নওগাঁর মহাদেবপুরের দাউল বারবাকপুর উচ্চবিদ্যালয়ে ছাত্রীদের পিটুনির সঙ্গে হিজাবের কোনো সম্পর্ক খুঁজে পায়নি তদন্ত কমিটি।
তবে স্কুলড্রেস না পরায় শিক্ষার্থীদের বেত্রাঘাত করার কারণে আমোদিনীসহ দুই শিক্ষকের শাস্তির সুপারিশ করেছে কমিটি।
এ ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসনের গঠন করা তদন্ত কমিটি সোমবার সন্ধ্যায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
- আরও পড়ুন: নওগাঁর স্কুলে ‘হিজাব বিতর্কের’ পেছনে কী?
এতে বলা হয়, স্কুলটিতে শিক্ষার্থীদের পিটুনি দেয়া হয়েছিল নির্ধারিত পোশাক না পরায়। এই ঘটনায় হিজাব বিতর্কের অন্তরালে স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির দ্বন্দ্ব ও শিক্ষকদের মধ্যকার বিরোধই এ ঘটনার মূল কারণ বলেও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
যা ঘটেছিল
উপজেলার দাউল বারবাকপুর উচ্চবিদ্যালয়ের কয়েকজন মেয়ে শিক্ষার্থী ফেসবুকে ‘হিজাব পরায়’ পিটুনির অভিযোগ এনে ফেসবুকে ভিডিও প্রকাশ করে। এরপর আরও কিছু ভিডিও আসে। পাশাপাশি বেশ কিছু অনলাইন সংবাদ মাধ্যম বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
সংবেদনশীল এই ঘটনাটি মুহূর্তেই দেশজুড়ে তোলপাড় তৈরি করে। তবে নিউজবাংলা নানা পক্ষের সঙ্গে কথা বলে সেদিনই সংবাদ প্রকাশ করে যে, পিটুনির সঙ্গে হিজাব পরা বা না পরার কোনো সম্পর্কই ছিল না।
দাউল বারবাকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আমোদিনী পাল। ছবি: সংগৃহীত
যারা পিটুনি খেয়েছে, শিক্ষক, অভিভাবক এবং প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বক্তব্যে উঠে আসে, সেদিন যারা স্কুলের ড্রেস পরে আসেনি, তাদের সবাইকেই বেত্রাঘাত করা হয়েছে। যাদেরকে পিটুনি দেয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে ছেলে শিক্ষার্থী ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীও ছিলেন।
কয়েকজন মেয়ে শিক্ষার্থীর ফেসবুকে এমন বয়ানের পেছনে বিশেষ উদ্দেশ্যের সন্দেহও উঠে আসে নানা জনের বয়ানে।
নিউজবাংলার অনুসন্ধানে উঠে আসে যে, হিজাব বিতর্ক তৈরির নেপথ্যে শিক্ষকদের মধ্যকার দ্বন্দ্বও দায়ী।
কয়েকজন মেয়ে অভিযোগ করেছিলেন, তাদেরকে পিটিয়েছেন অমোদিনী পাল নামে এক শিক্ষিকা।
আমোদিনী পালকে ‘ফাঁসানোর’ কারণ কী হতে পারে সে বিষয়েও অনুসন্ধান করেছে নিউজবাংলা। বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক ও এলাকাবাসীর অভিযোগ, সহকারী প্রধান শিক্ষক আমোদিনীকে ফাঁসাতেই পরিকল্পনা করে হিজাবের ইস্যু তৈরি করা হয়। এই পরিকল্পনায় বর্তমান প্রধান শিক্ষকসহ তার ঘনিষ্ঠ শিক্ষক রবিউল ইসলাম ও অ্যাডহক ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের দায়ী করছেন তারা।
স্কুলটির প্রধান শিক্ষক ধরণী কান্ত বর্মণের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ১০ মে। নিয়ম অনুযায়ী, এরপর আমোদিনী পালের এই পদে আসার কথা। অভিযোগ উঠেছে, ধরণী কান্ত বর্মণ তার ঘনিষ্ঠ শিক্ষক রবিউল ইসলামকে পরবর্তী প্রধান শিক্ষক করতে চান। এ জন্য আমোদিনী পালকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলেছে।
তদন্ত কমিটি যা বলছে
মেয়েদের অভিযোগের পর তোলপাড়ের মধ্যেই স্কুলটিতে হামলার ঘটনা ঘটে। এরপর আসলে কী ঘটেছিল, তা বের করতে গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি।
দায়িত্ব দেয়া হয়, উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আব্দুল মালেক, উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আরিফ প্রামাণিক এবং উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হাবিবুর রহমানকে।
সোমবার রাত ৮টার দিকে তদন্ত কমিটি মহাদেবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিজানুর রহমানের কাছে সেই কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়।
বিষয়টি নিউজবাংলাকে নিশ্চিত করে ইউএনও নিজেই। প্রতিবেদনে কী বলা হয়েছে, সে বিষয়ে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘স্কুল ড্রেস না পড়ার কারণে স্কুলের কয়েকজন শিক্ষার্থীকে দুই শিক্ষক বেত্রাঘাত করেন। তাদের মধ্যে হিন্দু ছাত্রী ও ছেলে শিক্ষার্থীও ছিল। হিজাব পরার কারণে শিক্ষার্থীদের মারধর করা হয়েছে, এমন তথ্য তদন্ত প্রতিবেদনে পাওয়া যায়নি।’
নেপথ্যে শিক্ষকদের বিভেদ
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে ইউএনও মিজানুর রহমান বলেন, ‘স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি ও হিসাব নিয়ে দ্বন্দ্ব চলে আসছিল দীর্ঘদিন থেকে। আর শিক্ষকদের মাঝে রয়েছে একাধিক গ্রুপ। প্রধান শিক্ষক স্কুলের আয় ব্যয়ের হিসাব সঠিকভাবে দিচ্ছিল না। যার কারণে স্কুলের শিক্ষকদের মাঝে এ নিয়ে মনোমালিন্য ছিল।
‘আর স্কুলের নতুন কমিটি নিয়ে শিক্ষকদের মাঝে দুই গ্রুপ ছিল। কিছু শিক্ষক নতুন কমিটির পক্ষে আবার কিছু শিক্ষক নতুন কমিটির বিপক্ষে ছিল।’
এই বিষয়টি নিয়ে এর বাইরে কিছু বলতে রাজি হননি ইউএনও।
পিটুনি দেয়ায় শাস্তির সুপারিশ
তদন্ত কমিটি এই পিটুনিকেও কোনোভাবে সমর্থন করছে না বলে জানান ইউএনও। তিনি বলেন, ‘স্কুলে শিক্ষার্থীদের গায়ে হাত তোলার তো নিয়ম নেই।’
তাহলে পিটুনির ঘটনায় কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে কি না- জানতে চাইলে ইউএনও বলেন, ‘যে দুই শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রীদের বেত্রাঘাত করেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।’
ছাত্রীদের হিজাব সংক্রান্ত অভিযোগ ফেসবুকে আসার পর স্কুলটিতে স্থানীয়রা হামলা করে ভাঙচুরও করা হয।
এ বিষয়ে ইউএনও বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার স্কুলে হামলা ও ভাঙচুর এর ঘটনা ঘটেছে হিজাব ইস্যুকে কেন্দ্র করে, যা খুবই দুঃখজনক।
‘এ ঘটনায় গতকাল (রোববার) সন্ধ্যার দিকে স্কুলের প্রধান শিক্ষক ধরনী কান্ত বর্মন থানায় জিডি করেছেন। আইন অনুযায়ী সেটির বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
আগামীতে যাতে কেউ গুজব ছড়িয়ে শান্তি বিনষ্ট না করে, সে জন্য সবাইকে আরও সচেতন থাকারও আহ্বান জানান ইউএনও মিজানুর রহমান।