ঈদযাত্রায় লাখো যাত্রী গ্রামে ফিরেছেন মোটরসাইকেলে। এর প্রভাব পড়েছে সামগ্রিক পরিবহন ব্যবসায়। অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় এবার ঈদের আগে-পরে বাসগুলোতে যাত্রী সংখ্যা ছিল কম।
যাত্রী কম থাকার কারণ হিসেবে পরিবহন ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, মোটরসাইকেল ও অন্যান্য ব্যক্তিগত যানবাহনে যাতায়াত এবার অনেক বেড়েছে।
ঈদে যাতায়াত করতে মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কারের ব্যবহার আগের চেয়ে দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে বেড়েছে। এবার রেকর্ডসংখ্যক মানুষ মোটরসাইকেলে ঢাকা ছেড়েছেন। যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু সেতুর দুই পাড়ে মোটরবাইকের দীর্ঘ জট এবার অনেককেই বিস্মিত করেছে।
মোটরসাইকেলে ঢাকা ছেড়েছেন, এমন মানুষের সংখ্যা এবার ২০ লাখের বেশি বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ।
বাসমালিকরা বলছেন, প্রতিবার ঈদের আগে নিয়মিত বাসের সঙ্গে বাড়তি বাস যুক্ত করতে হয়, এবার তা করতে হয়নি। ঈদের কোনো আমেজ বাসে ছিল না। ফেরার পথে কিছু যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে।
ঈদের বাড়তি আয় না হওয়ায় শ্রমিকদের ঈদ বোনাসের টাকা ওঠাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে দাবি মালিক ও শ্রমিকদের।
ঢাকা-কুষ্টিয়া সড়কে চলাচলকারী রাবেয়া পরিবহনের কাউন্টার মাস্টার উজ্জ্বল ভৌমিক বলেন, ‘মোটরসাইকেলে তো সব যাত্রী নিয়া গেছে। আমরা এবার যাত্রী কম পাইছি।’
বরাবরই ঈদের আগের রাতে বাসগুলোতে যাত্রীদের চাপ বেশি থাকে। এবার সে রকম কোনো চিত্র দেখা যায়নি।
ঢাকা-সাতক্ষীরা সড়কের ঈগল পরিবহনের চালক মিজানুর রহমান বলেন, ‘এইবার চাঁদ রাতে আমরা যাত্রীই পাই নাই। সবাই আগে চলে গেছে।’
ঢাকা-কক্সবাজারে সড়কে চলা এনা পরিবহনের সহকারী ম্যানেজার আরিফ মাহমদু বলেন, ‘ঈদের আগে আমাদের যাত্রীর যে পরিমাণ চাপ থাকে, এবার সেটা ছিল না। আমাদের গাড়ি চলেছে, কিন্তু বাড়তি যে ৮-১০টা গাড়ি চাঁদরাতে ব্যবহার করা লাগে, সেটা হয়নি। তবে আমাদের নিয়মিতসংখ্যক যাত্রী ছিল।’
সাধারণ সময়ে ২৫ মিনিট পরপর নিরালা পরিবহনের একটি করে বাস মহাখালী টার্মিনাল থেকে টাঙ্গাইলের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। আর ঈদের সময়ে যাত্রীসংখ্যা পূর্ণ হলেই গাড়ি ছেড়ে দেয়। এবারের ঈদে কোনো কোনো বাস ভর্তি হতে এক ঘণ্টার বেশি সময় লেগেছে বলে জানান নিরালার বুকিং মাস্টার আবুল কালাম।
তিনি বলেন, ‘ঈদ ছাড়া আমাদের যাত্রী যেমন থাকে, ঈদেও এত ছিল না। এক গাড়ি ভরতে এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগছে। শেষ দিকে যাত্রীই পাই নাই।’
যাত্রী কম যাওয়ার কারণ হিসেবে আবুল কালাম বলেন, ‘লম্বা ছুটির কারণে এইবার ২৫-২৬ এপ্রিল থেকেই মানুষ বাড়ি যাওয়া শুরু করেছে। একসময়ে সব মানুষ না যাওয়ায় ভিড় কম ছিল। আর যে পরিমাণ মোটরসাইকেল গেছে, তার কথা নাই বলি। যারা বাসে যেত, এমন অনেক যাত্রী এবার মোটরসাইকেলে গেছে।’
বাস কাউন্টারের ভিড় আর যানজট এড়াতে মোহাম্মদপুর থেকে টাঙ্গাইলের গোপালপুরে মোটরসাইকেলে গিয়েছেন হাফিজ আল আসাদ। তিনি বলেন, ‘ঢাকা থেকে গোপালপুরের দূরত্ব ১৪২ কিলোমিটার। এই দূরত্বের রাস্তা ঈদের মধ্যে যেতে কখনও কখনও ১৭-১৮ ঘণ্টা লেগে যায়। যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয়। এই দুর্ভোগ এড়াতেই মোটরসাইকেলে যাতায়াত করি।’
হাফিজ আল আসাদ একজন নিয়মিত বাইকার। তিনি বলেন, ‘আমি এবারও বাড়িতে মোটরসাইকেলে এসেছি। আমার তিন ঘণ্টার কিছু বেশি সময় লেগেছে। বাস কাউন্টারে টিকিটের লাইন, যানজটে বসে থাকা এসব কিছুই পেতে হয়নি।’
ঈদে কোনো ব্যবসা হয়নি বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের তো কোনো ঈদ ছিল না। স্বাভাবিকের চেয়ে খারাপ অবস্থা ছিল। যাত্রীই পাই নাই। আসার পথে কিছু যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘মোটরসাইকেলেই তো কমপক্ষে ২০ লাখ লোক নিয়ে গেছে। দীর্ঘ ছুটির কারণে শেষ মুহূর্তে ওই ধরনের চাপ হয়নি। বাসমালিকরা পুরা লুজার। ঈদের সময় যে বোনাস দিবে, সেই পয়সাটাও উঠাইতে পারে নাই। চরম খারাপ অবস্থা। আমাদের তিন ভাগের এক ভাগ গাড়ি চলছে। বাকিগুলো বসা ছিল।’
ঈদযাত্রায় এবারও বেশি মৃত্যু বাইকে
ঈদযাত্রায় ও ফিরতি পথে বাস-ট্রেনে ভোগান্তি এড়াতে হাজার হাজার মোটরসাইকেলের ছুটে চলা নিয়ে উচ্ছ্বাস দেখা গেলেও এই প্রবণতা এবারও সড়কে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর কারণ হয়েছে।
গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও ঈদযাত্রায় সড়কে অন্য যেকোনো বাহনের আরোহীর চেয়ে বেশি মারা গেছেন মোটরসাইকেলের আরোহীরা। আবার বাইক দুর্ঘটনায় যাদের মৃত্যু হয়েছে, তাদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি লাইসেন্স পাওয়ার মতো বয়সই হয়নি।
এবার ঈদে বাড়ি ফেরার সময় দুর্ঘটনায় মৃত্যু ছিল অনেকটাই কম। তবে ঈদের দিন থেকে ক্রমাগত মৃত্যুর তথ্য আসতে থাকে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন নামের একটি সংগঠন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন হিসাব করে দেখেছে, ঈদের আগে-পরে ১০ দিনে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ২৪৯ জন। তাদের মধ্যে ৯৭ জন মোটরসাইকেল আরোহী। গড় হিসাবে তা দাঁড়ায় ৩৯ শতাংশ।
যারা বাইক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন, তাদের মধ্যে ৫৭ শতাংশ বা ৫১ জনই অপ্রাপ্তবয়স্ক, অর্থাৎ ১৮ বছরের নিচে। এদের বাইক চালানোর লাইসেন্স পাওয়ার মতো বয়সই হয়নি।