পুঁজিবাজারে আরও কমল শেয়ারের দর। রোজায় পরপর চার কর্মদিবসে সূচকের পাশাপাশি কমল লেনদেনও। প্রায় এক বছর পর তা নেমে গেল ৫০০ কোটি টাকার নিচে।
টানা পড়তে থাকা বাজার ঘুরে দাঁড়াবে- এমন আশ্বাসের কথা নানাজন বলে এলেও তেমন কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।
বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেছে। এই অবস্থায় আস্থাহীনতার কারণে বিনিয়োগকারীরা শেয়ার না কিনে বাজার পর্যবেক্ষণে আছে।
সপ্তাহের চতুর্থ কর্মদিবস বুধবার লেনদেন হয়েছে ৪৯০ কোটি ৫০ লাখ ২৩ হাজার টাকা, যা ২০২১ সালের ১১ এপ্রিলের পর সর্বনিম্ন। সে সময় করোনা পরিস্থিতির কারণে লকডাউনের মধ্যে লেনদেন হয়েছিল ৪৫৬ কোটি ৫৫ লাখ ৩ হাজার টাকা।
টানা চার দিন ঢালাওভাবে দর পতন হয়েছে। লেনদেন হওয়া কোম্পানিরগুলোর মধ্যে যতগুলোর দর বেড়েছে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি কোম্পানির দরপতন হয়েছে। দর বেড়েছে ৪৪টি কোম্পানির, কমেছে ২৯৩টির। আর অপরিবর্তিত থাকে ৩৮টির দর।
দিন শেষে সূচক কমল ৩১ পয়েন্ট। তিন দিনে পড়ল সব মিলিয়ে ১০৯ পয়েন্ট।
বাজারের যখন এই চিত্র, তখন এমন কোনো খাত থাকার কথা নয়, যেগুলোর বিনিয়োগকারীরা স্বস্তিতে থাকবে। এর মধ্যে টেলিযোগাযোগ, চামড়া, সিরামিক ও কাগজ ও প্রকাশনা খাতের সবগুলো কোম্পানি দর হারিয়েছে।
আর্থিক ও জীবন বিমা, সেবা ও আবাসন খাতে কেবল একটি করে, ব্যাংক, সিমেন্ট, মিউচুয়াল ফান্ড খাতে কেবল দুটি করে কোম্পানি বা ইউনিটের দর বেড়েছে।
যেসব কোম্পানি দর হারিয়েছে, তার মধ্যে বেশির ভাগই পতনের সর্বোচ্চ সীমা ২ শতাংশের কাছাকাছি দর কমার পর ক্রেতা শূন্য হয়ে গেছে।
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর বাজারে যে ধস দেখা দেয়, সেটি ঠেকাতে দরপতনের সীমা ১০ শতাংশ থেকে ২ শতাংশ কমিয়ে দেয়া হয়। এতে এক দিনে বড় পতন ঠেকানো গেলেও শেয়ার বিক্রি করা যাচ্ছে না।
বিনিয়োগকারীরা বিপুল পরিমাণ বিক্রয়াদেশ দিয়ে বসিয়ে রাখলেও ক্রেতা নেই। শেয়ারদর ২ শতাংশ কমলেই ক্রেতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এতে শেয়ারের চাহিদা তৈরি না হওয়ায় দর পরের দিনও কমছেই।
এভাবে বিনিয়োগকারীরা কোনো কোম্পানির শেয়ার না কিনে আরও এক দিন পর্যবেক্ষণের নীতি নিয়েছে বলে মনে করেন স্টক ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রিচার্ড ডি রোজারিও।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘যখন ২ শতাংশ দর পড়ে যায়, তখন বায়াররা আর বাই দিতে চান না। পরের দিন দেখতে চান। ট্রেড ভলিউম ফল করার এটি একটি অন্যতম কারণ হয়ে গেছে।
‘একটা নির্দিষ্ট দিনে যখন বায়াররা দেখেন যে একটা লো রেটে সেলার বসে রয়েছে। তখন মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হলো পরের দিনের জন্য অপেক্ষা করে। যার কারণে একটা কিউমিলেটিভ নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট ভলিউমে দেখা যাচ্ছে।’
শতাধিক কোম্পানির দর কমেছে সর্বোচ্চ সীমায়
৩৯টি কোম্পানির দর পতন হয়েছে দিনের সর্বোচ্চ সীমা ২ শতাংশের কাছাকাছি। ২২টির দরপতন হয়েছে ১ দশমিক ৮ শতাংশের বেশি, ২৪টির ১ দশমিক ৭ শতাংশ, ১৫টির ১ দশমিক ৬ শতাংশ, ১৪টির ১ দশমিক ৫ শতাংশ, ১৪টির ১ দশমিক ৪ শতাংশ, এবং ৫৬টি কোম্পানির দরপতন হয়েছে ১ থেকে ১ দশমিক ৩ শতাংশের মধ্যে।
এক দিনে সর্বোচ্চ ২ শতাংশ দরপতন হলেও পুঁজিবাজারে কোনো শেয়ারের দর বৃদ্ধি কমা সর্বনিম্ন ১০ পয়সার হিসাবে হওয়ার কারণে কোনো কোনো কোম্পানি এক দিনে দর কমতে পারে ১০ পয়সা, কোনো কোম্পানি ২০ পয়সা কোনোটি ৩০ পয়সা।
বুধবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেনের এই চিত্র বিনিয়োগকারীদেরকে আরও হতাশ করেছে
ব্যাপক দরপতনের মধ্যেও বলা যায় কিছুটা ভালো ছিল বস্ত্র খাত। ৪০টি কোম্পানির দরপতনের বিপরীতে ১০টির দর বৃদ্ধি ও ৯টির দর অপরিবর্তিত ছলি।
তবে সংখ্যায় সবেচেয়ে বেশি দর বৃদ্ধি পেয়েছে প্রকৌশল খাতে। দর বেড়েছে ১৩টি কোম্পানির, কমেছে ২৯টির।
ওষুধ ও রসায়ন খাতে ৮টির দর বেড়েছে, কমেছে ২১টির ও অপরিবর্তিত রয়েছে ২টির। জ্বালানি খাতে ৭টির দাম বেড়েছে, দুটি কোম্পানির দর ধরে রাখতে পেরেছে। আর কমেছে ১৪টির।
আগের দিন ৫টির দর বৃদ্ধি ও ১৬টির দর হ্রাস পাওয়া ব্যাংক খাতের ২টি কোম্পানির দাম বেড়েছে আজ। আগের দরে লেনদেন হয়েছে ১০টির। বিপরীতে দর হারিয়েছে ১৬টি কোম্পানি।
রোববার দরপতন শুরু হওয়া বিমা খাতের ৩৪টির দর বৃদ্ধিও বিপরীতে বেড়েছে চারটির ও অপরিবর্তিত ছিল ২টির। আর জীবন বিমার ১২টির দরপতনের বিপরীতে বেড়েছে মাত্র একটির। এছাড়াও বিবিধ, খাদ্য, সিমেন্ট, আইটি খাতের হাতে গোনা দুয়েকটি কোম্পানির দর বেড়েছে।
লেনদেনের শীর্ষ পাঁচ খাত
লেনদেন সবচেয়ে বেশি হয়েছে প্রকৌশল খাতে। ৭২ কোটি ১৬ লাখ টাকার শেয়ার হাতবদল হয়েছে খাতটিতে। আগের দিন ৬১ কোটি ৯০ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছিল।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে বস্ত্র খাতে। মোট লেনদেনের ৬৯ কোটি বা ১৪.৬১ শতাংশই ছিল খাতটির দখলে। আগের দিনে এ খাতের লেনদেন ছিল ৫৮ কোটি ৬০ লাখ।
তৃতীয় স্থানে থাকা ওষুধ ও রসায়ন খাতের লেনদেন গতকালের চেয়ে কিছুটা কমেছে। আগের দিন এ খাতের লেনদেন ছাড়ায় ৫২ কোটি ১১ লাখ টাকা। আজ কিছুটা কমে সেটি দাঁড়িয়েছে ৫০ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
এরপরে বিবিধ খাতে ৪৯ কোটি ৬০ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। এ খাতেও গতকাল লেনদেন বেশি হয়েছে। মঙ্গলবার খাতটিতে হাতবদল হয়েছিল ৫৬ কোটি ৭৮ লাখ টাকার শেয়ার।
লেনদেনের ৮.৮৪ শতাংশ নিয়ে তালিকার পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে সিমেন্ট খাত। মোট ৪১ কোটি ৭৫ লাখ টাকার শেয়ার হাতবদল হয়েছে, আগের দিন ছিল ৩৩ কোটি ৭২ লাখ টাকার।
সূচক পতনে দায়ী যেসব কোম্পানি
সবচেয়ে বেশি ৬.০৭ পয়েন্ট সূচক কমিয়েছে গ্রামীণফোন। কোম্পানিটির ০.৮ শতাংশ দরপতনে এই পয়েন্ট কমেছে।
ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো লিমিটেডের ০.৪৮ শতাংশ দরপতনের কারণে সূচক পড়েছে ২.৬১ পয়েন্ট। এরপরেই স্কয়ার ফার্মার ০.৬৪ শতাংশ দর পতনের কারণে সূচক কমেছে ২.১৫ পয়েন্ট।
ইউনাইটেড পাওয়ারের দরপতনে ১.৫ পয়েন্ট, আইসিবি ১.৩৯ পয়েন্ট, পাওয়ার গ্রিড ১.৩৬ পয়েন্ট, পূবালী ব্যাংক ০.৮৯ পয়েন্ট, ফরচুন ০.৭৩ পয়েন্ট, আইডিএলসি ০.৭২ পয়েন্ট এবং ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের দরপতনে সূচক কমেছে ০.৬৪ পয়েন্ট।
অর্থাৎ এই ১০টি কোম্পানিই সূচক ফেলেছে ১৮.০৬ পয়েন্ট ।
সূচক বাড়িয়েছে যারা
লাফার্জ হোলসিম বাংলাদেশের দর ২.১৫ শতাংশ বাড়ার কারণে সূচক বেড়েছে ৩.৪১ পয়েন্ট। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১.৫২ পয়েন্ট সূচকে যোগ করেছে ওয়ালটন। এদিন কোম্পানিটির দর বেড়েছে ০.২৭ শতাংশ।
এরপরেই ১.০১ পয়েন্ট বাড়িয়েছে বিবিএস ক্যাবলস। কোম্পানিটির দর বেড়েছে ৫.০৬ শতাংশ।
এছাড়া রেনাটা ০.৭৪ পয়েন্ট, বিকন ফার্মা ০.৭২ পয়েন্ট, জেএমআই হসপিটাল ০.৬ পয়েন্ট, ওয়ালটন হাইটেক ০.৫৫ পয়েন্ট, পদ্মা অয়েল ০.৪৭ পয়েন্ট, কাট্টালি টেক্সটাইল ০.৪২ পয়েন্ট, বিকন ফার্মা ০.৪২ পয়েন্ট, খুলনা পাওয়ার ০.৩৯ পয়েন্ট এবং বার্জার পেইন্টস সূচক যোগ করেছে ০.৩২ পয়েন্ট।
এই ১০ কোম্পানি সূচক বাড়িয়েছে ৭.৬৭ পয়েন্ট।
বিনিয়োগ বাড়ানোর সব উদ্যোগ ব্যর্থ
রোজার আগে শেষ কর্মদিবস বৃহস্পতিবার হাতবদল হয়েছিল এক হাজার এক শ কোটি টাকার বেশি শেয়ার। রোজার প্রথম কর্মদিবস রোববার নাম নেমে আসে আট শ কোটির ঘরে। পরের দিন তা নামে ছয় শ কোটির ঘরে।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রুশ হামলার পর বাজারে যে ধস নামে। সে সময় দরপতন এক দিনে শেয়ারের দরপতনের সর্বোচ্চ সীমা ২ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয় বিএসইসি। পাশাপাশি বাজারে তারল্য বাড়াতে নানা চেষ্টা করে বিএসইসি।
গত ৯ মার্চ ৩৩টি ব্যাংকের প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকের পর জানানো হয়, যেসব ব্যাংকের বিনিয়োগ তাদের মূলধনের ২৫ শতাংশের নিচে, সেগুলো দ্রুত ২ শতাংশ বিনিয়োগ বাড়াবে। যেসব কোম্পানি বিশেষ তহবিলে এখনও ২০০ কোটি টাকা জমা দেয়নি, সেগুলো দ্রুত জমা দেবে, আর যেসব ব্যাংক টাকা জমা দিয়েও বিনিয়োগে যায়নি, তারা দ্রুত বিনিয়োগে যাবে।
পরের দিন মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোর সঙ্গে বৈঠক শেষে জানানো হয়, মৌলভিত্তির অনেক কোম্পানির শেয়ারদর অনেকটাই কমে এসেছে। এই মুহূর্তে সেগুলোতে বিনিয়োগ লাভজনক হতে পারে। বিনিয়োগ বাড়ানোর ঘোষণা আসে এই বৈঠক শেষেও।
২৩ মার্চ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়াতে চিঠি দেয় বিএসইসি। এতে বলা হয়, অনেক ব্যাংক সেই বিনিয়োগসীমা ও ২০০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিলের চেয়ে কম বিনিয়োগ করেছে। এমনকি অনেকেই এখনও সে বিশেষ তহবিল গঠনই করেনি।
এমন অবস্থায় ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগসীমা অনুযায়ী ও বিশেষ তহবিল থেকে বিনিয়োগের জন্য চিঠিটি পাঠানো হয়। যারা বিশেষ তহবিল গঠন করেনি তাদের সেটি গঠন করতেও বলা হয় তাতে।
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে বিএসইসির ধারাবাহিক বৈঠকের অংশ হিসেবে গত ৩১ মার্চ বাজার ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে হয় আলোচনা
গত ২৯ মার্চ আরও একটি পদক্ষেপ নেয় বিএসইসি। ২৬টি অতালিকাভুক্ত বিমা কোম্পানিকে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) জন্য ফাইল দাখিল ও তাদের ইক্যুইটির ২০ শতাংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে পদক্ষেপ নিতে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ-আইডিআরএকে চিঠি দেয় সংস্থাটি।
সবশেষ গত ৩১ মার্চ বাজার মধ্যস্ততাকারীদের সঙ্গে বৈঠকে বসে বিএসইসি। বৈঠক শেষে জানানো হয়, সু প্রতিটি ডিলার এই এক মাসে কমপক্ষে ১ কোটি করে ২৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। পাশাপাশি পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতা তহবিল থেকেও বিনিয়োগ বাড়ানো হবে। মার্চেন্ট ব্যাংক বিনিয়োগ করবে ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকা। বিনিয়োগ বাড়ানোর আশ্বাস দিয়েছে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি।
ফলে এই মাসে ৫০০ থেকে ৬০০ কোটি টাকা নিশ্চিত বিনিয়োগের আশ্বাস আসে।
পরের দিন বৃহস্পতিবার লেনদেন ছাড়ায় এক হাজার ১৬৯ কোটি টাকা, যা ছিল আগের দেড় মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। কিন্তু এর পরের চার কর্মদিবসেই লেনদেন কমে বছরের সর্বনিম্নে চলে এসেছে।