সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার হরিপুরে প্রায় দুই একর জায়গা নিয়ে মৎস্য খামার করেছেন কয়ছর আজিজ। খামারের মাছ বড়ও হয়ে গিয়েছিল। কিছুদিনের মধ্যেই বিক্রির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এর মধ্যে বন্যা এসে ওলট-পালট করে দিয়েছে সব। ভাসিয়ে নিয়ে গেছে কয়ছরের খামার। ভেসে গেছে সব মাছ।
আক্ষেপ করে কয়ছর বলেন, ‘নিজের সব পুঁজি বিনিয়োগ করেছিলাম এখানে। এক বছর ধরে পরিশ্রম করেছি। অথচ হঠাৎ বন্যা এসে সব শেষ হয়ে গেল!’
প্রায় ২০ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘এখন আমার পথে বসার অবস্থা।’
শুধু কয়ছর আজিজ নন, বর্তমানে এমন ক্ষতির মুখে পড়েছেন সিলেটের বেশির ভাগ মৎস্য চাষি। চলমান বন্যায় তলিয়ে গেছে জেলার প্রায় ১৯ হাজার পুকুর, দিঘি, হ্যাচারি ও মাছের খামার। জেলা মৎস্য অফিসের হিসেবেই এই বন্যায় ভেসে গেছে ২১ কোটি ৭৩ লাখ টাকার মাছ।
রোববার সিলেট সদর উপজেলার শিবেরবাজার এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, সড়কের পাশেই বানের পানিতে মাছ ধরার ধুম পড়েছে। ঠেলা জাল দিয়ে মাছ ধরেছেন অনেকে। এই সড়কের পাশেই মৎস্য খামার করেছিলেন নয়ন আহমদ।
তিনি বলেন, ‘আমার খামার উপচে মাছ বেরিয়ে গেছে। এই মাছই লোকজন জাল দিয়ে ধরে খলুই ভরে মাছ নিয়ে যাচ্ছে।’
নয়ন জানান, বন্যা শুরু হওয়ার পর নেট দিয়ে খামারের চারপাশ উঁচু করেছিলেন তিনি। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। পানির তোড়ে ভেসে গেছে সব।
ঢল ও অতিবৃষ্টিতে গত ১১ মে থেকে সিলেটে বন্যা শুরু হয়। বন্যায় সিলেটের ১৩ উপজেলার ১১টিই প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ। এতে বোরো ধানের পাশাপাশি তলিয়ে গেছে আউশের বীজতলাও। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে মৎস্য চাষিদেরও।
সিলেট জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, সিলেটে ৫৩ হাজারের অধিক পুকুর, হ্যাচারি ও খামারে মাছের চাষ হয়। এর মধ্যে চলমান বন্যায় ১৮ হাজার ৭৪৯টিই তলিয়ে গেছে।
সিলেট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম আজাদ নিউজবাংলাকে জানান, বন্যায় ২ কোটি ১৩ লাখ মাছের পোনা এবং ২ হাজার ৩০৫ টন মাছ ভেসে গেছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ১৫ হাজার ১৬৩ জন মৎস্য চাষি। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।
ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্য চাষিদের কোনো প্রণোদনা দেয়া যায় কি না- এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষই সিদ্ধান্ত নেবে।’
এ ছাড়া পানি যদি আরও বাড়ে তাহলে আরও অসংখ্য মৎস্য খামারের ক্ষতি হবে বলেও তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সিলেট কার্যালয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী নিলয় পাশা জানান, শুক্রবার থেকেই সিলেটের নদ-নদীর পানি কমছে। ফলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। আপাতত পানি বাড়ার কোনো শঙ্কা নেই।
মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, বন্যায় মাছের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি হয়েছে জকিগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, বিশ্বনাথ, জৈন্তাপুর ও বিয়ানীবাজার উপজেলায়। এসব উপজেলায়ই মৎস্য খামার সবচেয়ে বেশি।
এর মধ্যে জকিগঞ্জে ৬ হাজার ৩৫০টি মাছের খামার তলিয়ে ৬২২ কোটি টাকা, গোয়াইনঘাটে ২ হাজার ৫৯২টি খামার তলিয়ে ১৪০ কোটি টাকা, কানাইঘাটে ২ হাজার ৩৫০টি খামার তলিয়ে ৬৪ কোটি টাকা, বিশ্বনাথে ২ হাজার ১৫০টি খামার তলিয়ে ১৫৫ কোটি টাকা, জৈন্তাপুরে ২ হাজার ১০০টি খামার তলিয়ে ৬৭৪ কোটি টাকা ও বিয়ানীবাজারে ১ হাজার ৪০২টি খামার তলিয়ে ২১৬ কোটি ৮১ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
এ ছাড়া সিলেট সদর উপজেলায় ৫৩৫টি, গোলাপগঞ্জে ৮৪৫টি, বালাগঞ্জে ৭০টি, কোম্পানীগঞ্জে ১৪৫টি ও দক্ষিণ সুরমায় ২১০টি মাছের খামার তলিয়ে গেছে।
বন্যায় কয়েক হাজার মৎস্য চাষি সর্বস্ব হারিয়ে ফেলেছেন জানিয়ে মৎস্য চাষে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার পাওয়া বিশ্বনাথের রুবা খানম বলেন, ‘অনেকে ব্যাংক ঋণ নিয়ে মাছ চাষ করেছিলেন। তাদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ।’
ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্য চাষিদের সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনা দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তা না হলে মানুষজন মাছ চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। ঝুঁকিপূর্ণ ভেবে এই খাতে বিনিয়োগ করবে না।’