পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রকৌশল খাতের কোম্পানি এসএস স্টিল ২০২১ সালের জন্য ১০ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করে গত ২৫ নভেম্বর। এর মধ্যে ২ শতাংশ নগদ আর ৮ শতাংশ বোনাস।
কোম্পানিটির রেকর্ড ডেট ছিল ১৫ ডিসেম্বর। পরের কর্মদিবসে দাম সমন্বয়ও হয়।
রেকর্ড ডেটে শেয়ারদর ছিল ২১ টাকা ৪০ পয়সা। ৮ শতাংশ সমন্বয়ে দাম দাঁড়ায় ১৯ টাকা ৮০ পয়সা। সেখান থেকে ২০ পয়সা কমে লেনদেন শেষ হয় ১৯ টাকা ৬০ পয়সায়।
২০ পয়সা নগদ লভ্যাংশ হিসেবে দেয়ার ঘোষণার কারণে বিনিয়োগকারীদের আসলে সেভাবে লোকসান হয়নি। তবে রেকর্ড ডেটের সাড়ে তিন মাসেরও বেশি সময় পর গত ৫ এপ্রিল সেই বোনাস শেয়ার বাতিল করে দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি।
এই সিদ্ধান্ত নেয়ার দিন শেয়ারটির দর ছিল ১৯ টাকা। এরপর তিন দিন পরপর দর পতনের সর্বোচ্চ সীমায় লেনদেন হয়ে এখন দর ১৮ টাকা ১০ পয়সা।
নগদ লভ্যাংশ আর বোনাস লভ্যাংশের জন্য পৃথক রেকর্ড ডেট কেন? বিশ্বের আর কোথাও এমন নিয়ম আছে কি না আমার জানা নেই। একবারেই দুটির অনুমোদন হতে হবে। একই রেকর্ড ডেট থাকবে। একবারই দর সমন্বয় হবে।
এক দিনে দরপতনের সর্বোচ্চ সীমা এখন ২ শতাংশ নির্ধারণ থাকায় এক দিনে শেয়ারটির দর কমার সুযোগ আছে ৩০ পয়সা। এই পরিমাণই কমেছে দর।
এখন প্রশ্ন উঠেছে, দাম সমন্বয়ের পর সেই বোনাস শেয়ার বাতিলে বিনিয়োগকারীর যে আর্থিক লোকসান হলো, তার দায় কে নেবে?
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এসএস স্টিলের কারখানা, যেটির বোনাস শেয়ারের প্রস্তাব এজিএমে পাস করার কয়েক মাস পর বাতিল করেছে বিএসইসি
পুঁজিবাজারে কোম্পানিগুলো লভ্যাংশ দেয় দুই ভাবে। প্রথমত. নগদ, দ্বিতীয়ত. বোনাস শেয়ার।
কোনো কোম্পানি তার আয় বিনিয়োগকারীর মধ্যে বিতরণ না করে তা পুনর্বিনিয়োগ করে বোনাস শেয়ার দিতে পারে। বছরের পর বছর ধরেই এভাবে বোনাস দেয়ার কারণে পরিশোধিত মূলধন তথা শেয়ারসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় কমে যেতে পারে এবং একপর্যায়ে কোম্পানির লভ্যাংশ বিতরণের সক্ষমতা কমে যেতে পারে।
এ কারণে বছর দুয়েক ধরে বিএসইসি নগদ লভ্যাংশ বিতরণে কোম্পানিগুলোকে উৎসাহী করে আসছে, পাশাপাশি বোনাস শেয়ারের যৌক্তিকতা যাচাইয়ের উদ্যোগ নিয়েছে।
কিন্তু এই যৌক্তিকতা যাচাই করতে মাসের পর মাস চলে যাচ্ছে। আর বোনাস শেয়ার অনুমোদন হলে নতুন আরেকটা রেকর্ড ডেট দেয়া হচ্ছে।
স্টক ডিভিডেন্ড যদি বাতিল করতে হয়, তাহলে সেটা ঘোষণার দু-এক দিনের মধ্যেই করতে হবে। তার ওপর বিনিয়োগকারীরা সিদ্ধান্ত নেবেন, ওই শেয়ারটি তারা রাখবেন কি না। লভ্যাংশ ঘোষণার এতদিন পর এসে তা বাতিল করা হলে যারা শেয়ারটি ধরে রেখেছিলেন তারা কী করবেন?
এ কারণে এসএস স্টিলের বিনিয়োকারীদের মতোই অন্যদেরও লোকসানের একটি প্রক্রিয়া তৈরি হয়েছে। এর কারণ বিনিয়োগকারীরা সেভাবে সচেতন নয়, প্রথম রেকর্ড ডেটেই দাম সমন্বয় হয়ে যাচ্ছে।
আবার প্রথম রেকর্ড ডেটের পর দাম সমন্বয় হলে পরে বোনাস লভ্যাংশ বাতিলের পর আবার দাম কমছে। এতে দুবার ক্ষতির মুখে পড়ছেন বিনিয়োগকারীরা।
প্রিমিয়ার সিকিউরিটিজের সাবেক প্রধান নির্বাহী সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘নগদ লভ্যাংশ আর বোনাস লভ্যাংশের জন্য পৃথক রেকর্ড ডেট কেন? বিশ্বের আর কোথাও এমন নিয়ম আছে কি না আমার জানা নেই। একবারেই দুটির অনুমোদন হতে হবে। একই রেকর্ড ডেট থাকবে। একবারই দর সমন্বয় হবে।’
তিনি বলেন, ‘এজিএমে যদি পাস হয়ে যায়, তাহলে বিএসইসি অনুমোদন দেবে না- এমন কোনো বিধান দুনিয়ার কোথাও আছে? এখন বিএসইসির আইনে কী আছে তা তো জানি না। তারা একেকবার একেক কাজ করছে।’
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, ‘লভ্যাংশের বিষয়ে একটা রেকর্ড ডেট হলেই তো ভালো হয়।’
তিনি বলেন, বোর্ড মিটিংয়ের পরেই তো পরিচালকরা বিএসইসির অনুমতি চাইতে পারেন। এরপর এজিএম হোক। সে ক্ষেত্রে রেকর্ড ডেট একটা থাকবে। তা না হলে তো বিনিয়োগকারীর লোকসান হবে।
শাকিল রিজভী মনে করেন, দুবার রেকর্ড ডেটের কারণে কারসাজিও হতে পারে। কারণ হিসেবে বলেছেন, ‘ধরুন, কোনো কোম্পানির পরিচালকরা জানেন বোনাস শেয়ার দেয়ার সক্ষমতা নেই তাদের। কিন্তু তারা ২৫ শতাংশ ঘোষণা করলেন। শেয়ারের দর বাড়ল। এরপর এসে সেটা বাতিল হয়ে গেল। লভ্যাংশ ঘোষণার পর পরিচালক বা অন্য কেউ বাড়তি দামে শেয়ার বিক্রি করে দিল। পরে বিএসইসি সেই প্রস্তাব বাতিল করল। আবার শেয়ারদর কমে গেল।’
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের কী পরিমাণ লভ্যাংশ দেবে তা আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে পরিচালনা পর্ষদের সভায় সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঘোষিত লভ্যাংশের বিষয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের জানায়।
লভ্যাংশ ঘোষণার ওপর ভিত্তি করেই বিনিয়োগকারীরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, শেয়ারটি বিক্রি করবেন নাকি ধরে রাখবেন। ঘোষিত লভ্যাংশ মনঃপুত হলে বিনিয়োগকারীরা শেয়ারটি রেকর্ড ডেট পর্যন্ত ধরে রাখেন। কারণ রেকর্ড ডেট পর্যন্ত যার পোর্টফোলিওতে ওই শেয়ার থাকবে, তিনিই লভ্যাংশের দাবিদার হবেন।
রেকর্ড ডেটের পর শেয়ারহোল্ডারদের অংশগ্রহণে হয় বার্ষিক সাধারণ সভা বা এজিএম। সেখানেই লভ্যাংশ চূড়ান্ত হয়।
শাকিল রিজভী মনে করেন, দুবার রেকর্ড ডেটের কারণে কারসাজিও হতে পারে। কারণ হিসেবে বলেছেন, ‘ধরুন, কোনো কোম্পানির পরিচালকরা জানেন বোনাস শেয়ার দেয়ার সক্ষমতা নেই তাদের। কিন্তু তারা ২৫ শতাংশ ঘোষণা করলেন। শেয়ারের দর বাড়ল। এরপর এসে সেটা বাতিল হয়ে গেল। লভ্যাংশ ঘোষণার পর পরিচালক বা অন্য কেউ বাড়তি দামে শেয়ার বিক্রি করে দিল। পরে বিএসইসি সেই প্রস্তাব বাতিল করল। আবার শেয়ারদর কমে গেল।’
বিএসইসির মুখমাত্র রেজাউল করিম নিউজবাংলাকে বলছেন, এজিএমে অনুমোদনের পর তাদের কাছে লভ্যাংশ চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়।
বিনিয়োগকারীরা বলছেন, কোনো কোম্পানি বোনাস শেয়ার দিতে পারবে কি না, সেটি লভ্যাংশ ঘোষণার আগে বা রেকর্ড ডেটের আগে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেই পারে বিএসইসি।
মেট্রো স্পিনিংয়ের বোনাস বাতিলেও দুই দফা ক্ষতি
এসএস স্টিলের আগে মেট্রো স্পিনিং ঘোষিত ৫ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ গত ৩ ফেব্রুয়ারি বাতিল করে বিএসইসি।
গত বছরের ১০ অক্টোবর লভ্যাংশ ঘোষিত হয়। এই ঘোষণা পছন্দ হয়নি বিনিয়োগকারীদের।
পর্ষদ সভার দিন শেয়ারদর ছিল ৩০ টাকা ২০ পয়সা। এর পর থেকে দর কমতে থাকে। ৮ নভেম্বর রেকর্ড ডেটে দর ছিল ২৩ টাকা ৭০ পয়সা।
৩ ফেব্রুয়ারি বোনাস লভ্যাংশ বাতিলের আগে শেয়ারদর ছিল ২৫ টাকা ৫০ পয়সা। নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিদ্ধান্ত জানানোর পর ধারাবাহিকভাবে কমে ৭ মার্চ সেটি দাঁড়ায় ২০ টাকা ৯০ পয়সায়। বর্তমান দর ২১ টাকা ২০ পয়সা।
এসএস স্টিলের আগে মেট্রো স্পিনিংয়ের বোনাস শেয়ারের প্রস্তাবও বাতিল করেছে বিএসইসি। এতেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বিনিয়োগকারীরা
কেন অনুমোদন, কেন বাতিল, কারণ জানানো হয় না
এসএস স্টিল ও মেট্রো স্পিনিংয়ের বোনাস লভ্যাংশ কেন বাতিল করা হলো, তার কোনো কারণ ব্যাখ্যা করা হয়নি ঢাকা ও চিটাগং স্টক এক্সচেঞ্জে দেয়া বিজ্ঞপ্তিতে।
তবে গত ১০ ফেব্রুয়ারি জেনেক্স ইনফোসিসের এবং ১৩ ফেব্রুয়ারি কুইন সাউথ টেক্সটাইলের ১০ শতাংশ করে বোনাস শেয়ার অনুমোদন করা হয়।
২২ ফেব্রুয়ারি সাইফ পাওয়ারটেকের প্রস্তাবিত ৬ শতাংশ ও ইন্ট্রাকো রিফুয়েলিং স্টেশনের ৮ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ অনুমোদন করে।
এরপর ৭ মার্চ আরডি ফুডের ৩ শতাংশ এবং প্যাসিফিক ডেনিমের ১ শতাংশ বোনাস শেয়ার অনুমোদন করে।
এসব লভ্যাংশ অনুমোদন কোন বিবেচনায় অনুমোদন করা হলো, তার কোনো ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি।
লভ্যাংশ ঘোষণার এতদিন পর বাতিল কেন?
পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘স্টক ডিভিডেন্ড যদি বাতিল করতে হয়, তাহলে সেটা ঘোষণার দু-এক দিনের মধ্যেই করতে হবে। তার ওপর বিনিয়োগকারীরা সিদ্ধান্ত নেবেন, ওই শেয়ারটি তারা রাখবেন কি না। লভ্যাংশ ঘোষণার এতদিন পর এসে তা বাতিল করা হলে যারা শেয়ারটি ধরে রেখেছিলেন তারা কী করবেন?
‘তারা তো লসে পড়বেন। একে তো লভ্যাংশ বাতিল করা হচ্ছে। তার ওপর লভ্যাংশ ঘোষণার কারণে তখনই প্রাইস অ্যাডজাস্ট হয়ে শেয়ারের দাম কমে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘এ রকম ভুক্তভোগী এক বিনিয়োগকারী টাঙ্গাইল থেকে আমাকে ফোন করেছিলেন। অনুনয় করে বলেছেন, যে আমরা কিছু করি।’
কী বলছে বিএসইসি
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কোনো কোনো কোম্পানির ক্ষেত্রে বোনাস অনুমোদন করা হয় না। কারণ দেখা গেছে, কোম্পানি শুধু বোনাসই দিয়ে গেছে। পেইডআপ বাড়াচ্ছে। ডাইলুটেড হয়ে হয়ে ইপিএস কমবে। এই সময়ে বোনাস বিক্রি করে করে টাকা নিয়ে যাবে। একসময় গিয়ে লস দেখাবে। এতে বিনিয়োগকারীরা লাভবান হতে পারবেন না।’
বোনাস দিতে পারবে না এমন কোম্পানিকে কেন আগেই সতর্ক করা হয় না- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এটা আগে বলা যায় কীভাবে, ডিভিডেন্ড কত দেবে না দেবে সেটা আগেই জেনে গেলে ইনসাইডারের ঝামেলা হবে না?’
তিনি বলেন, ‘কমিশন লভ্যাংশ অনুমোদন না করলে আবারও রেকর্ড ডেট দিতে হবে। স্টকের ক্ষেত্রে রেকর্ড ডেট সেকেন্ড টাইম দিতে হয়। ভবিষ্যতে অ্যাক্টে কোনো পরিবর্তন আসে তাহলে সেভাবে হবে।’