শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের মতো ‘দুর্বল’ অর্থনীতির দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনাকে লজ্জাজনক বলে মনে করে সরকার।
মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দুপুরে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব আহমদ কায়কাউস।
এর আগে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তিন ঘণ্টার বৈঠক করে রাজস্ব ও অর্থ বিভাগ। ওই সময় শ্রীলঙ্কার সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর সামনে একটি প্রেজেন্টেশন তুলে ধরা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) যোগ করলে যা হয়, বাংলাদেশের জিডিপি তার সমান। ওই দুই দেশের রিজার্ভ যোগ করলে যা হয়, বাংলাদেশের রিজার্ভ তার দ্বিগুণ।
সাংবাদিকদের কায়কাউস বলেন, ‘যারা বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনা করেন, তারা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে হেয় করেন। এটা খুবই লজ্জাজনক। বাংলাদেশের শ্রীলঙ্কা হওয়ার কোনো কারণ নেই। অর্থনীতির সব সূচকেই আমরা খুবই ভালো অবস্থায় আছে।’
ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। দুই কোটি জনসংখ্যার দেশটির অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ার পর তাদের বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধই শুধু অনিশ্চয়তায় পড়েনি, নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক সংকট।
- আরও পড়ুন: শ্রীলঙ্কার ভুলের একটিও নেই বাংলাদেশের
দেশটির জনগণ যখন সরকারের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠছে, তখন বাংলাদেশে কথা উঠেছে, এই দেশের সামনেও এমন আশঙ্কা আছে কি না।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস
তবে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন ও অর্থনীতির বিশ্লেষকরা ভারত মহাসাগরের দ্বীপ রাষ্ট্রটির বিপর্যয়ের যেসব কারণ তুলে ধরছেন, সেগুলো বিবেচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকিগুলো সেভাবে নেই।
শ্রীলঙ্কা যেসব কারণে বিপর্যয়ে পড়েছে, তার একটি কারণও বাংলাদেশের নেই। দেশটির বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে উঠে এসেছে করোনার কারণে পর্যটন খাত মুখ থুবড়ে পড়া। দেশটির জিডিপির ১০ শতাংশের বেশি আয় হতো এই খাত থেকেই। দুই বছর ধরেই প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে তা।
এ ছাড়া করোনার সময় রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স কমে গেছে। অর্গানিক কৃষি চালু করতে গিয়ে উৎপাদন কমে গেছে।
এর মধ্যেও নানা মেগা প্রকল্পের জন্য নেয়া বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে ভীষণ চাপে পড়েছে রিজার্ভ। এটি নেমে এসেছে দুই বিলিয়ন ডলারে। চলতি বছর যে কিস্তি পরিশোধ করতে হবে, সে পরিমাণ বিদেশি মুদ্রাও নেই দেশটির।
অন্যদিকে করোনায় বাংলাদেশের রিজার্ভ, রেমিট্যান্স ও রপ্তানির গতি ঊর্ধ্বমুখী। কৃষি উৎপাদন বেড়েছে। পর্যটননির্ভরতা নেই বাংলাদেশের, অন্যদিকে বাংলাদেশের নেয়া মেগা প্রকল্পগুলো অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে না, এমন কোনো বক্তব্য অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা কখনও বলেননি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এরই মধ্যে বলেছেন, বাংলাদেশের শ্রীলঙ্কার পরিণতি হওয়ার কোনো কারণ নেই। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবিও একই মূল্যায়ন করে বলেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক শক্তিশালী।
- আরও পড়ুন: শ্রীলঙ্কার মতো হবে না বাংলাদেশ: এডিবি
দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে কায়কাউস বলেন, ‘বাংলাদেশ এমন জায়গায় পৌঁছেছে, তাতে আমরা শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তানের মতো দুর্বল দেশের সঙ্গে তুলনা করতে চাই না। ইউরোপ-আমেরিকার সঙ্গে তুলনা করতে চাই।’
বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তানের অর্থনীতির যোগফলের সমান বলেও তথ্য দেন মুখ্যসচিব।
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, অর্থসচিব, ইআরডি সচিবসহ সংশ্লিষ্টরা।
যেসব কারণে বাংলাদেশের শ্রীলঙ্কা হওয়ার কোনো কারণ নেই
বাংলাদেশ কেনো শ্রীলঙ্কা হবে না-তার পক্ষে যুক্তি ও তথ্য উপাত্ত তুলে ধরে অর্থসচিব রউফ তালুকদার বলেন, “গত ১৩ বছরে বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় আছে। তার সুফল অর্থনীতি পাচ্ছে। আমাদের অর্থনীতির ‘থ্রি আর’ আরএমজি, (তৈরি পোশাক), রেমিট্যান্স এবং রাইস (চাল বা ধান) চমক দেখিয়ে চলেছে। বছরের পর বছর ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। তৈরি পোশাকের রপ্তানি বেড়েছে ৪০ শতাংশ। রেমিট্যান্সও ইতিবাচক ধারায় আছে। এই তিন খাতেই শ্রীলঙ্কা নাজুক অবস্থায় আছে, সংকটে আছে। সে কারণেই তাদের এই বিপদ এসেছে।”
তিনি বলেন, ‘মহামারি করোনার ধাক্কা দ্রুত কাটিয়ে উঠেছি আমরা। পৃথিবীর অনেক দেশই তা বাড়েনি। গত অর্থবছরে আমরা ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত করেছি। চলতি অর্থবছরে ৭ দশমিক ২ শতাংশের বেশি অর্জিত হবে। রাজস্ব আদায়ে ১৫ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়ে ১১ শতাংশে উঠেছে।
‘সবমিলিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্ত মজবুত ভিক্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেদশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় আছে বাংলাদেশের অর্থনীতি।’
ইআরডি সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বলেন, ‘আমাদের বিদেশি ঋণ জিডিপির ১২ শতাংশ; আর শ্রীলঙ্কার ৪৮ শতাংশ। আমাদের ঋণের সুদের হার মাত্র ১ দশমিক ৪ শতাংশ। শ্রীলঙ্কার ১২ শতাংশ। শ্রীলঙ্কার বিদেশি ঋণের পরিমাণ ৩৫ বিলিয়ন ডলার। আমাদের ৫০ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের ঋণ ঝুঁকিমুক্ত। শ্রীলঙ্কাকে প্রতি বছর সুদ-আসল বাবদ ৭ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হয়। আমাদের করতে হয় আড়াই বিলিয়ন ডলার।
‘আরেকটি বিষয় হচ্ছে, আমাদের কোনো সভরেন বন্ড ঋণ নেই, বাণিজ্যিক ঋণ নেই। আমাদের ঋণ পরিশোধ নিয়ে কোনো ঝুঁকি নেই। আগামী ১০ বছর ঋণ পরিশোধে কোনো সমস্যা নেই বাংলাদেশের। অথচ শ্রীলঙ্কার এক কিস্তি শোধ করারও ক্ষমতা নেই।’
এক প্রশ্নের উত্তরে মুখ্যসচিব আহমদ কায়কাউস বলেন, ‘চীনের সঙ্গে আমাদের কোনো বিলাসিতামূলক প্রকল্প নেয়া হয়নি। আমাদের সব প্রকল্পই জনস্বার্থমুখী; সবার জন্য। এ সব প্রকল্প থেকে দ্রুত রিটার্ন আসবে।’
হায় হায় রব আগেও ছিল
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব বলেন, ‘এই দেশের এক শ্রেণির মানুষ এক যুগ আগে থেকে হায় হায় রব তুলছে। তারা বলে আসছে বিদুৎ সমস্যার সমাধান হবে না, পদ্মা সেতু হবে না, ডিজিটাল বাংলাদেশ শুধু স্লোগান, বৃহৎ বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে না। কিন্তু বাস্তবে কী হয়েছে? এ সব কিছুই আশ দৃশ্যমান। শতভাগ বিদ্যুৎ আজ দেশে। পদ্মা সেতুর কাজ শেষ, বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ বাস্তবতা।
‘তারা যে ভুল বলেছিল, তা আজ প্রমাণিত হয়েছে। সেই লোকগুলোই এখন বলছে, বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যাবে। আগের মতোই কোনো কিছু না বুঝেই তারা এমন গুজব ছড়াচ্ছে। এই সংবাদ সম্মেলন থেকে আমরা জোর দিয়ে বলছি, বাংলাদেশের শ্রীলঙ্কা হওয়ার প্রশ্নই আসে না। বাংলাদেশের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার তুলনা করার কোনো কারণ নেই। সব দিক দিয়েই আমাদের অর্থনীতি মজবুত অবস্থায় আছে।’