শীতলক্ষ্যা নদীতে একের পর এক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ থেকে সাতটি নৌ রুটে চলাচল করা ছোট লঞ্চগুলো গত ১৪ দিন ধরেই বন্ধ আছে।
এবার এসব লঞ্চকে ঝুঁকিপূর্ণ আখ্যা দিয়ে স্থায়ীভাবে চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। এর বদলে সেখানে চালু করা হয়েছে সি-ট্রাক ও দোতলা লঞ্চ।
মঙ্গলবার বিআইডব্লিউটিএ নারায়ণগঞ্জের যুগ্ম পরিচালক মাসুদ কামাল এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, লঞ্চমালিকরা লঞ্চ চালুর দাবি জানালে গত রোববার নৌ মন্ত্রণালয়ে তাদের ডাকা হয়। সেখানে নৌ মন্ত্রণালয়ের সচিবের সঙ্গে বৈঠকে বসেন তারা। বৈঠকে নারায়ণগঞ্জে সানকিং ডেকের লঞ্চ চলাচল করতে পারবে না জানিয়ে লঞ্চ চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত বহাল রাখা হয়।
এমন সিদ্ধান্তে লঞ্চমালিকরা লোকসানের মুখে পড়েছেন জানিয়ে নারায়ণগঞ্জ লঞ্চমালিক সমিতির সভাপতি বদিউজ্জামান বাদল বলেন, ‘স্থায়ী নিষেধাজ্ঞায় এগুলো চলাচলে আর কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। তাই নারায়ণগঞ্জের সাতটি রুটের ৭০ লঞ্চের মালিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। শুধু লঞ্চমালিকরাই নন, লঞ্চের শ্রমিক ও কর্মচারীরাও বিপদে আছেন। লঞ্চ না চলায় তাদের সংসার চলছে না। তাই বিআইডব্লিউটিএকে আমাদের সহযোগিতা করতে হবে।’
তিনি জানান, নারায়ণগঞ্জ থেকে চাঁদপুর, মতলব থানা, শরীয়তপুর, কুমিল্লার হোমনা, বাঞ্ছারামপুর, মুন্সীগঞ্জ, তালতলাসহ সাতটি রুটে প্রতিদিন কয়েক হাজার যাত্রী চলাচল করতেন।
নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নারায়ণগঞ্জ-মুন্সীগঞ্জ নৌপথে চালু করা হয়েছে একটা সি-ট্রাক। আর নারায়ণগঞ্জ থেকে চাঁদপুর, মতলব ও শরীয়তপুর নৌপথে তিনটি দোতলা লঞ্চ চালু হয়েছে। তবে কুমিল্লার হোমনা, বাঞ্ছারামপুর ও তালতলা পথে নাব্যতার কারণে নৌ চলাচল বন্ধ রয়েছে।
সরেজমিনে জানা গেছে, ১৪ দিন ধরে লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন লঞ্চমালিকরা। ঈদের আগে সব লঞ্চ বন্ধ হওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন অনেকেই। প্রতিদিন ঘাটে এসে লঞ্চের শ্রমিক-কর্মচারীদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন তারা।
সোমবার দুপুরে নিজেদের অবস্থা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছেন অনেকেই। আর্থিক সংকটে অনেকে লঞ্চ ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়বেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
চাঁদপুর লাইনে চলাচল করা এমভি হেদায়েত নামের যাত্রীবাহী লঞ্চের মালিক মোহাম্মদ হেদায়েদ উল হক বলেন, ‘সামনে ঈদ আসতেছে। লঞ্চের স্টাফরা তাদের বেতন চায়। লঞ্চ তো বন্ধ করে দিছে। আমি কই থেকে তাদের চাহিদা পূরণ করবো।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার লঞ্চটা দিয়া আমার পরিবার চলত। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া চলত। এখন আমার নিজের অবস্থাই তো করুণ। আমি লঞ্চের স্টাফদের সংসার কীভাবে চালাব।’
চাঁদপুর লাইনের আল-ফালাহ ও আল-সালাহ নামের দুটি লঞ্চের মালিক মোহাম্মদ হোসেন। লঞ্চ সমিতির অফিসে বসে দুশ্চিন্তায় দিন পার করছেন।
কেঁদে কেঁদে মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ‘আমার লঞ্চগুলোর বৈধ সার্ভে রিপোর্ট আছে। অনেক বছর ধরে চলছে। কোনো দুর্ঘটনার কবলে পড়েনি। হঠাৎ করে লঞ্চ বন্ধ করে দেয়া হলো, কিন্তু আমাদের কথা ভাবল না। সরকার যে সিদ্ধান্ত দিচ্ছে আমরা তা মানছি। তাদের উচিত আমাদের সহযোগিতা করা।’
মতলব লাইনে চলাচল করা এমএল হাসিব লঞ্চের মালিক গোলাম হোসেন জানান, চলাচল না করায় লঞ্চগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘দোতলা লঞ্চ বানাতে খরচ বেশি, তাই অর্থের অভাবে অনেকে এ ব্যবসা থেকে সরে যাবে। বিআইডব্লিউটিএ আমাদের কোনো সহযোগিতা করছে না।’
শুধু লঞ্চমালিকরাই নন, বিপদে পড়েছেন লঞ্চের কেরানি, সুকানিসহ অন্যান্য কর্মচারীও। এমএল হাসিব লঞ্চের কেরানি সোহান বলেন, ‘লঞ্চ চলে না, তাই মালিক বেতনও দিতে পারেন না। আমি সংসারী মানুষ, আমার সংসার চলবো কীভাবে। অন্য কাজের খোঁজ করতাছি।’
দারাশিকো লঞ্চের সুকানি বলেন, ‘গত ২১ তারিখের পর থেকে লঞ্চ চলাচল বন্ধ হইতে শুরু করে। বর্তমানে সব লঞ্চ বন্ধ। এখন তো মালিকরাও কষ্টে আছে। আমাগো অবস্থা করুণ। টাকা নাই পয়সা নাই, কেমনে চলমু। আবার সামনে ঈদ আসতাছে।’
এসব বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ নারায়ণগঞ্জের যুগ্ম পরিচালক মাসুদ কামাল বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের ছোট লঞ্চের মালিকরা চাইলে বড় লঞ্চ চালু করতে পারেন। আমরা তাদের সহযোগিতা করব, তবে নিয়ম মেনে।’
গত ২০ মার্চ দুপুরে শীতলক্ষ্যা নদীতে কার্গো জাহাজ রূপসী-৯-এর ধাক্কায় যাত্রীবাহী লঞ্চ এমএল আফসারউদ্দিন ডুবে গেলে নারী-শিশুসহ ১০ জনের প্রাণহানি ঘটে। পরে গত ৪ এপ্রিল একই নদীতে সাবিত আল হাসান নামের আরেকটি যাত্রীবাহী লঞ্চডুবির ঘটনায় ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এসব ঘটনায় মামলা হলেও বিচারকাজ এখনো শুরু হয়নি।