিকে সেবা নিতে আসা রোগীদের কাঁদামাটি পেরিয়ে পিচ্ছিল পথ দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে এ ক্লিনিকে আসেন। ভবন চুইয়ে পানি পড়ে আসবাবসহ ওষুধ নষ্ট হয়ে যায়।’
ঢলুয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুল হক স্বপন জানান, তার ইউনিয়নে চারটি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। এই ক্লিনিকের কারণে তার এলাকার মানুষ বিনা টাকায় হাতের নাগালে স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন। কিন্তু ভবনগুলো সংস্কার না হওয়ায় সেবা নিতে আসা রোগীরা যেমন ভোগান্তিতে তেমনি সেবা দেয়া সিএইচপিরাও খুব কষ্টে কাজ করছেন।
সদর উপজেলার হাজারবিঘা কমিউনিটি ক্লিনিকে স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসা নাসিমা আক্তার জানান, তার একমাত্র ছেলে নাঈম গত দুই দিন ধরে জ্বরে আক্রান্ত হয়েছি। তাই তিনি তার ছেলের চিকিৎসার জন্য এখানে এসছেন। এর আগে আরো কয়েকবার তারা বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে এ ক্লিনিকে এসেছেন। কিন্তু ক্লিনিকের ভেতরে বসার জায়গাটুকুও ভালো নেই। পুরোনো ভবনের পলেস্তারা খসে মাথায় পড়ার ঝুঁকি রয়েছে।হাজারবিঘা গ্রামের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর মিয়া জানান, এ ক্লিনিকে স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসা অধিকাংশই নারী ও শিশু। ভবনগুলো সংস্কার না হলে সেবা নিতে আসার রোগী ও সেবাদাতা উভয়েই ঝুঁকিতে।সদর উপজেলার বরগুনা সদর ইউনিয়নের বৈঠাকাটা এলাকায় মাঠের মধ্যে স্থাপিত কমিউনিটি ক্লিনিকের আধভাঙা ভবনে চলছে কার্যক্রম। একইভাবে সদরের বিভিন্ন ইউনিয়নে স্থাপিত কমিউনিটি ক্লিনিকেরও একই দশা।
আমতলী উপজেলার গুলিশাখালী ইউনিয়নের খেকুয়ানি বাজারের কমিউনিটি ক্লিনিকের ভবনটি ২০২০ সালে দেয়াল এবং বিমসহ ধসে পড়ে। ফলে তখন থেকেই এই ভবনটি আর ব্যবহার করা যাচ্ছে না। স্বাস্থ্যসেবা অব্যাহত রাখতে নিরুপায় হয়ে সিএইচসিপিরা খেকুয়ানি বাজারের একটি ক্লাব ঘরে কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা মনিরুল ইসলাম তালুকদার জানান, দুই বছর আগে খেকুয়ানি কমিউনিটি ক্লিনিক ভবনটি ধসে পড়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যসেবা ঠিক রাখতে আমরা খেকুয়ানি বাজারের একটি ক্লাব ঘরে সিএইচসিপিকে বসার ব্যবস্থা করে দিয়েছি।
সিএইচসিপি আফরোজা আক্তার জানান, সংস্কারের অভাবে ক্লিনিকের ভবন ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। বাধ্য হয়ে স্কুলের বারান্দায় বসে রোগী দেখি। এতে নানা বিড়ম্বনা পোহাতে হয়।
একই অবস্থা তালতলী উপজেলার জয়ালভাঙ্গা কমিউনিটি ক্লিনিকের। ভবনটির ছাদে ফাটল দেখা দেয়ায় বর্ষার সময় পানিতে তলিয়ে যায়। নিরুপায় হয়ে বৃষ্টি আসলে মাথায় ছাতা ধরে রোগীদের সেবা দিতে হয়।
সিএইচসিপি সুজন প্যাদা জানান, প্রায় তিন বছর ধরে কমিউনিটি ক্লিনিকের অবস্থা বেহাল। বর্ষার সময় রোগী দেখতে গিয়ে ছাদ চুয়ে পানি পড়ায় ভিজে যান সেবা নিতে আসা ব্যক্তিরা।একইভাবে পাথরঘাটা, বামনা, আমতলী, তালতলী ও বেতাগী উপজেলা কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর ভবন সংস্কার না হওয়ায় ঝুঁকির মধ্যে চিকিৎসাসেবা দিতে হয় হেলথ কেয়ার প্রভাইডারদের। আর সেবা নিতে আসা গ্রামাঞ্চলের মানুষদেরও ভোগান্তি পোহাতে হয়।এ বিষয়ে বরগুনা জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. ফজলুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সত্যি বলতে আমাদের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর অধিকাংশ ভবনের অবস্থা খুবই খারাপ। আমরা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। ইতোমধ্যে এগুলো সংস্কারের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে তালিকা পাঠানো হয়েছে।’