বেলা ১১টা ছুঁইছুঁই, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের ৬ নম্বর প্ল্যাটফর্মে ছাড়ার অপেক্ষায় জামালপুরগামী অগ্নিবীণা এক্সপ্রেস। একটি বগিসংলগ্ন টয়লেটের সামনে প্লাস্টিকের বস্তা পেতে বসেছেন দুজন।
একজনের বয়স ত্রিশের ঘরে। বয়ঃসন্ধিকাল পেরোয়নি আরেকজনের। মলিন জামা-কাপড়, শুকনো বদনে বাড়ি ফেরার উচ্ছ্বাস নেই। ট্রেনের সঙ্গে হেলান দিয়ে চোখ মুদে আরাম করছেন।
আলাপ করে জানা গেল, ভাঙা লোহালক্কড়ের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জামালপুরের মো. সোহাগ। থাকেন যাত্রাবাড়ী। সঙ্গে ভাতিজা ইমন। ব্যবসার কাজে সাহায্য করে সে। রওনা দিয়েছেন বাড়ির উদ্দেশে।
ভ্রমণের টিকিট নেই- প্রশ্নের উত্তরে একটি কাগজ বের করে দেখালেন, একটি ‘ভ্রাম্যমাণ টিকিট পরীক্ষকের বাড়তি ভাড়ার টিকিট’ লেখা রসিদ। ৬০০ টাকা দিয়ে নিয়েছেন দুজনের জন্য।
সোহাগ বলেন, ‘টিকিট কাটার অত ট্যাকা নাই। তাই সিট ছাড়া এই টিকিট নিছি’
কার কাছে কিনেছেন জানতে চাইলে উত্তর- ‘এইখানকার লোকের কাছেই’
বগির অনেক আসন ফাঁকা, তবুও সেখানে বসেননি তারা।
সোহাগ বলেন, ‘অনেকগুলান সিট ফাঁকা আচে, কিন্তু বসি নাই। সামনে গিয়া যখন লোক উটবো, তখন তো উইঠা যাওন লাগব, তাই এই হানে বইচি, কেউ তো আর উঠায় দিতে পারব না।’
পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে বাড়ি যাচ্ছেন তারা। তবে ঈদের আনন্দ খুব বেশি ছুঁতে পারেনি তাদের। কারণ এখনও ঈদের কেনাকাটা হয়নি।
তিন মেয়েকে নিয়ে বাড়ির পথে দিনমজুর ইকবাল। ছবি: নিউজবাংলা
সলজ্জ হাসিতে সোহাগ বলেন, ‘বাচ্চাগো লাইগা কিচু কেনা হয়চে, নিজেগো লাইগা কিচু কিনতে পারি নাই। টাকা-পয়সার যে অবস্থা! দেখি, বাড়ি যাইয়া, কোনো ট্যাকা আচে নাকি...’
পুরো কথাটা শেষ করতে পারলেন না তিনি। লজ্জা, সংকোচ ও অসচ্ছলতার রেখা ফুটে উঠেছে চোখেমুখে।
পাশে বসা ভাতিজা লিমনেরও ঈদের পোশাক কেনা হয়নি। ইচ্ছে আছে কি না জানতে চাইলে মৃদু হেসে বলে, ‘ জি, আচে’। লজ্জামাখা হাসি মুখটাকে আরও মায়াবী করে তুলেছে। তবে কী কিনবে তার উত্তরটা এড়িয়ে গেল সেও।
ঈদযাত্রার বিষয়ে জানতে চাইলে সোহাগ বলেন, ‘বাড়িতে যাওন লাগব, ঈদের সময়। বাড়ির মানুষজন চাইয়্যা আচে।
‘খুব বেশি না, কিচু ট্যাকা বাড়িতে পাঠাইছিলাম। সেডা দিয়া বাড়িওয়ালা বাজারসদাই কিচু করচে। এইভাবেই ঈদ পার করা লাগব।’
তার লজ্জা পাওয়া দেখে কথা আর বাড়ানো গেল না।
সকালের দিকে ২ নম্বর প্ল্যাটফর্মে সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ছাড়ার অপেক্ষায় ছিলেন দিনমজুর ইকবাল। সঙ্গে তিন মেয়ে সুমাইয়া, লামিয়া ও রুমানা। বিরসমুখে লক্ষ্যহীন দৃষ্টি।
কাছে গিয়ে আলাপ করতেই বোঝা গেল, জোরে কথা বলার সামর্থ্য নেই, কিছুটা অসুস্থ।
ঈদ উদযাপনে বাড়ি যাওয়ার অনুভূতি জানতে চাইলে মুখে বিরক্তি নিয়ে বললেন, ‘আমগো আবার ঈদ, বাচ্চাগো ঠিকঠাক কেনাকাটা হয় নাই।’
অনেকটা বিব্রত হয়ে কথা বলার সুযোগ দিলেন না। পা বাড়ালেন ট্রেনের দিকে।
প্রতিদিনই রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে এমন অসংখ্য মানুষ নাড়ির টানে বাড়ি যাচ্ছেন, যাদের পেছনে অনেক না পাওয়ার আক্ষেপ। সঙ্গী শুধু ‘ঈদযাত্রা’।