বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বাইক চুরি: বগুড়ায় মামলা না নেয়ার কারণ কী?

  •    
  • ১২ এপ্রিল, ২০২২ ২২:০৬

বাইক চুরির শিকার জাহিদ বলেন, ‘একটি মোটরসাইকেল কেনার সময় সরকারকে ভ্যাট, ট্যাক্স পরিশোধ করা হয়। আবার রাষ্ট্রীয় কোষাগারে অর্থ দিয়ে নিবন্ধন করছে মোটরসাইকেল মালিক। যখন একটি মোটরসাইকেল চুরি হয়, তাতে কারও কি দায় থাকবে না?’

নিজ বাসার সামনে থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি বগুড়া শহরের মালতিনগরের বাসিন্দা জাহিদ হাসানের মোটরসাইকেলটি চুরি হয়ে যায়। এখনও কোনো সন্ধান মেলেনি।

পেশায় ঠিকাদার জাহিদের আক্ষেপ, মামলা করতে চাইলে তাও নেয়নি পুলিশ। পরে চুরির ঘটনায় থানায় সাধারণ ডায়েরি করতে বাধ্য হন তিনি। দাবি করেছেন, অভিযোগে অজ্ঞাত ব্যক্তির নাম উল্লেখ থাকায় চুরির মামলা নেয়নি থানা পুলিশ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুধু শহরের মালতিনগর এলাকাতেই দুই মাসে (ফেব্রুয়ারি-মার্চ) অন্তত পাঁচটি মোটরসাইকেল চুরি হয়েছে। একটিরও খোঁজ মেলেনি।

এদিকে বগুড়া সদর থানা পুলিশের দাবি, সদর উপজেলা মিলে চলতি বছরে মাত্র ১০টি বাইক চুরি হয়েছে। চুরির ঘটনা স্বীকার করলেও এক্ষেত্রে মামলা নথিভুক্ত করার কোনো রেকর্ড দেখাতে পারেনি তারা। বাইকগুলো উদ্ধারেও তেমন কোনো তৎপরতা নেই।

পুলিশ বলছে, বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেল চুরির সিসি ফুটেজ তারা পেয়েছেন। কিন্তু কাউকে শনাক্ত করা যায়নি। বাইরের চোর চক্র বগুড়ায় এসে মোটরসাইকেল চুরি করে চলে যাচ্ছে বলেই কাউকে ধরা সম্ভব হচ্ছে না, দাবি তাদের।

বাইক চুরির শিকার জাহিদ হাসানের ভাষ্য, যদি চুরি হয়, তবে মামলা কেন হবে না? আর মামলা যদি না নেয়, তবে এর প্রতিকার কী?

জাহিদ বলেন, ‘একটি মোটরসাইকেল কেনার সময় সরকারকে ভ্যাট, ট্যাক্স পরিশোধ করা হয়। আবার রাষ্ট্রীয় কোষাগারে অর্থ দিয়ে নিবন্ধন করছে মোটরসাইকেল মালিক। যখন একটি মোটরসাইকেল চুরি হয়, তাতে কারও কি দায় থাকবে না?’

জাহিদের ধারণা, তার মোটরসাইকেল চোর অন্য কোনো জেলায় নিয়ে বিক্রি করেছে। সেটি কিনে আরেক মানুষ ব্যবহার করছে। কিন্তু মামলা না থাকার কারণে এটি শনাক্তের কোনো চিহ্ন থাকছে না।

মালতিনগরের আরেক বাসিন্দা পরিবহন ব্যবসায়ী মোহাম্মদ রিপন জাহিদের প্রতিবেশী। গত ১৯ মার্চ তার বাড়ির সামনে থেকেও মোটরসাইকেল চুরি হয়। মোটরসাইকেলটির মালিক রিপনের জামাই একরামুল বিন নাছির। তিনি বগুড়ার রাডার স্টেশনে চাকরি করেন।

এই চুরির পর সিসি ফুটেজ সংগ্রহ করেন রিপন। সেগুলো পুলিশকে দিয়েছেন। কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি।

রিপন জানান, তাকেও থানায় অভিযোগ করতে গিয়ে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। অনেকটা ‘জোর জবরদস্তি’ করার পর পুলিশ অভিযোগ নিয়েছে।

রিপন বলেন, ‘দুই সপ্তাহের ব্যবধানে আমার জামাইয়েরটা নিয়ে এলাকায় অন্তত চারটি মোটরসাইকেল চুরি হয়েছে। থানায় মামলা করতে গেলেও তারা নিতে চান না। কেন মামলা নেয় না তাও ঠিক করে বলে না পুলিশ!’

তিনি আক্ষেপ করে আরও বলেন, ‘শহরে চোর ঘুরছে। কিন্তু সেটি নিয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো মাথাব্যথা নেই। মামলা দিতে চাইলে নেয় না। জিডি করলে তার অগ্রগতি জানা যায় না। তাহলে নাগরিক হিসেবে আমাদের নিরাপত্তা কোথায়?’

খোঁজ করতে গিয়ে আরও একজনের বাইক চুরির খবর পাওয়া যায়। ওই ব্যক্তির নাম আব্দুর রশিদ। বগুড়া শহরের ঠনঠনিয়া এলাকার বাসিন্দা। চাকরি করেন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগে।

গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ঠনঠনিয়া ভাই পাগলার মাজার মসজিদ থেকে রশিদের বাইকটি চুরি হয়। সেদিন ছিল শুক্রবার। শুক্রবার জুম্মার নামাজ পড়ার সময় আব্দুর রশিদ বাইকটি মসজিদের সীমানার ভেতরেই রাখেন। কিন্তু নামাজ শেষে দেখেন, এটি নেই!

থানায় গেলে পুলিশ আব্দুর রশিদকে আগে ঘটনাস্থলে যেতে বলেন। সেখানে এক কর্মকর্তা উপস্থিত হয়ে বিস্তারিত দেখে তাকে চলে যেতে বলেন। কিন্তু তিনি আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কথা বললে তখন থানায় যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা।

থানায় গেলে সেই একই কাহিনী। পুলিশ মামলা নিতে চায়নি। এক পর্যায়ে রশিদকে সাধারণ ডায়েরি করতে বলা হয়। পরে জিডি করলেও তার কোনো ফল আসেনি।

আব্দুর রশিদ বলেন, ‘মোটরসাইকেল পাওয়ার আশা আমি এখনও করি না। তবে আমার মোটরসাইকেল ব্যবহার করে যদি কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়, তখন আমাকেই দায়ী করা হবে। সেই বিষয়টি মাথায় রেখেই জিডি করেছি।’

তবে রশিদের বাইক চুরির ঘটনা জিডি করেই শেষ হয়নি। জিডি করে থানা থেকে বের হয়ে আধা কিলোমিটার পথ আসার পরই ঘটে আরেক ঘটনা।

রশিদ বলেন, ‘থানা থেকে বের হয়ে মফিজ পাগলার মোড়ে আসতেই আমার মোবাইলে একজন কল দেন। রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে আমার মোটরসাইকেলের নম্বর উল্লেখ করে বলেন, গাড়ি ফেরত চাই কি না। আমি যখন বললাম- ফেরত তো অবশ্যই চাই।

‘এ কথা শুনে মোবাইলের অপর পাশের ব্যক্তি ২৫ হাজার টাকা দাবি করেন। কিন্তু মোটরসাইকেল ফেরত পাওয়ার পর টাকা দেব বলতেই সম্ভব না বলে লাইন কেটে দেন সেই ব্যক্তি।’

বিষয়টি তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশকে জানান আব্দুর রশিদ। পুলিশের পরামর্শে ওই নম্বরে তিনি নিজেই কল দেন। দিয়ে বাইকের ছবি চান। কিন্তু সেটিও সম্ভব নয় বলে কল কেটে দেন অপরিচিত ফোনদাতা।

আব্দুর রশিদ বলেন, ‘নম্বরটি ট্র্যাক করলে সিমকার্ডের মালিকের ঠিকানা রংপুর দেখায়। এরপর আর তার সঙ্গে কথা হয়নি।’

ক্ষতিগ্রস্ত এই তিন ব্যক্তির মোটরসাইকেল চুরির তদন্তের দায়িত্বে রয়েছেন বনানী ফাঁড়ির এসআই সাজ্জাদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘চুরির ঘটনায় আমরা সিসি ফুটেজ সংগ্রহ করেছি। সেগুলোতে যাদের দেখা গেছে; খোঁজ খবর করছি। কিন্তু কাউকে শনাক্ত করা যাচ্ছে না।’

এ কয়টি ঘটনা ছাড়াও শহরের মফিজ পাগলার মোড়ে ফেব্রুয়ারি মাসে মোটরসাইকেল চুরির খবর পাওয়া যায়। এ ছাড়াও মার্চ মাসে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দুটি মোটরসাইকেল চুরি হয়। ১০ এপ্রিল আদালত চত্বর থেকে মোস্তাফিজুর রহমান নামে এক আইনজীবীর মোটরসাইকেল চুরি হয়। এই চুরির সিসিটিভি ফুজেটও রয়েছে।

বগুড়া সদর থানায় মোটরসাইকেল চুরির পূর্ণাঙ্গ পরিসংখ্যান নেই বলে দাবি ওসি সেলিম রেজার। গত তিন মাসে ১০টি মোটরসাইকেল চুরির জিডি ও অভিযোগ পেয়েছে বলে জানান তিনি। তবে বাস্তবে এ সংখ্যাটি আরও অনেক বেশি বলে দাবি করছেন শহরের বাসিন্দারা। তাদের মতে, অনেকে চুরির পর থানায় অভিযোগ দেন না। এ জন্য মোটরসাইকেল চুরির সঠিক হিসাব পাওয়া দুষ্কর।

মামলা না নেয়ার বিষয়ে ওসি বলেন, ‘সাধারণত এমন হওয়ার কথা নয়। থানায় কেউ মামলা করতে আসলে সেটি গুরুত্ব নিয়ে গ্রহণ করার নির্দেশ দেয়া আছে।’

বগুড়ার এক থানার সাবেক ওসি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘মোটরসাইকেল চুরি তো হয়-ই। কিন্তু পুলিশ এটি মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করতে চায় না। কারণ চুরির মামলা বেশি হলে সংশ্লিষ্ট এলাকার আইন শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি প্রকাশ পায়। এই দায় পুলিশ এড়াতে চায়।’

এদিকে সদর থানা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, সাধারণত মোটরসাইকেল চুরি করে সোনাতলা উপজেলা হয়ে বাইরের জেলায় চলে যায় চোরচক্র। এ ছাড়া শিবগঞ্জ বা দুপচাঁচিয়া উপজেলা হয়ে চোরেরা জয়পুরহাটের হিলির দিকেও যায় বলে দাবি করেন তারা। কিন্তু জেলায় এই চোরচক্রের আশ্রয় বা মদদদাতা কারা সে বিষয়ে কিছু জানাতে পারেনি পুলিশ।

জানতে চাইলে মোটরসাইকেল হারানোর ঘটনায় মামলার পাশাপাশি উদ্ধারও হয় বলে দাবি করেন জেলা পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী। তবে বগুড়া সদর প্রায় গত এক বছরে মোটরসাইকেল উদ্ধার হওয়ার কোনো খবর নেই।

পুলিশ সুপার বলেন, ‘মোটরসাইকেল হারিয়ে গেলে থানায় মামলা করতে হবে। শুধু মামলা করলেই হবে না, তা উদ্ধার করতে হবে। রাজশাহীতে রেঞ্জ মিটিংয়ে এসব নিয়ে কথা হয়েছে। মাসিক অপরাধ সভায়ও আলোচনা করা হয়।

‘প্রত্যেক থানায় মোটরসাইকেল চুরির ঘটনায় বিশেষ গুরুত্ব দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি পুলিশের গোয়েন্দা শাখার একটি টিমকে এ কাজে নিয়োজিত করা হচ্ছে।’

এ বিভাগের আরো খবর