পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত মার্কেন্টাইল ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি ১ টাকা ২৫ পয়সা লভ্যাংশ যে বিনিয়োগকারীরা নিয়েছেন, তাদের সবাই এখন লোকসানে।
কোম্পানিটি এবার লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে মোট সাড়ে ১৭ শতাংশ, যার মধ্যে পাঁচ শতাংশ দেয়া হবে বোনাস শেয়ার হিসেবে।
বার্ষিক সাধারণ সভা বা এজিএমে অনুমোদনের পর তারাই এই লভ্যাংশ পাবেন, যাদের কাছে রেকর্ড ডেট ৬ তারিখে শেয়ারদর ছিল ১৭ টাকা ১০ পয়সা। পাঁচ শতাংশ বোনাস শেয়ার সমন্বয়ের পর দাম দাঁড়ায় ১৬ টাকা ৩০ পয়সা।
কিন্তু ৭ এপ্রিল লেনদেন শুরু করার পর পাঁচ কর্মদিবসের প্রতিদিনই দাম কমেছে ৩০ পয়সা করে। সর্বোচ্চ দরপতনের সীমা এখন ২ শতাংশ নির্ধারিত থাকায় এর চেয়ে বেশি কমা সম্ভব নয়। কিন্তু দাম এই পরিমাণ কমার পরও শেয়ার বিক্রি করা যাচ্ছে না, এর কারণ শেয়ার কেনার লোক নেই।
রেকর্ড ডেট শেষে প্রথম দিন ১৬ টাকায় শেয়ার বিক্রি হয়েছে ৩ লাখ ২৩ হাজারের কিছু বেশি, কিন্তু বিক্রেতা ছিল কয়েক গুণ। তার পরদিন ১৫ টাকা ৭০ পয়সায় বিক্রেতা ছিল ৪০ লাখের বেশি, কিন্তু বিক্রি হয় ২৬ হাজার ৯৮৭টি শেয়ার।
১১ এপ্রিল দাম কমে হয় ১৫ টাকা ৪০ পয়সা, সেদিন শেয়ার বিক্রি হয় ৩৪ হাজার ৭৩৮টি, ১২ এপ্রিল ১৫ টাকা ১০ পয়সায় হাতবদল হয় ৬৯ হাজার ৭৮১টি।
এই চার দিনে ১ টাকা ২০ পয়সা দর কমার কারণে বিনিয়োগকারীদের যারা লভ্যাংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাদের কারও আসলে লাভ হবে না। এর কারণ তারা লভ্যাংশ হিসেবে যে ১ টাকা ২৫ পয়সা পাবেন, তার মধ্যে যাদের টিআইএন নম্বর আছে, তাদের কাছ থেকে কর কাটা হবে ১২ দশমিক ৫০ পয়সা, আর যাদের টিআইএন নম্বর নেই, তাদের কাছ থেকে কর কাটা হবে ১৮ দশমিক ৭৫ পয়সা।
তবে লোকসান নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর ১৩ এপ্রিল দর কমে আরও ৩০ পয়সা। দাম দাঁড়িয়েছে ১৪ টাকা ৮০ পয়সা।
লভ্যাংশ নেয়ার পর শেয়ারপ্রতি লোকসান ৪০ পয়সার মতো।
পুঁজিবাজারের কোম্পানিগুলো লভ্যাংশ দেয় দুইভাবে। ১. বোনাস শেয়ার, ২. নগদ। এর মধ্যে যত শতাংশ বোনাস শেয়ার দেয়া হয়, রেকর্ড ডেটের পর তত শতাংশ দর সমন্বয় করা হয়। নগদ লভ্যাংশ শনাক্ত হয় না। তবে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে যত টাকা নগদ লভ্যাংশ দেয়া হয়, তত টাকা বা তার চেয়ে বেশি অর্থ শেয়ারদর থেকে কমে যাওয়ার প্রবণতা আছে।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে বোনাস শেয়ারের বদলে নগদ লভ্যাংশে উৎসাহ দেয়ার পাশাপাশি চাপও তৈরি করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ও সরকার। কেবল বোনাস শেয়ার দিলে কোম্পানিগুলোকে বাড়তি কর পরিশোধ করতে হচ্ছে। আবার বোনাস শেয়ার কেন দেয়া হবে, তার যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করে এর জন্য বিএসইসির কাছ থেকে আলাদা অনুমতি নিতে হচ্ছে।
এ ক্ষেত্রে ব্যাংক ছাড়া অন্য কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে একবার নগদের জন্য এবং একবার বোনাস শেয়ারের জন্য রেকর্ড ডেট দিতে হচ্ছে।
কিন্তু এভাবে নগদ লভ্যাংশেও যদি বিনিয়োগকারীর লোকসান হয়, তাহলে তারা কেন লভ্যাংশ নিতে আগ্রহী হবেন- এ বিষয়টি নিয়ে কেউ কথা বলছে না।
যত বেশি নগদ লভ্যাংশ, দরপতন তত বেশি!ডাচ্-বাংলা ব্যাংক এবার লভ্যাংশ দেবে সাড়ে ১৭ শতাংশ নগদ ও ১০ শতাংশ বোনাস। লভ্যাংশসংক্রান্ত রেকর্ড ডেট ২৮ মার্চে শেয়ার দর ছিল ৭৬ টাকা ২০ পয়সা। বোনাস সমন্বয়ের পর দর দাঁড়ায় ৬৯ টাকা ৩০ পয়সা। বর্তমান দর ৬৩ টাকা ১০ পয়সা।
অর্থাৎ বোনাস সমন্বয়ের পরও দাম কমেছে ৬ টাকা, যদিও নগদ লভ্যাংশ পাওয়া যাবে ১ টাকা ৭৫ পয়সা, যার থেকে সাড়ে ১৭ বা সোয়া ২৬ পয়সা কাটা হবে কর হিসেবে।
ব্যাংক এশিয়া ২০২১ সালের জন্য বিনিয়োগকারীদের ১৫ শতাংশ নগদ, অর্থাৎ শেয়ারপ্রতি দেড় টাকা করে বিতরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ১৬ মার্চ ব্যাংকটির পর্ষদ সভায় এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
লভ্যাংশসংক্রান্ত রেকর্ড ডেট ছিল গত ৬ এপ্রিল। দর ছিল ২০ টাকা ৬০ পয়সা। রেকর্ড ডেট শেষে দর কমার সুযোগ ছিল প্রথম দুই দিন ৪০ পয়সা করে। এরপর ২০ টাকার নিচে নেমে আসার পর দর কমার সুযোগ কমে হয় ৩০ পয়সা। পাঁচ কর্মদিবসের প্রথম দুই দিন ৪০ পয়সা করে এবং পরের তিন দিন কমে ৩০ পয়সা করে।
এরই মধ্যে কমেছে ১ টাকা ৭০ পয়সা। অর্থাৎ লভ্যাংশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া বিনিয়োগকারীর শেয়ারপ্রতি লোকসান ২০ পয়সা, সঙ্গে করের ১৫ বা সাড়ে ২২ পয়সা।
লোকসান দিয়ে বের হয়ে যাওয়াও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বিনিয়োগকারীদের জন্য এই কারণে যে, প্রতিদিনই দরপতনের প্রান্তসীমায় বসিয়েও শেয়ার বিক্রি করতে পারছে না। রেকর্ড ডেটের পর প্রথম দিন তিন খাতের বেশি শেয়ার হাতবদল হলেও এরপর এক দিন কেবল ১ হাজার ৫১০টি, আরেক দিন ১ হাজার ৪৫১টি, এক দিন ১ লাখ ৮ হাজার ৪৭৭টি, এক দিন ২৪ হাজার ৭৮০টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে।
উত্তরা ব্যাংক এবার লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে ২৮ শতাংশ, অর্ধেক বোনাস, অর্ধেক নগদে। রেকর্ড ডেট ৬ এপ্রিল দর ছিল ২৮ টাকা ৯০ পয়সা। বোনাস সমন্বয়ের পর দর দাঁড়ায় ২৫ টাকা ৪০ পয়সা। বর্তমান দর ২৩ টাকা ৩০ পয়সা।
অর্থাৎ দাম সমন্বয়ের পরও কমেছে ২ টাকা ২০ পয়সা, যদিও নগদ লভ্যাংশ মিলবে ১ টাকা ৪০ পয়সা, যার থেকে ১৪ বা ২১ পয়সা কাটা হবে কর হিসেবে।ব্র্যাংক ব্যাংক এবার লভ্যাংশ দিয়েছে ১৫ শতাংশ, যার মধ্যে নগদ ও বোনাস সমান সমান সাড়ে ৭ শতাংশ করে।
রেকর্ড ডেট ৬ এপ্রিল দর ছিল ৪৯ টাকা ৭০ পয়সা। বোনাস সমন্বয়ে দর দাঁড়ায় ৪৬ টাকা ৩০ পয়সা। বর্তমান দর ৪৫ টাকা ২০ পয়সা। অর্থাৎ দাম সমন্বয়ের পরও কমেছে আরও ১ টাকা ১০ পয়সা, যদিও নগদ লভ্যাংশ পাওয়া যাবে ৭৫ পয়সা। এ থেকে আবার ১০ বা ১৫ শতাংশ কাটা হবে কর।শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক এবার লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে ৫ শতাংশ বোনাস আর শেয়ারপ্রতি এক টাকা বা ১০ শতাংশ নগদ।
রেকর্ড ডেট ৬ এপ্রিলে ব্যাংকটির শেয়ারদর ছিল ২১ টাকা ৭০ পয়সা। বোনাস শেয়ার সমন্বয়ে দর দাঁড়ায় ২০ টাকা ৭০ পয়সা। পাঁচ কর্মদিবস পর দর দাঁড়িয়েছে ২০ টাকা ১০ পয়সা।
বহুজাতিক কোম্পানি লিনডে বিডি এবার লভ্যাংশ দেবে শেয়ার প্রতি ৫৫ টাকা। রেকর্ড ডেট ৩১ মার্চ শেয়ারদর ছিল ১ হাজার ৫৮১ টাকা ৪০ পয়সা। বর্তমান দর ১ হাজার ৪৩৮ টাকা ৬০ পয়সা। কমেছে ১৪২ টাকা ৮০ পয়সা।
অর্থাৎ যারা লভ্যাংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাদের শেয়ারপ্রতি লোকসান ৯০ টাকার বেশি।
বহুজাতিক কোম্পানি রেকিট বেনকিনজার এবার লভ্যাংশ দেবে শেয়ারপ্রতি ১৬৫ টাকা। রেকর্ড ডেট ৩ মার্চ শেয়ারদর ছিল ৫ হাজার ৩৮৮ টাকা ৪০ পয়সা। লভ্যাংশ নগদ আসায় দর সমন্বয়ের কোনো বিষয় ছিল না। তবে এখন দর কমে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ২৩৩ টাকা ৩০ পয়সা। অর্থাৎ কমেছে ১৫৫ টাকা ১০ পয়সা।
অর্থাৎ লভ্যাংশ ১৬৫ টাকা থেকে ১৬ টাকা ৫০ পয়সা বা ২৪ টাকা ৭৫ পয়সা কর কাটলে বিনিয়োগকারীর লোকসান হবে।
ডাচ্-বাংলা ব্যাংক এবার লভ্যাংশ দেবে সাড়ে ১৭ শতাংশ নগদ ও ১০ শতাংশ বোনাস। ফাইল ছবি
প্রবণতা নতুন নয়গত জুনে সমাপ্ত অর্থবছর শেষে ইউনিট মূল্যের তুলনায় দারুণ লভ্যাংশ ঘোষণা করা মিউচ্যুয়াল ফান্ডের লভ্যাংশ যারা পেয়েছেন, তাদের সবাই বেশ লোকসানে আছেন।
যেমন পপুলার লাইফ ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড। এটি ইউনিটপ্রতি গতবার ৮৫ পয়সা করে নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। রেকর্ড ডেট ১৫ সেপ্টেম্বর দাম ছিল ৭ টাকা। অর্থাৎ ইউনিট দরের ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ লভ্যাংশ হিসেবে পেয়েছেন বিনিয়োগকারীরা।
সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করলেও এত বেশি হারে মুনাফা পাওয়া যায় না। আবার মিউচ্যুয়াল ফান্ডে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত লভ্যাংশ করমুক্ত বলে প্রকৃত লভ্যাংশ আরও বেশি। কিন্তু যারা লভ্যাংশ নিয়ে ইউনিট ধরে রেখেছেন, তাদের মুখে হাসি নেই।
ইউনিট দর এখন নেমেছে ৫ টাকা ৩০ পয়সা। অর্থাৎ লভ্যাংশ বিবেচনায় নিলেও ইউনিটপ্রতি আরও ৮৫ পয়সা লোকসানে আছেন বিনিয়োগকারীরা।গত জুনে প্রায় সব কটি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের লভ্যাংশের হার ছিল সঞ্চয়পত্রের হারের চেয়ে বেশি। কিন্তু সব কটির লভ্যাংশ গ্রহণের পর ইউনিটমূল্য কমে গেছে অনেকটাই।
কী বলছেন পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্টরালোকসান হতে থাকলেও বিষয়টি নিয়ে বিনিয়োগকারী বা পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্টদের মধ্যে খুব একটা ভাবনা আছে- এমন প্রমাণও পাওয়া যায়নি।
মাসুম জামান নামে একজন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘লভ্যাংশ ঘোষণার পরে দর সমন্বয় হয়ে থাকে। ফান্ডামেন্টাল ভালো এমন কোম্পানির ক্ষেত্রে লভ্যাংশ গ্রহণের পরে শেয়ারটি ধরে রাখলে দর ফিরে পাওয়া যায়। খুব বেশি সময় লাগে না। তবে পচা শেয়ার হলে সেটা বছরও লাগতে পারে।’
পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘পুঁজিবাজার স্থিতিশীল না থাকার কারণে ভালো লভ্যাংশ ঘোষণার পরেও দর কমছে। নগদ লভ্যাংশের পরে খুব বেশি দাম কমে না। বরং ভালো লভ্যাংশ দিলে বাড়তেও দেখা যায়। বিনিয়োগকারীরা এই মুহূর্তে ক্যাপিটাল গেইন করতে পারছেন না। তবে ডিভিডেন্ড গেইন করে শেয়ারটি ধরে রাখলে আবারও দর ফিরে পাবে শেয়ারগুলো। তখন ক্যাপিটাল গেইন করতে পারবেন।’
নগদ লভ্যাংশের ক্ষেত্রে দর সমন্বয়েও বিনিয়োগকারীদের খুব বেশি লোকসান দেখছেন না পুঁজিবাজারের রশিদ ইনভেস্টমেন্ট সার্ভিসেস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আহমেদ রশিদ লালী। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নগদ অথবা বোনাস, উভয় ক্ষেত্রেই প্রাইস অ্যাডজাস্ট হয়। ক্যাশ ডিভিডেন্ড হলে কম হয়, স্টক হলে বেশি হয়। তবে কোম্পানির কোনো স্পেসিফিক গ্রোথ থাকলে দর বাড়ে, সেটা ভিন্ন বিষয়। তবে অ্যাডজাস্ট হবেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘লভ্যাংশ ঘোষণার পরে একটা বিক্রয় চাপ আসে। বোনাস শেয়ার হলে সেটা আরও বেশি হয়, তখন সমন্বয় হয়। তবে সমন্বয়ের পরে দর সেখানে থাকে না। রিগেইন হয়ে যায়। তবে আমাদের বাজারের কোনো কিছুই পূর্বানুমান করা যায় না।’