ঈদযাত্রায় ও ফিরতি পথে বাস-ট্রেনে ভোগান্তি এড়াতে হাজার হাজার মোটরসাইকেলের ছুটে চলা নিয়ে উচ্ছ্বাস দেখা গেলেও এই প্রবণতা এবারও সড়কে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর কারণ হয়েছে।
গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও ঈদযাত্রায় সড়কে অন্য যেকোনো বাহনের আরোহীর চেয়ে বেশি মারা গেছে মোটরসাইকেলের আরোহীরা। আবার বাইক দুর্ঘটনায় যাদের মৃত্যু হয়েছে, তাদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি লাইসেন্স পাওয়ার মতো বয়সই হয়নি।
এবার ঈদে বাড়ি ফেরার সময় দুর্ঘটনায় মৃত্যু ছিল অনেকটাই কম। তবে ঈদের দিন থেকে ক্রমাগত মৃত্যুর তথ্য আসতে থাকে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন নামের একটি সংগঠন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন হিসাব করে দেখেছে, ঈদের আগে-পরে ১০ দিনে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ২৪৯ জন। তাদের মধ্যে ৯৭ জন মোটরসাইকেল আরোহী। গড় হিসাবে তা দাঁড়ায় ৩৯ শতাংশ।
যারা বাইক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন, তাদের মধ্যে ৫৭ শতাংশ বা ৫১ জনই অপ্রাপ্তবয়স্ক, অর্থাৎ ১৮ বছরের নিচে। এদের বাইক চালানোর লাইসেন্স পাওয়ার মতো বয়সই হয়নি।
করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতিতে বিধিনিষেধের কারণে গত দুই বছরে ঈদে গ্রামমুখো হওয়ার সুযোগ পায়নি। এবার ঈদের আগে-পরে মিলিয়ে ৯ দিন অবসরের সুযোগ তৈরি হওয়ার কারণে শহর ছেড়ে শিকড়ের টানে যাত্রাও ছিল বেশি।
গ্রামমুখী এই যাত্রায় এবার বাইরের স্রোত ছিল দেখার মতো। ফেরিঘাটে প্রথমবারের মতো অন্যান্য যানবাহন বসিয়ে রেখে কেবল বাইক পারাপার করা হয়েছে। উত্তরের পথে বঙ্গবন্ধু সেতুর পাশে টোলপ্লাজায় বাইক আরোহীদের দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে।
বাইকের এই যাত্রা নিঃসন্দেহে বাস, ট্রেন বা লঞ্চে চাপ কমিয়েছে। তবে ঈদের দিন থেকেই এবার যত সড়ক দুর্ঘটনার খবর এসেছে, তার একটি বড় অংশই ছিল বাইককেন্দ্রিক।
কেবল এবার নয়, গত কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর বেশির ভাগই হয় বাইকের কারণে।
এই বাহনগুলো সাধারণত দূরের যাত্রায় ব্যবহার করা খুবই বিপজ্জনক এ কারণে যে এর নিরাপত্তাব্যবস্থা দুর্বল। দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তিতে চালক দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মহাসড়কে বাইক দুর্ঘটনা হয় প্রাণঘাতী।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ঈদে ৩১৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩২৩ জন নিহত ও ৬২২ জন আহত হয়েছিলেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৩৯ জন মারা যান বাইক আরোহী। আহত হন আরও ১৯৯ জন।
ওই বছর সড়কে মৃত্যুর ৪৩ দশমিক ০৩ শতাংশ এবং আহতের ৩১ দশমিক ৯৯ শতাংশ ছিল বাইক আরোহী।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গণপরিবহনের বিকল্প হিসেবে এবার মোটরসাইকেলের ব্যবহার বেশি হয়েছে। মহাসড়কে চালিয়ে অভ্যস্ত নন, এমন ব্যক্তিরাও শত শত কিলোমিটার পাড়ি দিয়েছেন মোটরসাইকেলে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বেপরোয়া গতি ও চালকের অদক্ষতার কারণে দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে।’
ঢাকা মেডিক্যালে দুর্ঘটনার রোগীর বেশির ভাগই বাইকার
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের টিকিট কাউন্টার সূত্রে জানা গেছে, ২ থেকে ৫ মে পর্যন্ত দুই শতাধিক ব্যক্তি জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন। এদের বড় একটি অংশই সড়ক দুর্ঘটনার শিকার। তাদের মধ্যে নিউরো ও অর্থোপেডিক্স বিভাগে ভর্তি হয়েছেন শতাধিক নারী ও পুরুষ।
যশোরের মণিরামপুর থেকে ১৪ বছরের প্লাবন বণিক ঈদের আগের দিন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক্স বিভাগে ভর্তি হয়। মোটরসাইকেলে সে একাই ছিল। বিপরীত দিক থেকে আসা একটি গাড়িকে সাইড দিতে গিয়ে গাছের সঙ্গে ধাক্কা খায় সে। এতে তার হাত ও পা ভেঙেছে। বুকেও আঘাত লেগেছে।
প্লাবনের মা স্নিগ্ধা দত্ত বলেন, ‘কতবার না করলাম, জোরে গাড়ি না চালাইতে। এখন নিজে ভুগছে, আমাদেরও ভোগাচ্ছে।’
ওয়ার্ডে রোগী বেশি হওয়ায় ভেতরে শয্যা পাননি নরসিংদীর কামরুল আলম। তাকে ভর্তি করার পর জায়গা হয়েছে হাসপাতালের সিঁড়িতে। সঙ্গে থাকা তার স্ত্রী নাজমা বেগম বলেন, ‘এক মোটরসাইকেলে তিনজন ছিল। উনি চালাচ্ছিলেন। রাস্তায় পড়ে তিনজনই ব্যথা পাইছে। আমার স্বামীর বুকের পাজর ভাঙছে, ডান হাত ভাঙছে।’
অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষক ও বুয়েটের সহকারী অধ্যাপক সাইফুন নেওয়াজ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মোটরসাইকেলের মতো ছোট বাহন মহাসড়কে চালানোর জন্য যে পরিমাণ দক্ষতা অর্জন প্রয়োজন, তা অর্জনের আগেই অনেকে গাড়ি নিয়ে বাড়ি গেছে। জেলা শহরগুলোতে বেপরোয়া চলাচলের কারণেও অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে।
‘তবে চালকের ভুলেই সব দুর্ঘটনা হচ্ছে, এমন নয়। বিপরীত দিক থেকে আসা যানবাহনে থাকা চালকের অসতর্কতা, যত্রতত্র পথচারী পারাপারের কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে।’