‘১৫ দিন আগে আইছি৷ আরও ১০-১৫ দিন থাকা লাগবো। রাইত ইকানোই থাকি। খাইও ইকানো (এখানে)। ধান কাটা পুরা শেষ অইলে বাড়িত যাইমু।’
বলছিলেন আব্দুস সালাম। সুনামগঞ্জের বাদঘাটে তার বাড়ি। পেশায় বালু শ্রমিক। যাদুকাটা নদী থেকে বালু তোলার কাজ করেন। হাওরে ধান কাটার শ্রমিকের জোগান দিতে নদী থেকে বালু ও পাথর তোলা বন্ধ করেছে জেলা প্রশাসন। তাই হাওরে ধান কাটতে গিয়েছেন তিনি।
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওরে বুধবার নিউজবাংলার সঙ্গে কথা হয় আব্দুল সালামের।
সালামের মতো হাজারো শ্রমিক এখন হাওরে ধান কাটার কাজ করছেন। যাদের বেশির ভাগই এসেছেন সুনামগঞ্জের বাদাঘাট ও সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ থেকে।
সুনামগঞ্জের হাওরগুলোয় এখন ধান কাটার ধুম। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে ধান কাটা। কেউ ধান কাটছেন, কেউ তা রোদে শুকাছেন, ধান মাড়াই দিচ্ছেন কেউ কেউ। সব মিলিয়ে বিশাল কর্মযজ্ঞ।
ঢলে তলিয়ে যাওয়ার আগেই ধান ঘরে তুলতে মরিয়া কৃষকরা। সবাই ধান কাটার জন্য শ্রমিক লাগিয়েছেন। হাওরেই রাত কাটান এই তারা। খাওয়া ও ঘুম হাওরেই।
হাওরগুলোয় শ্রমিকদের থাকার জন্য বাঁশ ও খড় দিয়ে তৈরি করা হয়েছে বিশেষ ঘর। স্থানীয় ভাষায় ‘উড়া’ বলে।
বুধবার সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের শনির হাওর, জামালগঞ্জের হালির হাওর, শান্তিগঞ্জের দেখার হাওর ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার পাগনার হাওর ঘুরে দেখা যায়, অপেক্ষাকৃত উঁচু অংশে নির্মিত হয়েছে অসংখ্য উড়া।
ছোট্ট একেকটি উড়ায় ২০-৩০ জন পর্যন্ত শ্রমিক থাকেন। এর ভেতরে খড়ের বিছানায় ঘুমান। উড়ার ভেতরেই চলে রান্না। প্রতিটি উড়ায় রয়েছেন আলাদা বাবুর্চি।
উড়ায় থাকা শ্রমিকদের জন্য হাওরে গড়ে উঠেছে অস্থায়ী অনেক দোকানপাটও।
জামালগঞ্জের হালির হাওরে ধান কাটার শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন আউয়াল মিয়া। কাটা ধান মাথায় নিয়ে জড়ো করছিলেন তিনি।
আউয়াল বলেন, ‘এখন তো এক দমের ভরসা নাই। হঠাৎ ঢল এসে সব ভাসিয়ে নিতে পারে। হাওরের অনেক জায়গা এরই মধ্যে তলিয়ে গেছে। যেটুকু এখানও আছে সেগুলো কাটতে আমরা এখন রাতদিন হাওরেই থাকি। এখানেই খাইদাই, রাতে কিছু সময় ঘুমাইও। ঝড় শুরু হলে ঘুম থেকে উঠে যেতে হয়।’
হাওরে ধান কাটার শ্রমিকরা যান ঠিকাররদের মাধ্যমে। ঠিকাদাররা এখানে বেপারি নামে পরিচিত। শ্রমিকের জন্য আগে থেকেই বেপারিদের সঙ্গে চুক্তি করেন কৃষকরা। অগ্রিমও দিতে হয় কিছু।চাহিদামাফিক শ্রমিক সরবরাহ করেন বেপারিরা।
বিশ্বম্ভরপুরের বিভিন্ন হাওরে শ্রমিক সরবরাহ করেন শহিদুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘আমি ধান বা টাকার বিনিময়ে চুক্তি করে শ্রমিক দিই। এ ছাড়া শ্রমিকের থাকা০-খাওয়ার ব্যবস্থাও জমির মালিককে করতে হয়।’
সিলেট বিভাগের বিভিন্ন স্থান এবং বিভাগের বাইরের কিছু জেলা থেকেও শ্রমিক নিয়ে এসেছেন বলে জানান শহিদুল।
শনির হাওরে যখন ধান কাটা ও পরিবহনে ব্যস্ত শ্রমিকরা, তখন একটি উড়ার ভেতরে বড় পাতিলে রান্না করছিলেন আজিজুর রহমান। তিনি ওই উড়ার বাবুর্চি।
আজিজুর বলেন, ‘প্রতিদিন ২৪ জনের রান্না করতে হয়। ধান কাটা শেষে সন্ধ্যায় ফিরে এসে সবাই খেতে বসবে।’
হাওরেই এবার ঈদ করতে হবে জানিয়ে আজিজুর বলেন, ‘ধান কাটা শেষ না হলে তো বাড়ি যেতে পারব না। বেপারিও যেতে দেবে না।’
উড়ায় ঘুমাতে কষ্ট হয় কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রায় প্রতি রাতেই এদিকে ঝড় হয়। ঝড়ের সময় মনে হয়, সব উড়িয়ে নিয়ে যাবে। তখন খুব ভয় হয়। মশার যন্ত্রণাও আছে।
শনির হাওরে নিজেদের জমিতে ধান কাটানোর জন্য ১৫ জন শ্রমিক লাগিয়েছেন নুর মিয়া।
তিনি বলেন, ‘আমরা বেপারির মাধ্যমে চুক্তি করেছি। যা ধান কাটবে তার সাত ভাগের এক ভাগ তারা নেবে আর ছয় ভাগ আমি পাব।’
তাহিরপুরের কৃষক রমজান আলী বলেন, ‘এবার শ্রমিকই পাওয়া যাচ্ছে না। আবার দ্রুত ধান না কাটলে তলিয়ে যাবে। ৭০০ টাকা দৈনিক চুক্তিতে শ্রমিক লাগিয়েছি। খাওয়া-থাকার ব্যবস্থাও করতে হচ্ছে।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, ‘সুনামগগঞ্জে ধান কাটার শ্রমিকের সংকট নেই। এ পর্যন্ত হাওরে ৯০ শতাংশ ধান কাটা সম্পন্ন হয়েছে।’