পড়াশোনা হয়নি, নেই ইতিহাসের জ্ঞানও। জানেন না, ঠিক কী কারণে কোথা থেকে শুরু হয়েছে এমন রীতি। তবুও পূর্বপুরুষদের প্রথা অনুসরণ করে প্রতি বছর ভগবানের প্রশান্তির জন্য পিঠে বড়শি বেঁধে চড়ক গাছে ঝোলেন নিতাই চন্দ্র সরকার।
৪০ বছর ধরে প্রতি বছর এই প্রার্থনায় নিজেকে সমর্পণ করে আসছেন নিতাই।
চরকপূজা আসছে বলে ব্যস্ত নিতাইয়ের দেখা পেতে ঘুরতে হয়েছে কয়েকটি গ্রাম। শেষ বিকেলে যখন দেখা হয়, তখন প্রশ্ন আসে, ‘ভয় করে না এত বড় বড়শি পিঠে গাঁথলে? ব্যথা পান না?’
হাসিমুখে তার উত্তর, ‘ঈশ্বরের ধ্যানে মগ্ন হলে এসব কিচ্ছু না; আমার কিছুই হয় না।’
নিতাইয়ের বাড়ি ঢাকার ধামরাই পৌরসভার কুলকান্দি এলাকায়। প্রতি বছরের মতো এবারও পঞ্জিকার চৈত্র সংক্রান্তিতে ধামরাইয়ের যাত্রাবাড়ী মাঠে চড়কপূজায় পিঠে বড়শি গেঁথে চরক গাছে চড়বেন নিতাই।
রীতি অনুযায়ী, এক মাস ধরে নিরামিষ খেয়ে আছেন নিতাই। চার দিন ধরে নিজের ঘরের অন্ন গ্রহণ করেননি; বন্ধ গোসলও।
পঁচিশে বৈশাখ থেকে দোলযাত্রা, শিব-পার্বতী নাচন, বাইদা নাচন ও সবশেষে বৈশাখের আগের রাতে হাজরা পূজায় অংশ নেবেন তিনি। এরপর পহেলা বৈশাখের পরের দিন হবে চড়ক গাছ প্রদক্ষিণ।
নিতাই বলেন, ‘আমার চার পুরুষ আগে থেকে এই পূজা করা শুরু হয়েছিল। বলা যায় প্রায় ২০০ বছর ধরে আমার পূর্বপুরুষরা এই অর্চনা পালন করে আসছিলেন।
‘আমার বাবা মাঝখানে করতে পারেননি, তবে আমি ১২ বছর বয়সে এই পূজা শুরু করি। ৪০ বছর ধরে প্রতি বছর এই পূজা করি।’
পূজার ইতিহাস জানতে চাইলে নিতাই হেসে বলেন, ‘অত পড়াশোনা তো জানি না। আমার পূর্বপুরুষরা হয়তো ইতিহাস বলতে পারতেন। আমার বাবাও হয়তো জানতেন, তবে আমি জানি না।
‘শুধু এটা জানি, এই পূজার সময় আমি এক আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ করি। ঈশ্বরের জন্য নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দেই, যে কারণে কোনো ব্যথা বা কিছু অনুভূতি থাকে না তখন আমার।’
কলকাতার আকাদেমি অফ ফোকলোর থেকে প্রকাশিত দুলাল চৌধুরীর ‘বাংলার লোক সংস্কৃতির বিশ্বকোষ’ থেকে জানা যায়, হিন্দু শাস্ত্রে কৃষ্ণের রাজধানী দ্বারকা। বর্তমান ভারতের গুজরাটের দ্বারকার প্রধান দ্বারকাধিশের সঙ্গে যুদ্ধে শিব উপাসক বনরাজা ক্ষতবিক্ষত হন। এরপর মহাদেব শিবের কাছে উপাসনা করে অমরত্ব লাভের জন্য নাচ-গান করেন। একই সঙ্গে নিজ শরীরের রক্ত দিয়ে শিবকে সন্তুষ্ট করেন। সেই দিনের স্মরণে এ দিনে শিব প্রীতির জন্য এ পূজা হয়।
চা দোকানি নিতাই চন্দ্র বলেন, ‘পূজার এই কয়দিন বাড়িতে খাই না; গোসল করি না। এক কাপড়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরি। সেখানেই নিরামিষ খাই শুধু। মানুষের কাছ থেকে সিধা (চাল ও অর্থ) তুলি, তবে সেটাও যার যার ইচ্ছামতো। সেসব একত্র করে পহেলা বৈশাখের পরের দিন পূজা শেষ হওয়ার পর এলাকার সবাইকে দাওয়াত করে মাছ-ভাত খাওয়াই। তারপর নিজেও আমিষ গ্রহণ করি।
‘আমি কিছু কবিরাজি চিকিৎসা করি, কিন্তু কারও কাছ থেকে কোনো অর্থ নেই না। কেউ কিছু দিতে চাইলে এই বার্ষিক অনুষ্ঠানে তাদের আসতে বলি। সেসব সহায়তাসহ সবাইকে দাওয়াত করে খাওয়াই।’
বড়শি গাঁথার পর কেমন লাগে জানতে চাইলে নিতাই বলেন, ‘পূজার এই কয়দিন ঈশ্বরের জন্য নিজেকে পুরোপুরি প্রস্তুত করি। অনেকে মনে করে, পিঠে ঘি ঢালা হয়, কিন্তু সত্যি হলো কিছুই করা হয় না। বড়শি গাঁথার আগে উপুড় করে শোয়ানো হয়।
‘তারপর একেক করে বড়শি গাঁথা হয়। সেই সময় আমার কোনো ব্যথা অনুভব হয় না। আর যে ক্ষত তৈরি হয়, সেটাও এক মাসের মধ্যে শুকিয়ে যায়।’
পিঠভর্তি বড়শি গাঁথার দাগ দেখিয়ে নিতাই চন্দ্র বলেন, ‘এই ক্ষত সারানোর জন্য কোনো গাছ-গাছন্ত খাই না। কোনো ওষুধও খাই না। এক মাসের মধ্যে একাই সেরে যায়।
‘সম্ভবত ঈশ্বর নিজেই কোনো ব্যাধি ছাড়া এটা সারিয়ে দেন। এমনকি এই কাজ করতে গিয়ে কারও কোনো সহায়তাও নেই না আমি।’
পরবর্তী প্রজন্ম এই পূজার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি যেভাবে আমার পূর্বপুরুষদের রীতিকে আঁকড়ে ধরে আছি, আমার ছেলে ও বড় ভাইয়ের ছেলেও শিখছে এসব। ভবিষ্যতে তারা এই অর্চনা পালন করবে।’
দেবাদিদেব মহাদেব শিবের মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে নিউজবাংলার প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল নিতাইয়ের। সে সময় মন্দিরের ভেতর অস্থায়ী চুলায় ফুলকো লুচি ভাজা হচ্ছিল। প্রতিবেদককে লুচি খেতে নিমন্ত্রণ জানান তিনি।
বিদায়বেলায় নিতাই বলেন, ‘৪০ বছর ধরে টানা এই পূজা করতে গিয়ে আশপাশের মুসলিমসহ সব প্রতিবেশীর কাছ থেকে সব রকম সহযোগিতা পেয়েছি। এই পূজাকে ধর্মীয় আচারের চাইতে উৎসবই বেশি মনে হয়েছে। যেখানে শুধু হিন্দুরা নয়, সব ধর্মের সব শ্রেণির মানুষ যোগ দিয়েছে।’
এ কারণে সাম্প্রদায়িক সংঘাতকে অবিশ্বাস্য লাগে তার। তিনি চান, এ দেশে ধর্ম নয়, উৎসবটাই বড় হবে। তা উদযাপন করবে সবাই মিলেমিশে।