বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

কী ঘটেছিল জিয়ার মৃত্যুর পর

  •    
  • ২৫ মে, ২০২২ ২৩:১৩

৯ মিনিটেই অপারেশন শেষ। ভোর সাড়ে ৪টার কিছু পরে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ২৪ ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল আবুল মনজুরকে মেজর মোজাফফর হোসেন ফোন করে জানালেন, ‘দ্য প্রেসিডেন্ট হ্যাজ বিন কিলড।’

১৯৮১ সালের ৩০ মে ভোররাতে চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে একদল সেনা কর্মকর্তা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সামরিক বাহনে চেপে বেরিয়ে আসেন। তখন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। সেনাসদস্যদের গন্তব্য ৭ কিলোমিটার দূরে শহরের কেন্দ্রস্থল কাজীর দেউরিতে সরকারি কর্মকর্তাদের অতিথিশালা সার্কিট হাউস।

ব্রিটিশ আমলে গড়া বাংলো প্যাটার্নের নয়নাভিরাম তিন তলা এই ভবনে তখন অবস্থান করছিলেন তখনকার রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। আগের দিন তিনি এখানে এসেছেন রাজধানী থেকে, স্থানীয় বিএনপিতে চলতে থাকা কোন্দল মেটাতে।

জিয়া হত্যার পূর্বাপর নিয়ে প্রোবনিউজ-এর প্রধান সম্পাদক ইরতিজা নাসিম আলীর একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট ১৯৯৪ সালের মে মাসে মতিউর রহমান সম্পাদিত দৈনিক ভোরের কাগজ-এ ধারাবাহিকভাবে আট কিস্তিতে ছাপা হয়েছিল। এই রিপোর্টে জানা যায় যে চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে ২৯ ও ৩০ মে তারিখের মধ্যবর্তী রাত সাড়ে ৩টায় তিনটি গাড়ি নিয়ে ১৬ জন সেনা কর্মকর্তা রওনা হন। প্রেসিডেন্ট জিয়া তখন সার্কিট হাউসে ঘুমিয়ে।গুলি করতে করতে তাদের একটি দল দোতলায় উঠে যায়। গোলাগুলির শব্দ শুনে বাইরে কী হচ্ছে দরজা ফাঁক করে দেখার চেষ্টা করলেন জিয়া। তখন গর্জে ওঠে আততায়ীর হাতের অস্ত্র। ৯ মিনিটেই অপারেশন শেষ। ভোর সাড়ে ৪টার কিছু পরে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ২৪ ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল আবুল মনজুরকে মেজর মোজাফফর হোসেন ফোন করে জানালেন, ‘দ্য প্রেসিডেন্ট হ্যাজ বিন কিলড।’

বলা হয়, এক সামরিক অফিসার তার স্টেনগানের এক ম্যাগাজিন গুলি পুরোটাই জিয়ার ওপর চালিয়ে দেন।

মেশিনগানের ব্রাশ ফায়ারে জিয়াউর রহমানের মুখের একপাশ উড়ে গিয়েছিল। একটি চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে এসেছিল। পেছনের দেয়ালে লেগেছিল বীভৎসতার চিহ্ন। বারান্দায় পড়ে থাকা প্রেসিডেন্টের রাতের পোশাক সাদা ধবধবে পাজামা-পাঞ্জাবি লাল হয়েছিল রক্তে।

জিয়ার লাশ এতটাই ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল যে তাকে চিনতে পারা কঠিন ছিল। চট্টগ্রামের তখনকার পুলিশ সুপার সৈয়দ শফিউদ্দীন আহমেদের পরিবারের সদস্যরা জানান, জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর দায়িত্বরত কোনো বেসামরিক কর্মকর্তা হিসেবে শফিউদ্দীন আহমেদই প্রথম ঘটনাস্থলে পৌঁছান। তিনি বারান্দায় পড়ে থাকা প্রেসিডেন্টের ছিন্নভিন্ন দেহ দেখে সেখানেই স্ট্রোক করেন।

জিয়ার সঙ্গে ওইদিন সার্কিট হাউসে গুলিতে নিহত হয়েছিলেন আরও দুই সেনা কর্মকর্তা– লে. কর্নেল আহসান এবং ক্যাপ্টেন আশরাফুল হাফিজ খান। এরা ছিলেন রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা বাহিনী বা প্রেসিডেন্টস গার্ড রেজিমেন্টের সদস্য।

জিয়ার এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে লেখক-সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ তার অনুভূতি প্রকাশ করেছিলেন সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরীর কাছে। তিনি বলেন, ‘জিয়া নিহত হয়েছিলেন তার প্রিয় সহকর্মী ও অনুগতদের হাতে। এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না।’

অন্যদিকে জিয়ার এই মৃত্যু নিয়ে তার অন্যতম রাজনৈতিক সহযোগী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদকে উদ্ধৃত করে গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন, যাদের ওপর জিয়া বেশি নির্ভর করেছিলেন, তারা যদি তাদের আনুগত্য বজায় রাখতেন, তাহলে জিয়ার এ রকম মর্মান্তিক পরিণতি হতো না। তার মতে, দুই পক্ষই (মুক্তিযোদ্ধা ও অমুক্তিযোদ্ধা) তার পতন চেয়েছে, এক পক্ষ কাজটা করেছে, লাভ গেছে অন্য পক্ষের ঘরে। দাবার চালে একদল জিতেছে, অন্য দলটি হেরেছে।

জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড ছিল বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থান আর পাল্টা অভ্যুত্থানের এক বিশৃঙ্খল পর্বের শেষ অধ্যায়, যা শুরু হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। জিয়াউর রহমানের সেনাপ্রধান থেকে রাষ্ট্রপতি হয়ে ওঠার পেছনেও ভূমিকা ছিল একই রকম সামরিক অভ্যুত্থানের।

৩০ মে ভোররাত ৪টার দিকে জিয়াকে হত্যা করা হয়। সকালবেলা সেনানিবাস থেকে যে দুজন সামরিক কর্মকর্তা প্রথম সেখানে হাজির হন, তারা ছিলেন মেজর শওকত ও মেজর রেজাউল করিম। এদের মধ্যে মেজর শওকতের দায়িত্ব ছিল নিহত তিনজনের মরদেহ সংগ্রহ করে কবর দেয়া। আর মেজর রেজার দায়িত্ব ছিল প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টের সদস্যদের সংগ্রহ করে সার্কিট হাউস থেকে ক্যান্টনমেন্টে ফিরিয়ে আনা। তারা দুজনই সার্কিট হাউসের দোতলার বারান্দায় নিজ কক্ষের সামনে জিয়ার ক্ষতবিক্ষত মরদেহ দেখেছেন।

মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) রেজাউল করিম ওইদিনের স্মতিচারণা করে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দোতলায় উঠে সিঁড়িবারান্দায় দেখি ছোটখাটো একটা ডেডবডি ঢাকা। একজন পুলিশ দাঁড়ানো। তাকে জিজ্ঞেস করলাম যে এটা কার ডেডবডি। সে বলল রাষ্ট্রপতির। তাকে মুখটা খুলতে বলার পর দেখলাম পরনে সাদা পাঞ্জাবি। তার একটা চোখ বের হয়ে ঝুলে আছে। পুরো মুখ ঝাঁঝরা। আমি তারপর তাকে বললাম ঠিক আছে ঢেকে রাখো। এর বেশি দেখার আর ইচ্ছা হয় নাই।‘বারান্দায় আরেকটু সামনে গিয়ে দেখি আরেকটা ডেডবডি। দেখি একটা হাত বের হয়ে আছে। মুখ খুলে দেখি এটা কর্নেল আহসান। আরেকটু সামনে গিয়ে দেখি একটা বড়সড় মরদেহ। যেটার শুধু পা বের হয়ে আছে। সেটা খুলে দেখি আমার বন্ধু ক্যাপ্টেন হাফিজ।’

লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড নিয়ে তার গবেষণা তুলে ধরেছেন ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম: শান্তিবাহিনী, জিয়া হত্যাকাণ্ড, মনজুর খুন’ বইয়ে। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জিয়াউর রহমানের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট থেকে দেখা গেছে যে তার মুখ ও কাঁধে ব্রাশফায়ার করা হয়েছে। তাছাড়া হাতে গুলির ক্ষত আছে। পায়ে গুলির ক্ষত আছে। মাথার খুলি একদিকে উড়ে গিয়েছিল ও মস্তিষ্ক বেরিয়ে গিয়েছিল। এগুলো রিপোর্টে লেখা আছে। রিপোর্ট তৈরি করেছিলেন লে. কর্নেল তোফায়েল।’

মাটিচাপা মরদেহ

জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর কর্নেল শওকত তা রাঙ্গুনিয়ায় এক পাহাড়ের পাদদেশে মাটিচাপা দিয়ে আসেন। আবার ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ্ কয়েক দিন পর তা গর্ত খুঁড়ে তুলে এনে ঢাকা পাঠান। এই অংশটি সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা যায় না। গবেষকরা এখানে খুব বেশি আলো ফেলতে পারেননি।

মেজর রেজাউল নিউজবাংলাকে বলেন, সার্কিট হাউস থেকে রাষ্ট্রপতি জিয়া ও আরও দুই সেনা কর্মকর্তার মরদেহ সংগ্রহ করে তা সমাহিত করার দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর শওকতকে। এই দায়িত্ব দিয়েছিলেন লে. কর্নেল মতিউর রহমান, যাকে জিয়ার হত্যাকাণ্ডের পরপর চট্টগ্রাম সেনানিবাসে সবচেয়ে সক্রিয় দেখা গেছে।

মেজর (অব.) রেজাউল করিমের ভাষ্য মতে, “কর্নেল মতিউর রহমান দাঁড়িয়ে আছেন, তার হাতে চায়নিজ স্টেনগান। আমাকে দেখেই বললেন, ‘রেজা কাম হিয়ার।‘ যাওয়ার পর আমাকে বললেন, ‘তুমি কোথায় ছিলে? তোমাকে তো খুঁজেই পাওয়া যায় না।’ আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম যে ‘কী হয়েছে’। তখন তার কাছ থেকেই আমি প্রথম শুনলাম যে জিয়া মারা গেছেন। উনি বললেন, ‘এখন আমাদের সব মুক্তিযোদ্ধাকে একসঙ্গে থাকতে হবে।’

“উনি আমাকে বললেন, ‘তুমি সার্কিট হাউজে যাও। তুমি মেজর শওকত ও আরও কয়েকজন অফিসারকে নিয়ে যাও। প্রেসিডেন্টের ডেডবডি পাহাড়ের ভেতরে কোথাও কবর দিয়ে আসো।‘

“আমি তাকে বললাম, ‘স্যরি স্যার, আমাকে অন্য কাজ দেন।’ আমি মেজর শওকতকে দেখিয়ে দিলাম।

“উনি তখন শওকতকে ডেকে বললেন যে তার দল নিয়ে যেতে। আর আমাকে বললেন, ওখানে গার্ড রেজিমেন্টের যেসব সদস্য আছে তাদের নিয়ে আসতে।”

সার্কিট হাউসে গিয়ে প্রেসিডেন্টস গার্ড রেজিমেন্টের সদস্যদের একত্র করে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে নিয়ে আসেন মেজর রেজা। আর জিয়াউর রহমানসহ তিন সেনা কর্মকর্তার লাশ একটি সামরিক পিকআপ ভ্যানে তুলে দাফনের উদ্দেশে রওনা দেন মেজর শওকত।

মেজর (অব.) রেজা বলেন, ‘ওরা তিনটা ডেডবডি ওদের গাড়িতে ওঠাল। আর আমি আমার লোকগুলোকে অস্ত্র জমা রাখার পর আমার গাড়িতে ওঠালাম। মেজর শওকতের নেতৃত্বে ওরা চলে গেল কবর দিতে। আর আমি চলে গেলাম ডিভিশনাল হেডকোয়ার্টারে।’

মেজর শওকত মেজর মোজাফফরসহ আরও কয়েকজন সেনাসদস্যকে সঙ্গে করে জিয়াউর রহমানের লাশ নিয়ে রাঙ্গুনিয়ায় পাহাড়ে চলে যান। নির্জন পাহাড়ের পাদদেশে একটি গর্ত করে সেখানে জিয়াউর রহমান, কর্নেল আহসান এবং ক্যাপ্টেন হাফিজের লাশ মাটিচাপা দিয়ে আসেন তারা। দুই দিন পর ১ জুন ব্রিগেডিয়ার (অব.) হান্নান শাহ্ চট্টগ্রামের সেই পাহাড় থেকে লাশ উদ্ধার করেন।

কীভাবে সেই কবর শনাক্ত করা হয়েছিল, সেটা এক ধোঁয়াশা।

মেজর জেনারেল আবুল মনজুর হত্যাকাণ্ড নিয়ে একটি উপন্যাস লিখেছেন সাংবাদিক ও লেখক মশিউল আলম। ‘দ্বিতীয় মৃত্যু’ নামের সেই উপন্যাস লিখতে গিয়ে সেই সময়ের অনেক প্রত্যক্ষদর্শী ও কুশীলবের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তিনি। ঘেঁটেছেন অনেক দলিল-দস্তাবেজ, সেই সময়ের পত্রপত্রিকা।

নিউজবাংলাকে মশিউল আলম বলেন, রাঙ্গুনিয়া থেকে প্রেসিডেন্ট জিয়ার লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল। সেখানেই তাকে কবর দেয়া হয়। কবর দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল মেজর মোজাফফরের ওপর। কর্নেল মতিউর তাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন জিয়ার লাশ সার্কিট হাউস থেকে নিয়ে চট্টগ্রামের কোনো পাহাড়ের খাদে ফেলে দিয়ে আসতে।কিন্তু পাহাড়ের কোনো খাদে ফেলে না দিয়ে মেজর মোজাফফর রাঙ্গুনিয়ায় এক গ্রামের কাছে সমতলে গ্রামবাসীর সহযোগিতায় সেখানে কবর দেন। পাথরঘাটা সেই গ্রামের নাম। গ্রামবাসীর সহায়তায়, তাদের কোদাল-খুন্তি দিয়ে গর্ত খুঁড়ে একই গর্তে তিনজনের লাশ সমাহিত করে রেখে আসেন তারা। ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ ও ওসি কুদ্দুসের নেয়া সাক্ষাৎকারে মশিউল আলম এটুকু জেনেছেন।

এ বিষয়ে পরে বিএনপির প্রয়াত সিনিয়র নেতা ব্রিগেডিয়ার (অব.) হান্নান শাহ কথা বলেছিলেন বিবিসির সাংবাদিক কাদির কল্লোলের সঙ্গে। জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের সময় হান্নান শাহ ব্রিগেডিয়ার পদমর্যাদায় চট্টগ্রাম মিলিটারি একাডেমিতে কর্মরত ছিলেন।

বিবিসিকে দেয়া সেই সাক্ষাৎকারে হান্নান শাহ বলেন, জিয়ার মৃত্যুর দিন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাত্তার দায়িত্ব নিয়ে ৩০ মে দুপুরের দিকে রেডিও-টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে যে যুদ্ধ পরিস্থিতি ছিল, সেটা তার পরের দিন দ্রুত পাল্টাতে থাকে।

৩০ মে অনেক সেনা কর্মকর্তার মতো হান্নান শাহকেও মিলিটারি একাডেমি থেকে ডেকে নিয়ে বিদ্রোহের পক্ষে সমর্থন চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু হান্নান শাহ তাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এবার ৩১ মে ঢাকার সঙ্গে সমঝোতার জন্য মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিতে অনুরোধ করা হয় হান্নান শাহকে।

প্রয়াত হান্নান শাহের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন সাংবাদিক-ঔপন্যাসিক মশিউল আলমও। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, হান্নান শাহ তাকে বলেছিলেন, তিনি নিজে থেকেই জিয়ার লাশ খুঁজছিলেন। তখন লাশ খোঁজার মূল দায়িত্ব পড়েছিল তৎকালীন ফটিকছড়ি সার্কেলের সার্কেল ইন্সপেক্টর গোলাম কুদ্দুসের ওপর, পরবর্তী সময়ে যিনি ওসি কুদ্দুস নামে পরিচিতি পান। এই গোলাম কুদ্দুস পরে পলায়নরত মেজর জেনারেল মনজুরকেও আটক করে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন।

বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে হান্নান শাহ জানান, নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে তিনি নিজ থেকেই পয়লা জুন জিয়াউর রহমানের মৃতদেহ খুঁজতে বের হয়েছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন কয়েকজন সিপাহি, একটি ওয়্যারলেস সেট এবং একটি স্ট্রেচার।

হান্নান শাহ ওই সাক্ষাৎকারে জানান, তারা কাপ্তাই রাস্তার উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন। একটি অনুমানের ওপর ভিত্তি করে নতুন কবরের সন্ধান করছিলেন তারা। তখন একজন গ্রামবাসী এসে তাদের জিজ্ঞেস করেন, তারা কী খুঁজছেন।

ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ ওই গ্রামবাসীকে জিজ্ঞেস করেন, সেনাবাহিনীর সৈন্যরা সেখানে কোনো ব্যক্তিকে সম্প্রতি দাফন করেছে কি না?

তখন সেই গ্রামবাসী একটি ছোট পাহাড় দেখিয়ে জানান, কয়েক দিন আগে সৈন্যরা সেখানে একজনকে কবর দিয়েছে। তবে গ্রামবাসীর কোনো ধারণা নেই কাকে সেখানে কবর দেয়া হয়েছে।

গ্রামবাসীর দেয়া তথ্য অনুযায়ী হান্নান শাহ সৈন্যদের নিয়ে সেখানে গিয়ে দেখেন নতুন মাটিতে চাপা দেয়া একটি কবর।

সেখানে মাটি খুঁড়ে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং আরও দুই সেনা কর্মকর্তার মৃতদেহ দেখতে পান তারা। তখন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মরদেহ তুলে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে আনা হয়। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে করে তা ঢাকায় পাঠানো হয়।

গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শহরের বাইরে পাহাড়ের ঢালে পুঁতে রাখা হয়েছিল। সেখান থেকে তুলে আনা হয় অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার পর। সেটা ১ জুন তুলে চট্টগাম সিএমএইচে নিয়ে আসা হয়। তার লাশ আইডেন্টিফাই করেন তার পিএস লে.কর্নেল মাহফুজ। এরপর পোস্টমর্টেম ও সেলাই করার পর কফিনে ভরে সেটাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়।

‘ঢাকায় আনার পর বেগম জিয়াকে কফিনটা দেখানো হয়। ঢাকনা খোলা হয় নাই। সেটা জাতীয় সংসদের নর্থ প্লাজায় তাকে দাফন করা হয়। তার আগে মানিক মিয়া অ্যাভেনিউয়ে যে জানাজা হয়েছিল, সেখানে স্মরণকালের বৃহত্তম সমাবেশ আমরা দেখেছি।’

লেখক ও গবেষক আনোয়ার কবির বলেন, জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর মেজর মোজাফফরের সঙ্গে তার একাধিকবার কথা হয়েছে। তিনি জিয়াউর রহমানের লাশ সম্পর্কে বলেছেন, লাশের একটি অংশ, বিশেষ করে মুখের অপশন প্রায় উড়ে গিয়েছিল। তা দেখে কোনটা কার লাশ বোঝা কঠিন ছিল।

মেজর (অব.) রেজা বলেন, মেজর জেনারেল মনজুর ধরা পড়ার পর হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া বেশির ভাগ অফিসারই আটক ও নিহত হন। এরশাদের লোকজন জিয়াউর রহমানের লাশ ঢাকায় পাঠায় এবং যে কফিন ঢাকায় আসে, তা আর খোলা হয়নি বলে জানা যায়। তাই কফিনে কী ছিল বা ছিল না তা বলা কঠিন।

ঢাকায় জিয়ার মরদেহ আসার পর

সেই সময় ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা ছিলেন সাজ্জাদ হোসেন। তার বয়ানে: ‘৩০ মে ঢাকায় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সম্মেলন হওয়ার এবং এতে জিয়াউর রহমানের প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা ছিল। জিয়ার মৃত্যু সংবাদ শুনে সম্মেলন স্থগিত হয়ে যায়।

‘সন্ধ্যায় ৩০টা বেবিট্যাক্সিতে 'তাহের মাইক' লাগিয়ে পরদিন ঢাকা স্টেডিয়ামে জিয়ার জানাজা হবে—এটা প্রচারের ব্যবস্থা করলাম। ইচ্ছে করেই 'গায়েবানা' শব্দটা ব্যবহার করিনি। ভেবেছিলাম, মানুষ মনে করবে জিয়ার লাশ এসে গেছে এবং তারা বেশি সংখ্যায় জানাজায় হাজির হবে।

সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে শামসুল হুদা চৌধুরী, শাহ আজিজ আর ডা. মতিন ছিলেন। তারা বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক ডা. খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে ডেকে এনে হম্বিতম্বি করলেন- কার হুকুমে জানাজার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে? তারা বললেন, 'ক্যান্টনমেন্টগুলোর পরিস্থিতি আমরা জানি না, বিশেষ করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট। অ্যাকটিং প্রেসিডেন্ট জানাজায় যাবেন না।'

৩১ মে সকাল ৯টায় ঢাকা স্টেডিয়ামে জানাজা হলো। মোনাজাতের ঠিক আগের মুহূর্তে জাস্টিস সাত্তার এসে উপস্থিত হলেন। তখন এটা অফিশিয়াল জানাজা হয়ে গেল। জিয়ার লাশ ঢাকায় আসার পর মানিক মিয়া অ্যাভেনিউতে অনুষ্ঠিত হলো স্মরণকালের সবচেয়ে বড় জানাজা।’

রেডক্রসের আহ্বান

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের এক দিন পর ১৯৮১ সালের ৩১ মে দৈনিক ইত্তেফাকের প্রধান শিরোনাম ছিল, ‘প্রেসিডেন্ট জিয়া নিহত’। উপশিরোনামে লেখা হয়: ‘বিচারপতি সাত্তার অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান’। বিএনপি তখনও ক্ষমতায়, অথচ দলের প্রতিষ্ঠাতার মরদেহের কোনো সন্ধান নেই। এমন অবস্থায় ১ মে ইত্তেফাকে একটি সংবাদ ছাপা হয়, যেখানে বলা হয়, আন্তর্জাতিক রেডক্রসের কর্মকর্তারা বিদ্রোহী সেনাদলের নেতা মেজর জেনারেল আবুল মনজুরের সঙ্গে দেখা করে রাষ্ট্রপতির মরদেহ তাদের কাছে হস্তান্তরের অনুরোধ করেন, যদিও মনজুর তা অস্বীকার করেন।

ঢাকায় প্রকাশিত এক প্রেসনোটের বরাত দিয়ে বাসস জানায়, হত্যাকাণ্ডে নিহত প্রেসিডেন্টের দাফনের জন্য আন্তর্জাতিক রেডক্রসের মাধ্যমে লাশ ফেরত চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর দেশজুড়ে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সাত্তার, প্রধানমন্ত্রী শাহ আব্দুল আজিজ, স্পিকারের অংশগ্রহণে গায়েবানা জানাজা হয়।

এর পরদিনই গণমাধ্যমে সংবাদ ছাপা হয়, রাঙ্গুনিয়া পাহাড়ের পাদদেশে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মরদেহ মাটিচাপা দেয়া হয়েছিল। খবরে বলা হয়, কর্নেল আহসান ও ক্যাপ্টেন হাফিজের মরদেহের সঙ্গে একই কবরে জিয়াউর রহমানের মরদেহ মাটিচাপা দেয়া হয়েছিল। জিয়ার মরদেহ ছিল অন্য দুইজনের মরদেহের মাঝে।

ইত্তেফাক সেই কবরের ছবিও ছাপে। এতে বলা হয়, রাঙ্গুনিয়া কলেজের কাছে ছিল এই কবর। ২৫ টাকা করে পারিশ্রমিক দিয়ে তালেব আলীসহ দুইজন স্থানীয় ব্যক্তিকে দিয়ে এই কবর খোঁড়ানো হয়। দোয়া পড়ানো হয় স্থানীয় মৌলভকে দিয়ে। পরে গর্ত খুঁড়ে এই লাশ তোলা হয়।

লাশ শনাক্তের পরের দিন ‘ঢাকায় জিয়ার মরদেহ’ শিরোনাম ছাপা হয় সংবাদপত্রগুলোতে।

ইত্তেফাকের খবরে লেখা হয়, ‘কফিনটি প্রেসিডেন্ট ভবনে লইয়া যাওয়ার পর সেখানে এক হৃদয় বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সেখানে প্রেসিডেন্টের স্ত্রী ও দুই পুত্র কান্নায় ভাঙ্গিয়া পড়েন। কিন্তু কফিনের ঢাকনা খোলা হয় নাই।’

বিতর্ক যে কারণে

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মরদেহ তড়িঘড়ি এক নির্জন পাহাড়ে সমাহিত করা, পরে সেখান থেকে সেটি উদ্ধার করে কফিনে ভরে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া– এই বিষয়গুলো সবই হয়েছে অনানুষ্ঠানিকভাবে, খুব কম লোকই যুক্ত ছিল এসব প্রক্রিয়ার সঙ্গে। ফলে তখন থেকেই একটি সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে: যে মরদেহ তুলে আনা হয়েছে, সেটা যে জিয়াউর রহমানেরই, তার নিশ্চয়তা কী।

লেখক ও সাংবাদিক আনোয়ার কবীর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পুরো ঘটনাটিকেই রহস্যের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর লাশ নিয়ে যে বিতর্ক চলছে সেটা বড় রকমের বিতর্ক। সেটা কিন্তু তখনও ছিল। ১৯৮১ সালে জিয়া হত্যাকাণ্ডের পর তার লাশ নিয়ে আসার পর সেটা কাউকে দেখানো হয়নি। কফিনের ভেতর তার লাশ ছিল কি ছিল না? জিয়া হত্যার পর দ্রুততার সঙ্গে সবকিছু করা হয়েছিল।

জেনারেল মনজুরকেও দ্রুত হত্যা করা হয়। সেটার মূল কারণ ছিল জিয়ার হত্যাকে ধামাচাপা দেয়া। জিয়াউর রহমানের লাশ নিয়ে যে বিতর্ক চলছে, সেটার বড় কারণ হলো লাশগুলো এতটা বিকৃত হয়েছিল যে উপস্থিত কারও পক্ষে আইডেন্টিফাই করা সম্ভব ছিল না যে কোনটি জিয়াউর রহমানের লাশ বা আদৌ তার লাশ ছিল কি না।’

মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ নিউজবাংলাকে বলেন, এই প্রক্রিয়াগুলো অস্বচ্ছভাবে সম্পন্ন হয়েছিল বলেই এখনও সেগুলো রহস্যাবৃত বলে মনে করার অবকাশ আছে। কারণ কোনো কিছুরই দালিলিক প্রমাণ রাখা হয়নি।

তিনি বলেন, যেভাবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল এবং যেভাবে তা সরকার, সিভিল প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সামলানোর চেষ্টা করা হয়েছে, সেই সময় থেকেই মানুষের মনে সন্দেহ দেখা দেয়। এই বিতর্ক এখন ছড়িয়ে পড়েছে।

তিনি যোগ করেন, জিয়াউর রহমানের মরদেহ উদ্ধার ও ঢাকায় দাফনের আগে-পরে কোনো স্বজন বা সহকর্মী তা দেখেননি বা শনাক্তও করেননি। যে একজন মাত্র ব্যক্তি তাকে শনাক্ত করেছিলেন, তিনি জিয়াউর রহমানের পিএ লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাহফুজ। তাকে সরিয়ে দেয়া হয় এই হত্যাকাণ্ডের দায়ে ফাঁসিতে ঝোলানোর মধ্য দিয়ে।

তিনি বলেন, যেহেতু কেউ এটা দেখেননি, তাই এখন কেউই বলতে পারছেন না, সত্যি সত্যিই সেখানে মরদেহ ছিল কি ছিল না!

গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ অবশ্য মনে করেন, জিয়ার মরদেহ নিয়ে ধোঁয়াশা থাকার কারণ নেই। কেননা মরদেহের ময়নাতদন্ত হয়েছিল।

তিনি বলেন, ‘জিয়াউর রহমানের ডেডবডিকে চিহ্নিত করেছেন তার পিএস। লে. কর্নেল মাহফুজ। তাকে পরে ফাঁসি দেয়া হয়। মাহফুজের ভাষ্য অনুযায়ী জিয়া ও আরও দুটো মৃতদেহকে ৩০ মে বেলা আড়াইটায় চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের কাছে কবর দেয়া হয়। ১ জুন মাহফুজ জিয়ার মৃতদেহ তুলে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিয়ে আসেন। সেখানে ১ জুন সকাল ১০টায় তার ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। সেটার বিস্তারিত প্রতিবেদনও আছে।সবকিছু শেষ করে কফিনে মুড়ে বেলা ১টায় ব্রিগেডিয়ার আজিজুল ইসলাম, লে. কর্নেল মাহফুজ ও লে. কর্নেল মাহবুবুল ইসলামের কাছে হস্তান্তর করা হয়। প্রতিবেদনে যার স্বাক্ষর আছে তার নাম লে. কর্নেল কে জেড তোফায়েল আহমেদ, প্যাথলজি বিশেষজ্ঞ।’

মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ বলেন, আইন মোতাবেক মরদেহ ময়নাতদন্তের দায়িত্ব সিভিল সার্জনের। তার আগে পুলিশ সুরতহাল রিপোর্ট করবে। এরপর পুলিশ পোস্টমর্টেমের আবেদন করবে। এ জন্য পুলিশের নির্দিষ্ট একটা ফরম আছে। সেটা তারা ফিলাপ করে পোস্টমর্টেমের আবেদন করবে। সিভিল সার্জনেরও ময়নাতদন্তের একটি নির্দিষ্ট ফরম্যাট আছে। চট্টগ্রাম সেনানিবাসের সামরিক হাসপাতালে ময়নাতদন্তে এগুলোর কোনোটাই অনুসরণ করা হয়নি। একটি সাদা কাগজে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট লেখা হয়েছে। মরদেহ হস্তান্তরের সময় কফিনের মুখ খোলা হয়নি, স্বজনদের কাউকে মরদেহ দেখতে দেয়া হয়নি। ফলে কফিনে মরদেহ দেখার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলতে পারেন, এমন কাউকেই পাওয়া যায় না।

অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার নিউজবাংলাকে বলেন, সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে বিমান বাহিনীর একটি পরিবহন বিমানে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে পৌঁছায় নিহত রাষ্ট্রপতির কফিন।

এখনকার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ছিল তখনকার সংসদ ভবন। বিমানবন্দর থেকে কফিন সেখানে এনে রাখা হয়। ঢাকায় কফিন পৌঁছানোর পর থেকে সমাহিত করা পর্যন্ত মোহাম্মদ আলী শিকদার তার লোকবল নিয়ে সেখানে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি তখন ক্যাপ্টেন পদে ছিলেন। একেবারে তরুণ অফিসার। তিনি জানান, সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত বহু মানুষ লাশ দেখতে এসেছিলেন। কেউ কেউ ফুল নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু তারা প্রেসিডেন্টের মুখ দেখতে পারেননি। কারণ কফিনের ঢাকনা খোলা হয়নি।

মোহাম্মদ আলী শিকদার জানান, তাদের ওপর থেকে নির্দেশ ছিল, কফিনের ঢাকনা খোলা যাবে না। সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড অনুযায়ী তারা সেই নির্দেশ পালন করেছেন। কাউকে কফিনের মুখ খুলতে দেননি। পরদিন ভোর থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত আরও লোক আসেন। এরপর কফিন সমাহিত করা হয়।

হত্যা আর প্রহসনের বিচারের রাজনীতি

বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাজনৈতিক অভিলাস আর রক্তপাতের বিশৃঙ্খল এক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যার উত্থান হয়েছিল, একই রকম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির শিকার হয়ে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। তবে অনেকে এটাকে শুধুই এক বিশৃঙ্খলা হিসেবে দেখেন না। তারা বলেন, সেনাবাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধা সদস্যদের সঙ্গে পাকিস্তান প্রত্যাগত অংশের দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ এইসব ঘটনা। এবং প্রতিটি ঘটনায় মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ও সেনা সদস্যদের কোণঠাসা বা নিশ্চিহ্ন করার প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়া হয়েছে। চট্টগ্রামে জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর যেভাবে বিচারকাজ চলেছে, তাতে সেটি আরও স্পষ্ট হয়।

লেখক ও সাংবাদিক আনোয়ার কবির নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীতে ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত ক্যুয়ের নামে অসংখ্য হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল। যার অধিকাংশের শিকার হন মুক্তিযোদ্ধারা। এখন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় অনেকগুলো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে পাকিস্তানফেরত সদস্যরা জড়িত ছিলেন। যেটা বলা হয় যে তখন সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে জেনারেল এরশাদের সঙ্গে পাকিস্তান প্রত্যাগতরাই ছিলেন।’

জিয়াউর রহমান এবং বিশেষ করে মনজুর হত্যাকাণ্ড নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন কথাসাহিত্যিক মশিউল আলম, যেটির নাম: দ্বিতীয় খুনের কাহিনি। উপন্যাসের রসদ সংগ্রহ করতে গিয়ে বহু দলিল দস্তাবেজ ঘেঁটেছেন তিনি, কথা বলেছেন এইসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত নানাজনের সঙ্গে।মশিউল আলম বলেন, ‘চট্টগ্রাম সেনানিবাসে সৈনিক ও অফিসারদের মধ্যে একটা ক্ষোভ ছিল যে জিয়াউর রহমান পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসারদের বেশি সুযোগ- সুবিধা দিচ্ছেন। এর মধ্যে এরশাদও ছিলেন। এটা নিয়ে একটা ক্ষোভ ছিল। তাদের মূল দাবিটাই ছিল যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে তাদের কথা শুনতে হবে। তাদের প্রাধান্য দিতে হবে। যারা পাকিস্তানফেরত তাদের এত সুযোগ-সুবিধা দেয়া যাবে না।’

জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের সব দিক আজও উন্মোচিত হয়নি। অনেকে বলেন, হত্যাকাণ্ডের পর যেভাবে দ্রুততার সঙ্গে বিচারের নামে বিষয়টিকে ধামাচাপা দেয়া হয় এবং এটির সঙ্গে যুক্ত নন এমন অনেককে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়, সেটি সন্দেহ উদ্রেককারী।

হত্যা আর অভ্যুত্থানের এই অধ্যায় বাংলাদেশ অনেক পেছনে ফেলে এসেছে, তাতে সন্দেহ নেই। তবে ইতিহাসের অন্ধকার অংশগুলো উন্মোচিত না হলে, অনেক কিছুরই জট খুলবে না।

এ বিভাগের আরো খবর