উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে হুমকির মুখে পড়েছে কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার জিওলের বাঁধ। উপজেলার ইটনা সদর, ধনপুর, মৃগা ও জয়সিদ্দি ইউনিয়নের কৃষকরা স্বপ্ন বুনেছেন এই হাওরে।
ফসল রক্ষার এ বাঁধটি ভেঙে গেলে তলিয়ে যাবে এই চার ইউনিয়নের হাজার হাজার একর বোরো ধান। এমন পরিস্থিতিতে বাঁধটি রক্ষায় প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছেন স্থানীয়রা।
গ্রামে মাইকিং করে জড়ো হচ্ছেন কৃষকরা। কোদাল, পাইছা, প্লাস্টিকের বস্তা আর বাঁশের চাটাই নিয়ে বাঁধে এসেছেন গ্রামবাসী। কেউ কোদাল দিয়ে মাটি কাটছেন, কেউ তুলে দিচ্ছেন মাথায়, কেউবা আবার বস্তার ভেতরে মাটি ভরে নিয়ে ফেলছেন বাঁধের ঢালুতে। অনেকে দিনভর থাকছেন বাঁধ পাহারায়, রাতের খাবারও খান বাঁধে বসে।
রাত সাড়ে ১১টার দিকে জিওলের বাঁধে গিয়ে দেখা গেছে এমন চিত্র।
এ বছর সুনামগঞ্জে আগেভাগেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টি হচ্ছে ভারতের মেঘালয়েও। ফলে উজান থেকে নেমে আসা ঢলে সুনামগঞ্জের নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে, তলিয়ে যাচ্ছে তীরবর্তী চর। এই ঢলেই শনিবার টাঙ্গুয়ার হাওরের নজরখালী বাঁধ ভেঙে গেছে। এতে এরই মধ্যে ইটনার বিভিন্ন হাওরের প্রায় ২০০ একর, ধনপুর ইউনিয়নের নালুয়া হাওরে প্রায় ৩০০ একর নিচু জমির ফসল তলিয়ে গেছে।
পাকার আগ মুহূর্তে কষ্টে বোনা ফসল চোখের সামনে পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় দিশাহারা কৃষকরা, তাদের চোখেমুখে হতাশার ছাপ।
কৃষকরা বলছেন, পুরো বাঁধটি ১৪ ফিট প্রস্থ হওয়ার কথা থাকলেও সেটি করা হয়েছে ৭-৮ ফিট, কোথাও কোথাও আরও কম। এ ছাড়া বাঁধের যেখানে প্রয়োজন সেখানে কাজ না করে কাজ হয়েছে অপ্রয়োজনীয় জায়গায়। তাই এটি এখন ভাঙনের হুমকির মুখে পড়েছে। যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে যেতে পারে এই বাঁধ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমন পরস্থিতিতে হাওরের কৃষকদের সঙ্গে তাদের কর্মকর্তারা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। যেসব জমির ধান ৮০ ভাগ পেকেছে তা দ্রুত কেটে ফেলার জন্য কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছেন।
ইটনা সদর ইউনিয়ন কৃষক লীগের সভাপতি শাহজাহান মিয়া। এই হাওরে ৪১ একর জমিতে বোরো ধান চাষ করেছেন। উজানের ঢল নেমে আসার পর থেকেই এই বাঁধে সার্বক্ষণিক রয়েছেন তিনি।
নিউজবাংলাকে শাহাজাহান বলেন, ‘এই হাওরে চারটি ইউনিয়নের প্রায় ২ হাজার ৫০০ একর জমি রয়েছে। জিওলের বাঁধটি কোনোভাবে ভেঙে গেলেই তলিয়ে যাবে কামারকোনা হাওরের এই জমিগুলো। তাই বাঁধ রক্ষায় সন্ধ্যা থেকেই গ্রামের মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে ৩০০ থেকে ৪০০ কৃষক কাজ করছেন সেখানে।
‘আমাদের চোখে ঘুম নাই, ঠিকমতো খাওয়াদাওয়াও নাই। বাঁধ রক্ষায় সার্বক্ষণিক থাকতে হচ্ছে সেখানে। আজও পানি বেড়েছে, আরেকটু বাড়লেই বাঁধ ভেঙে যাবে।’
একই এলাকার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা আমাদের চেষ্টাটুকু করে যাচ্ছি। বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা। এই হাওরে যাদের জমি আছে, তারা অদল-বদল করে বাঁধে কাজ করছেন। দূর থেকে মাটি কেটে ট্রলি দিয়ে এনে ফেলা হচ্ছে বাঁধে। বাঁশ, চাটাই দিয়ে প্লাস্টিকের বস্তায় মাটি ভরে ফেলা হচ্ছে বাঁধের গোড়ায়। তারপরও বৃষ্টি হলেই যেকোনো মুহূর্তে বাঁধটি ভেঙে যেতে পারে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক কৃষক বলেন, ‘বাঁধের অবস্থা ভালো না। যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতি বছরই এই বাঁধের কাজ করা হয়। কিন্তু স্থায়ীভাবে কাজ না করার জন্য আজকে এই পরিণতি। অতীতে এই বাঁধটি যতবার মেরামত করা হয়েছে, ততবারই মাটি তোলা হয়েছে বাঁধের একদম নিচ থেকে। পুরো বাঁধটি ১৪ ফিট প্রস্থ হওয়ার কথা থাকলেও সেটি করা হয়েছে ৭-৮ ফিট। অনেক জায়গায় আরও কম।’
এই কৃষকের মতো বাঁধের কাজ নিয়ে বিস্তর অভিযোগ কৃষক আবুল বাশারেরও। তিনি বলেন, ‘এই বাঁধের যে জায়গাটাতে ভাঙনের সম্ভাবনা, সেখানের প্রস্থ সর্বোচ্চ ৭ ফিট। আর সেখানে ভাঙনের সম্ভাবনা নেই, সেখানকার প্রস্থ ১২-১৪ ফিট। যেখানে প্রয়োজন, সেখানে কাজ না করে কাজ হয়েছে অপ্রয়োজনীয় জায়গায়। এখন এমন একটা অবস্থা হয়েছে, আল্লাহ যদি রক্ষা না করে আমরা শেষ।’
পূর্বগ্রাম নয়াহাটির কৃষক আসাদ মিয়া কামারকোনা হাওরে জমি করেছেন ২৫ একর। তিনিও বাঁধরক্ষায় সার্বক্ষণিক রয়েছেন সেখানে। তিনি বলেন, ‘বেশির ভাগ কৃষক সুদের উপরে ঋণ করে জমি চাষাবাদ করেছেন। জিওলের এই বাঁধ ভেঙে গেলে তাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে। পরিবার-পরিজন নিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।’
একই অবস্থা এলংজুরী ইউনিয়নের নাও টানার খালেরও। সেখানেও ভাঙন ঠেকাতে গ্রামের মসজিদে মাইকিং করে জড়ো হয়েছেন কৃষকেরা। চেষ্টা করছেন এটি রক্ষার।
কাকটেংগুর গ্রামের কৃষক বাবুল মিয়া বলেন, ‘এই খালের অবস্থাও বেশি ভাল না। যেকোনো সময় খালের বাঁধ ভেঙে যেতে পারে। এই হাওরে জমি রয়েছে ৫০০ একরের মত। বাঁধটি ভেঙে গেলে পুরো হাওর তলিয়ে যাবে।’
নিউজবাংলাকে কৃষক রেণু মিয়া বলেন, ‘এই হাওরের জমির ধান পাকতে আরও এক সপ্তাহ সময় লাগবে। পুরো হাওরের একটি জমির ধানও কাটা হয়নি। নাওটানার খালের উপর বাঁধটি ভেঙে গেলে নিমিষেই সবশেষ হয়ে যাবে।’
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী রিয়াজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জেলা প্রশাসক, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী, জেলা কৃষি সম্প্রসারণের উপপরিচালক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এই বাঁধ পরিদর্শনে এসেছিলেন। বাঁধরক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আমি সার্বক্ষণিক কৃষকদের সঙ্গে বাঁধে আছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে অন্য জায়গা থেকে মাটি এনে। বাঁধের নিচ থেকে মাটি তোলা হয়নি। অতীতে যারা কাজ করেছেন, তারা নিচ থেকে মাটি তুলে কাজ করেছেন। নিচে গভীর হওয়ার কারণে বাঁধরক্ষায় বেগ পেতে হচ্ছে।
‘তারপরেও এই বাঁধের পাশেই আরেকটি বিকল্প বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। আশা করি দ্রুতই বিকল্প বাঁধের কাজ শেষ হবে।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. ছাইফুল আলম বলেন, ‘হাওরের কৃষকদের সঙ্গে আমাদের কর্মকর্তারা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। আবারও বৃষ্টি হলে বিভিন্ন হাওরের ফসল তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই যে সব জমির ধান ৮০ ভাগ পেকেছে, সে সব ধান দ্রুত কেটে ফেলার জন্য কৃষকদেরকে বলা হয়েছে।’
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘উজানের ঢলে নদীর তীরবর্তী চরে এবং নিচু জমিতে পানি ঢুকে পড়েছে। ধনু নদীতে পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাওয়ার ফলে পাহাড়ি ঢলের পানি নিম্নাঞ্চলসহ মোহনায় ছড়িয়ে পড়েছে। নদীর গভীরতা ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবর আমরা লিখব, যাতে এই নদীর তলদেশ খনন করা হয়।’