করোনাভাইরাস মহামারির কারণে গত দুই বছর বিক্রিতে ধস নামলেও এবারের ঈদকে ঘিরে আশাবাদী ছিলেন চট্টগ্রামের মাদারবাড়ী এলাকার হাতে তৈরি জুতা--স্যান্ডেলের কারিগর ও ব্যবসায়ীরা।
তবে হতাশ হতে হচ্ছে তাদের। ঈদ উপলক্ষে বিক্রির ভরা মৌসুমে চলছে মন্দা।
পাকিস্তান আমলে চট্টগ্রামের মাদারবাড়ী এলাকায় গড়ে ওঠে হাতে তৈরি জুতা-স্যান্ডেলের কয়েকটি কারখানা। এগুলোতে তখন শুধু চামড়ার জুতা-স্যান্ডেল বানানো হতো। এরপর নব্বইয়ের দশকে এ শিল্পের ব্যাপক বিকাশ ঘটে।
২০১২ সালের আগ পর্যন্ত এখানে জুতা-স্যান্ডেল তৈরির প্রায় ৩৫০টি কারখানা ছিল। এখন তা কমে পূর্ব ও পশ্চিম মাদারবাড়ী এলাকায় কারখানা আছে ২৫০টি। কাঁচামাল থেকে শুরু করে জুতা-স্যান্ডেল তৈরি সবই হয় এই এলাকায়।
বিভিন্ন কারখানার মালিক ও শ্রমিকরা জানান, মহামারির আগে এ সময় পাইকারদের কাছ থেকে যে পরিমাণ অর্ডার আসত এবার এসেছে তার অর্ধেকেরও কম, যা অর্ডার তা মূলত ফুটপাতের খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে আসা।
চট্টগ্রাম ক্ষুদ্র পাদুকা শিল্প মালিক গ্রুপের সভাপতি মঞ্জু খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মালিক-শ্রমিকরা সারা বছর অপেক্ষায় থাকে ঈদের অর্ডারের। এ সময় শ্রমিকরা অনেক ব্যস্ত থাকে। জুতা তৈরির কাঁচামালের বেশির ভাগই আমদানি করা হয়। কয়েক বছর ধরে যে হারে কাঁচামালের দাম বাড়ছে সেভাবে তো আমরা দাম বাড়াতে পারছি না।
‘সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো দেশের বাজার চীনা, ভারতীয় ও বার্মিজ জুতায় সয়লাব। এ কারণে হাতে তৈরি দেশি জুতার বাজার নিম্নমুখী। স্বাভাবিক সময়ে ঈদ বাজারে ৮০ থেকে ৯০ কোটি টাকার মতো ব্যবসা হলেও এবার ৫০ কোটি হবে কি না তা নিয়েও সংশয় আছে।’
পূর্ব মাদারবাড়ী নছু মালুম লেনের পি.এম শুজ কারখানায় তৈরি হয় পুরুষদের জুতা-স্যান্ডেল। এখানে কাজ করেন প্রায় ২০ জন শ্রমিক।
কারখানার মালিক খায়রুল ইসলাম বলেন, ‘করোনার পর অনেক ব্যবসায়ী কারখানা বিক্রি করে চলে গেছেন। প্রচুর দক্ষ শ্রমিকও পেশা বদল করেছে। ফলে এ শিল্পে এখন জুতা তৈরির দক্ষ শ্রমিকের অভাব দেখা দিয়েছে।
‘করোনার আগে ঈদে যেমন ব্যবসা হতো এখন তা আর নেই। শবেবরাতের পর থেকে কিছু অর্ডার পেয়েছিল কারখানাগুলো। এখন একদমই মন্দা। বাজারে বিপুল পরিমাণ বিদেশি জুতা থাকায় আমাদের বাজার নিম্নমুখী।’
পূর্ব মাদারবাড়ী এলাকার কারখানাগুলো ঘুরে দেখা যায়, শ্রমিকদের কোনো ব্যস্ততা নেই। স্বাভাবিক গতিতে জুতা-স্যান্ডেল তৈরি করছেন। প্রতি বছরের মতো নিয়োগ দেয়া হয়নি বাড়তি শ্রমিকও।
১৯৯৬ সাল থেকে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত ফিট রাইট শুজের কারিগর খলিলুর রহমান। নারীদের স্যান্ডেলের ওপরের অংশ তৈরির কাজ করেন তিনি।
খলিলুর বলেন, ‘পরিস্থিতি ভালো না। গত ১০ দিনে মাত্র ২০ জোড়া জুতার আপার বানাইছি। অথচ আগে ঈদের এ সময়ে প্রতিদিন পাঁচ জোড়া আপার বানাইতাম। মার্কেটের পরিস্থিতি আসলেই খারাপ। অর্ডার কম। তাই মজুরিও কম।
‘গত মাসেও এর চেয়ে বেশি কাজ করছি। ঈদের চাপের ছিটাফোঁটাও নাই।’
ফিট রাইট শুজের স্বত্বাধিকারী হাবিবুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এ সময় সপ্তাহে ২০০ ডজন জুতা তৈরি করতাম। এখন সপ্তাহে ৫০ ডজন জুতারও অর্ডার আসছে না।
‘চাইলেও কারখানা বন্ধ করে দিতে পারি না। ঋণের ওপর এখানকার কারখানাগুলো চলছে। তাই টুকটাক অর্ডার নিয়েই টিকে থাকার চেষ্টা করছি।’
দুই বছরে কাঁচামালের দাম বেড়েছে চারগুণ
পূর্ব ও পশ্চিম মাদারবাড়ীর কারখানাগুলো ঘিরেই গড়ে উঠেছে হাতে তৈরি জুতার কাঁচামালের দোকান। এসব দোকানে জুতার চামড়া, র্যাকসিন, সোল, বাটন থেকে শুরু করে সব কিছুই বিক্রি হয়। জুতার অর্ডার কমে যাওয়ায় এসব দোকানের বিক্রিও কমে গেছে।
এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা জানান, গত দুই বছরে কাঁচামালের দাম চার দফায় বেড়ে চারগুণ হয়েছে।
পূর্ব মাদারবাড়ীর সিরাজ ফুট অ্যাক্সেসরিজের কালাম চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের ব্যবসা কারখানা মালিকদের উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল। ঈদ উপলক্ষে কারখানাগুলোতে জুতা তৈরির সেই ব্যস্ততা এখন আর নেই।
‘এখানকার ৮০ ভাগ জুতা তৈরির উপকরণ আমদানি করা হয়। কাঁচামালের দাম দুই বছরে চার দফা বেড়েছে। কাঁচামালের দাম বাড়লে জুতার দামও বাড়বে। তবে বিদেশি জুতা ফ্যাশনেবল ডিজাইন ও তুলনামূলক কম দামের হওয়ায় হাতে তৈরি জুতা-স্যান্ডেলের চাহিদা কমে গেছে।’