প্রতি বছরই নির্মাণ করা হয় হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ। প্রতি বছরই এ কাজে অনিয়ম ও গাফিলতির অভিযোগ ওঠে। উজান থেকে ঢলও নামে প্রতি বছর। বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যায় হাওরের ফসল। যে বছর বৃষ্টিপাত ও ঢল বেশি হয়, সে বছর ফসলের ক্ষতিও হয় বেশি।
হাওরের কৃষক, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নেতা, প্রশাসনের কর্মকর্তা আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাঁধের কাজে অনিয়ম ও গাফিলতি কমলে ফসল কিছুটা রক্ষা পাবে। তবে ঢল বেশি হলে কেবল বাঁধ নিয়ে এখন আর ফসল রক্ষা করা যাবে না।
তাদের মতে, এ অঞ্চলের সবগুলো নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। এতে অল্প ঢলে নদী উপচে পানি হাওরে প্রবেশ করছে। হাওরের ফসল রক্ষায় তাই ব্যাপক আকারে নদী খনন প্রয়োজন।
শুক্রবার সুনামগঞ্জে হাওরের ফসলহানি দেখতে গিয়ে প্রাণিসম্পদ উপমন্ত্রীও ফসল রক্ষায় নদী খননের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন।
দেশের সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ১৪ হাজার ৫৩৬ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে হাওরাঞ্চল বিস্তৃত। ৪১৪টি হাওর আছে এই অঞ্চলে। আর এসব হাওরের মধ্য দিয়েই প্রবাহিত হয়েছে মেঘনা, সুরমা, কুশিয়ারা, যাদুকাটা, পিয়াইন, বউলাই, কাতলাই, সোমেশ্বরী, খোয়াইসহ অন্তত ১৪টি নদী। তলদেশ ভরাট হয়ে সবগুলো নদীই এখন নাব্য হারিয়েছে। ফলে অল্প বৃষ্টি বা ঢলেই নদী উপচে আশপাশের এলাকায় পানি ছড়িয়ে পড়ছে।
পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে নেমে আসা বালুতে নাব্য হারাচ্ছে হাওরের মাঝখান দিয়ে যাওয়া নদীগুলো
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, এবার হাওরের সাতটি জেলায় মোট ৯ লাখ ৫০ হাজার ৪০৬ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে গত কয়েক দিনের বৃষ্টি ও ঢলে তলিয়ে গেছে অন্তত ১০ হাজার হেক্টর জমির ফসল।
বাঁধ সংস্কার, বাঁধে ভাঙন
বছরের বেশির ভাগ সময়ই পানির নিচে থাকে হাওর। ফলে শুকনো মৌসুমে বছরে একবারই এখানে ফসল হয়। রোপণ করা হয় বোরো ধান। তবে ধান পাকার আগেই মার্চের দিকে শুরু হয় বৃষ্টি।
হাওরাঞ্চলের ওপারেই মেঘালয়ের পাহাড়ি অঞ্চল। এশিয়ার সবচেয়ে বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা চেরাপুঞ্জির অবস্থান সেই অঞ্চলেই। মার্চ-এপ্রিলের দিকে ওই এলাকায় প্রচুর বৃষ্টি হয়। ফলে ঢল নামে। এই ঢল গড়িয়ে নামে হাওরের নদীগুলো দিয়ে। এতে দেখা দেয় আগাম বন্যা। হাওরে প্রবেশ করে বন্যার পানি। তলিয়ে যায় ফসল।
আগাম বন্যার হাত থেকে হাওরের বোরো ফসল রক্ষায় ষাটের দশকে নির্মাণ করা হয় ফসলরক্ষা বাঁধ। এই বাঁধগুলো নদীর পানি হাওরে ঢুকতে দেয় না। ফলে রক্ষা পায় বোরো ফসল। প্রতি বছরই এসব বাঁধ সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ করা হয়। তবে প্রায় প্রতি বছরই পাহাড়ি ঢলে হাওরের বাঁধে ভাঙন দেখা দেয়।
হাওর নিয়ে কাজ করা একটি বেসরকারি সংস্থা বলছে, ১৯৯৯ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত অকালবন্যায় বাঁধ ভেঙে হাওরের প্রায় ৫৮৭ কোটি ১২ লাখ ২৮ হাজার টাকার বোরো ফসলের ক্ষতি হয়েছে।
তবে বাঁধ ভেঙে সবচেয়ে বড় ফসলহানির ঘটনা ঘটে ২০১৭ সালে। সরকারি হিসাবেই ওই বছর বাঁধ ভেঙে সুনামগঞ্জের ১৫৪টি হাওরের ২ লাখ ২৩ হাজার ৮২ হেক্টর জমির বোরো ফসল তলিয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১ লাখ ৬১ হাজার হেক্টর জমির ফসল। তবে কৃষকদের হিসাবে এই ক্ষতির পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ।
এ বছরও ঢলে বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। দেশের মধ্যে সবেচেয় বেশি হাওর রয়েছে সুনামগঞ্জে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও এ জেলায় সবচেয়ে বেশি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, এ বছর সুনামগঞ্জে ১২৪টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) মাধ্যমে ৫৩২ দশমিক ৩৯ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১২৪ কোটি টাকা।
গত এক সপ্তাহে ঢল ও বৃষ্টিতে সুনামগঞ্জের অন্তত ১০টি বাঁধে ভাঙন ও ফাটল দেখা দিয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, এ পর্যন্ত সুনামগঞ্জে তলিয়ে গেছে প্রায় পাঁচ হাজার হেক্টর জমির ধান। আর হাওরের সাত জেলা মিলে তলিয়েছে ১০ হাজার হেক্টর।
এবার সুনামগঞ্জে ১২৪টি পিআইসির মাধ্যমে ৫৩২ দশমিক ৩৯ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সুনামগঞ্জের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, ‘শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত অকালবন্যায় সুনামগঞ্জের ৪ হাজার ৯০০ হেক্টর জমির ধান তলিয়ে গেছে। পানি বাড়লে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে।’
বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ
প্রতি বছরই বাঁধ নির্মাণ নিয়ে অনিয়ম ও গাফিলতির অভিযোগ ওঠে। ২০১৭ সালে ফসলহানির পর অনিয়মের বিষয়টি সবচেয়ে আলোচনায় আসে। বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতি করা ঠিকাদারদের চিহ্নিত করে মামলাও করে দুদক।
ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভ ও অভিযোগের মুখে সেই বছরই বাঁধ নির্মাণে ঠিকাদারি ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয় পাউবো। পরের বছর থেকে স্থানীয় উপকারভোগীদের নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠন করে বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। জেলা পর্যায়ে পিআইসির সভাপতি থাকেন জেলা প্রশাসক আর উপজেলা পর্যায়ে ইউএনও। আর সদস্য সচিব হিসেবে থাকেন পাউবোর স্থানীয় কর্মকর্তা।
তবে বাঁধ নির্মাণে এমন মৌলিক পরিবর্তন আনলেও অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এখনও কমেনি। কোনো বছরই বাঁধ নির্মাণকাজ যথাসময়ে শেষ হয়নি।
এ ছাড়া দায়সারা গোছের কাজেরও অভিযোগ আছে। তবে গত কয়েক বছর বৃষ্টিপাত ও ঢল তুলনামূলক কম হওয়ায় বাঁধ নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি। তেমন ফসলহানির ঘটনাও ঘটেনি।
পাঁচ বছরের মাথায় এ বছর আবার হাওরে দেখা দিয়েছে অকালবন্যা। বাঁধ ভেঙে ঢুকছে পানি। তলিয়ে যাচ্ছে ফসল। তাই বাঁধ নির্মাণ নিয়ে দুর্নীতির বিষয়টি নিয়ে আবারও আলোচনা শুরু হয়েছে।
সুনামগঞ্জের শনির হাওরের কৃষক রইসুল ইসলাম বলেন, ‘এবার ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাঁধের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মার্চ শেষেও অনেক বাঁধের কাজ শেষ হয়নি। শেষ সময়ে তাড়াহুড়ো করে দায়সারা কাজ হয়েছে। আর কাজ শেষ হতে না হতেই বৃষ্টি আর ঢল শুরু হয়েছে। এতে নরম মাটির বাঁধগুলো ভেঙে যাচ্ছে।’
বাঁধের কাজ শেষ হতে দেরি হওয়ার বিষয়টি নিয়ে হাওর ও পরিবেশ উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা বলেন, ‘এবার পিআইসি গঠনেই দেরি হয়েছে। ফলে কাজও হয়েছে দেরিতে। যথাসময়ে কাজ শুরু হয়নি, কাজও যথাযথ হয়নি।’
পিআইসি গঠনে দেরি হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘স্থানীয় উপকারভোগীদের দিয়ে পিআইসি গঠনের কথা থাকলেও আদতে স্থানীয় সাংসদরাই নিজেদের লোকদের নিয়ে কমিটি গঠন করে দেন। সাংসদদের সঙ্গে সমন্বয় ও তাদের লোক বাছাইয়েই দেরি হয়।’
বাঁধ ভেঙে যাওয়াই শুধু নয়, অনেক ক্ষেত্রে বাঁধ উপচেও হাওরে পানি প্রবেশ করছে
তবে এমন অভিযোগ অস্বীকার করে উন্নয়ন বোর্ডের সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৗশলী মো. শামসুদ্দোহা বলেন, ‘এবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের কারণে পিআইসি গঠনে কিছুটা দেরি হয়েছে। কারণ স্থানীয় লোকজন ও প্রশাসন নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত ছিল।’
প্রয়োজন নদী খনন
হাওরে বাঁধের কাজ শুরু হওয়ার কথা ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে। কিন্তু সুনামগঞ্জের অনেক হাওরের পানি এই সময়ের মধ্যে নামেইনি। কয়েক বছর ধরেই এমনটি হচ্ছে। হাইল হাওর, শনির হাওরসহ কয়েকটি হাওরের কিছু জায়গায় জানুয়ারি পর্যন্ত পানি ছিল।
পানি না নামায় যথাসময়ে বাঁধ নির্মাণকাজ শুরু করা যায়নি বলে দাবি করেছেন পাউবোর নির্বাহী প্রকৗশলী মো. শামসুদ্দোহা।
যথাসময়ে পানি না নামার কারণ সম্পর্কে হাওর ও পরিবেশ উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা বলেন, ‘ঢলে পানির সঙ্গে বালিও নামে। এই বালি জমে নদীর নাব্যতা কমে গেছে। ফলে নদী হাওরের পানি টানতে পারছে না। এতে শুষ্ক মৌসুমেও হাওরে পানি জমে থাকছে।
হাওরে এটি নতুন সংকট জানিয়ে কাসমির বলেন, সাত-আট বছর ধরে এমনটি হচ্ছে। দিন দিন এ সমস্যা তীব্র হচ্ছে।
একদিকে শুষ্ক মৌসুমেও হাওরে পানি আটকে থাকছে, অন্যদিকে মার্চের দিকে এক-দুদিনের ঢলেই বাঁধ উপচে হাওরে পানি প্রবেশ করছে বলে জানান তাহিরপুরের উপজেলা চেয়ারম্যান করুণাসিন্ধু পাল।
তিনি বলেন, ‘বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম তো আছেই। বাঁধ ভাঙার পাশাপাশি অনেক জায়গায় বাঁধ উপচেও হাওরে পানি ঢুকছে।’
নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় এমনটি হচ্ছে জানিয়ে পুরো হাওর এলাকার নদীগুলো একসঙ্গে খননের দাবি করেছেন করুণাসিন্ধু পাল ও কাসমির রেজা।
কাসমির রেজা বলেন, ‘এখন আর কেবল বাঁধ দিয়ে ফসল রক্ষা সম্ভব নয়। উজান থেকে ভাটি পর্যন্ত নদী খনন করতে হবে। ভৈরবে মেঘনা নদীতে বড় বড় চর পড়েছে। সেগুলোও খনন করতে হবে। কারণ সুনামগঞ্জ থেকে সুরমার পানি মেঘনায় গিয়ে মেশে।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সুনামগঞ্জের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোমও মনে করেন, নদী খনন করা না হলে হাওরের ফসল বাঁচানো সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, ‘নদীগুলো দ্রুত খনন করা প্রয়োজন। একটু করলে হবে না, পুরো নদী একসঙ্গে খনন করতে হবে।’
বাঁধ একটি সাময়িক ব্যবস্থা উল্লেখ করে হাওর গবেষক ড. হালিমদাদ খান বলেন, ‘বাঁধ দিয়ে ফসল পুরোপুরি রক্ষা সম্ভব নয়। আগে এই ঢলের পানি নদী দিয়ে মেঘনা হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশে যেত। এখন নদী ভরাট হয়ে গেছে। ফলে পানি নদী উপচে হাওরে ঢুকে পড়ছে। প্রতি বছরই হাওরে পানি ঢুকছে। যে বছর ঢল বেশি নামে, সে বছর পানি বেশি ঢোকে। কেবল বাঁধ দিয়ে এই পানি আটকানো যাবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের নিজেদের যেসব ধানের জাত ছিল, সেগুলো বৃষ্টি শুরুর আগেই তোলা যেত। কিন্তু এতে ফলন কম হয়। এখন হাইব্রিড জাতের ধানে ফলন বেশি হয়। তবে সময়ও বেশি লাগে। তাই হাওরের উপযোগী নতুন জাত উদ্ভাবন করতে হবে কৃষি বিজ্ঞানীদের।
ফসল রক্ষায় নদী খননের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেট বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এস এম শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘সুরমাসহ এই এলাকার বেশির ভাগ নদীই নাব্য হারিয়েছে। এগুলো খনন করা প্রয়োজন। নদী খননের জন্য গত বছর আমরা ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। সম্ভাব্যতা যাছাই শেষে এটি এখন মন্ত্রণালয়ের বিবেচনাধীন।’
নদী খননের পাশাপাশি কীভাবে আরও টেকসই বাঁধ নির্মাণ করা যায় সে বিষয়ে আরও ভাবতে হবে বলে মনে করেন শহিদুল ইসলাম।
এদিকে সুনামগঞ্জের হাওরের পরিস্থিতি পরিদর্শনে এসে শুক্রবার পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম বলেছেন, ‘হাওরের নদীগুলো খননে উদ্যোগ নেয়া হবে এবং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে বাঁধের স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করা হবে।’