চুয়াডাঙ্গা স্বাস্থ্য বিভাগে ভুয়া জনবল নিয়োগ দিয়ে কয়েক কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে সাবেক সিভিল সার্জন ও তার অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে।
করোনার সময় চুয়াডাঙ্গা স্বাস্থ্য বিভাগের মাধ্যমে জেলার সদর হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও কমিউনিটি ক্লিনিকে জনবল নিয়োগ দেয় গোল্ডেন সার্ভিস লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান।
অভিযোগ উঠেছে, কোম্পানিটির আস্থা প্রকল্পের আওতায় চুয়াডাঙ্গার সিভিল সার্জন কাযার্লয়ের মাধ্যমে সে সময় নিয়োগ পান ১৮৪ জন নারী-পুরুষ। তাদের কাছ থেকে মাথাপিছু দেড় থেকে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেয়া হয়েছে। বিনিময়ে প্রতি মাসে নির্ধারিত বেতন বেঁধে দিয়ে নিয়োগপত্র দেয়া হলে মাসের পর মাস ধরে কাজ করে এক মাসেরও বেতন পাননি নিয়োগপ্রাপ্তরা।
জেলার স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে এখন তাদের বলা হচ্ছে, আস্থা প্রকল্পের কোনো অস্তিত্ব নেই। তাই তাদের চাকরিরও কোনো বৈধতা নেই। স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে তাদের ইতোমধ্যেই কর্মস্থল ত্যাগ করতে বলা হয়েছে।
এ অবস্থায় বেতন না পেয়ে প্রতারণার শিকার নারী-পুরুষরা আন্দোলন শুরু করলে বিষয়টি জানাজানি হয়। পরে ঘটনাটি খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
বুধবার বেলা ১১টায় চুয়াডাঙ্গায় পৌঁছান সেই কমিটির সদস্যরা। তদন্ত কমিটির প্রধান খুলনা বিভাগের পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. মো. মনজুরুল মুরশিদসহ অন্য দুজন হলেন যশোরের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. নাজমুস সাদিক ও খুলনা স্বাস্থ্য বিভাগের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এম এম জাহাতাব হোসেন। তারা সদর হাসপাতালের মিলনায়তনে আস্থা প্রকল্পের আওতায় স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, কর্মচারী ও স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মী এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেন।
তদন্ত কমিটির পক্ষ থেকে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মীদের একটি ফরম দেয়া হয়েছে। সেখানে নিয়োগ, কাজে যোগদান, টাকা লেনদেন ও জড়িতদের সম্পর্কে তথ্য দিতে বলা হয়েছে।
এ সময় চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন ডা. সাজ্জাৎ হাসান, সাবেক সিভিল সার্জন ডা. এ এস এম মারুফ হাসান, সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আতাউর রহমানসহ সিভিল সার্জন অফিসের অন্য কর্মকর্তারা এবং দামুড়হুদা, আলমডাঙ্গা ও জীবননগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রধানরা উপস্থিত ছিলেন।
বিকেলে তদন্ত কমিটির প্রধান ডা. মনজুরুল মুরশিদ বলেন, ‘বিষয়টি অধিক গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের লিখিত অভিযোগ ঢাকায় পাঠানো হবে এবং তথ্য যাচাই করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২১ সালের ৬ জুলাই ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকার গোল্ডেন সার্ভিস লিমিটেড কোম্পানি থেকে একটি চিঠি আসে চুয়াডাঙ্গার সিভিল সার্জন কার্যালয়ে। কোম্পানিটির আস্থা প্রকল্পের পরিচালক জাহিদ হাসান স্বাক্ষরিত সেই চিঠিতে বলা হয়, মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনসাপেক্ষে করোনার সময় স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে জনবল নিয়োগ দেবে তারা। এ জন্য জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের কাছ থেকে জনবলের চাহিদাপত্র আহ্বান করা হয়। সেই চিঠির বিপরীতে শূন্যপদের তথ্য তুলে ধরেন তখনকার সিভিল সার্জন ডা. এ এস এম মারুফ হাসান। সে তথ্যের ভিত্তিতে চুয়াডাঙ্গায় ১৮৪ জনকে বেতনভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করা হয়। আর জামানতের নামে তাদের কাছ থেকে দেড় থেকে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়।
বলা হচ্ছে, ওই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সাবেক সিভিল সার্জন ডা. এ এস এম মারুফ হাসানের ইন্ধনে তার অফিসের দেলোয়ার হোসেন, রোকেয়া খাতুন, নুর আলম, জীবননগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্সচালক শ্রী দানেশ, উথলী গ্রামের জহুরুল ইসলাম, মনোহরপুর গ্রামের সাগর হোসেন, তেলটুপি গ্রামের মোহাম্মদ খায়রুলসহ অন্যরা মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন। পরে নিয়োগপ্রাপ্তদের চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালসহ জেলার চারটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও কমিউনিটি ক্লিনিকে ভাগ করে যোগদান করতে চিঠি দেন সিভিল সার্জন।
কিন্তু নিয়ম মেনে মাসের পর মাস কাজ করেও নিয়োগপত্রে উল্লেখিত কোনো সুবিধাই পাননি ভুক্তভোগীরা। এসব নিয়ে অভিযোগ জানালে আশ্বাস দিয়ে ঘোরাতে থাকেন সিভিল সার্জন ডা. মারুফ হাসান। এরই মধ্যে তিনি বদলিও হয়ে যান।
জীবননগর পৌর শহরের শাপলাকলিপাড়ার রেজাউল হোসেনের স্ত্রী মালা খাতুন বলেন, ‘আমি চাকরির জন্য আমার স্বামীর মোটরসাইকেল বিক্রি করে ও ব্র্যাক থেকে ঋণ নিয়ে ২ লাখ দিই উথলী গ্রামের জহুরুল ইসলামের কাছে। স্বপ্ন ছিল, টাকার বিনিময়ে হলেও চাকরিটি নিয়ে সংসারে সচ্ছলতা আনব। কিন্তু তা আর হয়নি। জীবননগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আয়া পদে চাকরি নিয়ে ছয় মাস ডিউটি করে এখন পর্যন্ত এক টাকাও বেতন পাইনি। জামানতের ২ লাখ টাকা ফেরত পাব কি না তাও জানি না।’
জীবননগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আয়া পদেই চাকরির জন্য মনোহরপুর গ্রামের সাগর হোসেনের কাছে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন উথলী গ্রামের আয়ুব আলীর স্ত্রী ফাতেমা খাতুন। নিয়োগপত্র পেয়ে তিনিও টানা ছয় মাস হাসপাতালে ডিউটি করছেন। কিন্তু কোনো বেতন পাননি। শুধু মালা কিংবা ফাতেমা নন, এমন অবস্থা নিয়োগপ্রাপ্ত সবারই।
এ অবস্থায় অভিযোগ উঠেছে, বেনামি এনজিও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার কাজে প্রধান ভূমিকা রেখেছেন তৎকালীন সিভিল সার্জন ডা. মারুফ হাসান ও তার আশপাশের লোকজন।
গোল্ডেন সার্ভিস লিমিটেড কোম্পানির আওতায় আস্থা প্রকল্পের কোনো অস্তিত্ব নেই বলে নিশ্চিত করেছেন চুয়াডাঙ্গার বর্তমান সিভিল সার্জন ডা. সাজ্জাৎ হাসান। তিনি বলেন, ‘গোল্ডেন সার্ভিস লিমিটেড কোম্পানির যে ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে তা ভুয়া। ওই প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত কারও জেলা স্বাস্থ্য বিভাগে চাকরি করার বৈধতা নেই। তাদের কর্মস্থল ত্যাগ করতে বলা হয়েছে।’
এদিকে যাচাই-বাছাই না করেই ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার কথা স্বীকার করেছেন তৎকালীন সিভিল সার্জন ও মাগুরা ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. এ এস এম মারুফ হাসান। তবে চাকরিতে টাকা লেনদেনের বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।