দেশে গত মার্চ থেকে পড়েছে তীব্র গরম। ঋতু পরিবর্তনের এই সময়ে হঠাৎই বেড়েছে ডায়রিয়ার প্রকোপ। বড়দের পাশাপাশি এবার ডায়রিয়া ছড়িয়েছে শিশুদের মধ্যেও। ফলে চাপ বেড়েছে ঢাকা শিশু হাসপাতালে।
প্রথমে রাজধানীর আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশে (আইসিডিডিআর,বি) রোগীর চাপ ছিল অত্যধিক। যা কিছুটা কমে এসেছে।
রোববার দুপুরে ঢাকা শিশু হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে শিশু রোগীদের ভর্তি করার দৃশ্য। নিচতলার সাত নম্বর রেফালের ওয়ার্ডের ৭ নম্বর বিছানায় উচ্চ স্বরে আর্তনাদ করছিল ডায়রিয়া আক্রান্ত ১৬ মাস বয়সী শিশু মালিহা জান্নাত। কাছে গিয়ে দেখা যায় দুইজন নার্স শিশুর পায়ে ক্যানুলা পরানোর কারণে চিৎকার করছে সে।
মালিহার বাবা মাহমুদ রেজা, স্বামী-স্ত্রী দুইজন শিক্ষকতা করায় দিনের অধিকাংশ সময় বাচ্চাটা নানীর কাছে থাকে। গোসল করানোর সময় ওয়াসার অপরিশোধিত পানি খেয়ে ফেলায় ডায়রিয়া আক্রান্ত হয় জান্নাত।
বুধরার রাত থেকে ক্রমাগত বমি ও পাতলা পায়খানায় শুরু হওয়ায় বৃহস্পতিবার সকালে এখানে নিয়ে আসেন। কিন্তু সারাদিন অপেক্ষা করেও শয্যা পাননি।
দুপুরে শরীরে তীব্র পানিশূন্যতা তৈরি হওয়ায় চিকিৎসকরা ভর্তি নিতে বাধ্য হয়। শুরু থেকেই অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন ও স্যালাইন দিতে হচ্ছে। আজ দুইবার চেষ্টা করেও মাথা ও হাতে ভেইন (শিড়া) খুঁজে না পাওয়ায় পায়ে ক্যানোলা পরিয়ে স্যালাইন দিতে হয়েছে।
একই ওয়ার্ডের ২২ নম্বর বিছনায় ডায়রিয়া আক্রান্ত ৮ মাস বয়সী শিশু কাওসারকে ভর্তি থাকতে দেখা যায়।
শিশুটির মা পান্না বেগম বলেন, কাওসারের বাবা গত একমাস ধরে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি। তাকে দেখতে কোলের শিশুটাকে নিয়ে নোয়াখালী থেকে ঢাকায় আসেন। পথে ফুটপাতে বিক্রি হওয়া আখের শরবত ও পানি খেয়ে তার পেটের সমস্যা হয়। সঙ্গে বাচ্চারও বমি ও পাতলা পায়খানা শুরু হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘হঠাৎ করেই ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়েছে। ঢাকাসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার রোগীরা হাসপাতালে ভিড় করছে। রোগী সামাল দিতে আমার হাসপতালের প্রস্তুতি বাড়ানো হয়েছে। বেশি রোগী হলে ডায়ারিয়া সেল বানানোর পরিকল্পনা রয়েছে।’
গত সপ্তাহে যেখানে ১৬ জন রোগী ভর্তি ছিল, এখন সে সংখ্যা অনেকে বেশি বলে জানান তিনি।
গত ২৫ মার্চ ডায়রিয়া নিয়ে ভর্তি ছিল ৭ জন, ২৬ মার্চ ৮ জন, ২৭ মার্চ ১০ জন, ২৮ মার্চ ১৬ জন, ২৯ মার্চ ১৯ জন, ৩০ মার্চ ১৪ জন, ৩১ মার্চ ২১ জন।
এরপর ১ থেকে গতকাল ৩ এপ্রিল পর্যন্ত দৈনিক গড়ে ২০ থেকে ২৫ জন রোগী ভর্তি হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘ডায়রিয়া মূলত সংক্রামক রোগ। দূষিত পানি ও বাসিপচা খাবার খাওয়ার কারণে এটি হয়। বিশেষ করে ফুটপাতে বিক্রি হওয়া সহজলভ্য মুখরোচক খাবারে ব্যাক্টেরিয়া তৈরি হয়। এই খাবার খেলে যে কেউ ডায়রিয়া আক্রান্ত হতে পারেন।’
আইসিডিডিআর,বিতে যত রোগী
গত ১৬ মার্চ রাজধানীর মহাখালীর আইসিডিডিআর’বি হাসপাতালে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী ভর্তি ছিলেন ১ হাজার ৫৭ জন।
এরপর ১৭ মার্চ ১ হাজার ১৪১ জন, ১৮ মার্চ ১ হাজার ১৭৪ জন, ১৯ মার্চ ১ হাজার ১৩৫ জন, ২০ মার্চ ১ হাজার ১৫৭ জন, ২১ মার্চ ১ হাজার ২১৬ জন, ২২ মার্চ ১ হাজার ২৭২ জন, ২৩ মার্চ ১ হাজার ২৩৩ জন, ২৪ মার্চ ১ হাজার ১৭৬ জন, ২৫ মার্চ ১ হাজার ১৩৮ জন, ২৬ মার্চ ১ হাজার ২৪৫ জন, ২৭ মার্চ ১ হাজার ২৩০ জন, ২৮ মার্চ ১ হাজার ৩৩৪ জন, ২৯ মার্চ ১ হাজার ৩১৭ জন, ৩০ মার্চ ১ হাজার ৩৩১ জন, ৩১ মার্চ ১ হাজার ২৮৫ জন এবং ১ এপ্রিল ১ হাজার ২৭৪ জন এবং ২ এপ্রিল বিকেল ৪টা পর্যন্ত ৮৬১ জন ভর্তি চিকিৎসাধীন ছিলেন।
প্রতিষ্ঠানটির চিকিৎসকরা জানিয়েছে, গরমের কারণে সারা দেশে কম-বেশি ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা গেলেও এবার রাজধানীতে রোগীর চাপ বেশি।
২০০৭ এবং ২০১৮ সালের পরে এবারই দৈনিক এক হাজারের বেশি রোগী ভর্তি হচ্ছেন। অর্থাৎ গ্রীষ্ম মৌসুম শুরুর আগেই ডায়রিয়ার ভয়াবহ প্রকোপ শুরু হয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে হাসপাতালটিতে ঘণ্টায় গড়ে ৮০ জন রোগী ভর্তি হচ্ছে।
আইসিডিডিআর’বির হাসপাতালের কয়েকজন চিকিৎসক বলেন, ‘প্রতি বছরই শুষ্ক মৌসুমে ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দেয়। তবে এবার সময়ের কিছুটা আগেই রোগী আসতে শুরু করেছে। এক্ষেত্রে রোগের জীবাণুর ধরণ পরিবর্তন হয়ে থাকতে পারে। তবে সেটি গবেষণা না করে বা নিশ্চিত না হয়ে বলা সম্ভব নয়।’
জটিল পর্যায়ে আনা হচ্ছে শিশুদের
সিভিয়ার ডায়ারিয়ার রোগী এবং কলেরায় আক্রান্ত রোগীও পাওয়া যাচ্ছে এবার। কলেরায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বিগত সময়ের তুলনায় অনেক বেশি, যা মোট আক্রান্তের ২৩ শতাংশ।
শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘দেশে ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দেয়ার প্রেক্ষপটে স্বাভাবিক কারণেই বেশ কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন পড়েছে। আবহাওয়া পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মানুষের করণীয় কিছু নেই।’
তিনি পরামর্শ দেন, পানি ফুটিয়ে পান করার। ঝুঁকিমুক্ত বিশুদ্ধ পানি পান করার কোনো বিকল্প নেই বলেও জানান তিনি।
ডায়রিয়ার আক্রান্ত হলে প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে স্যালাইন ও অন্যান্য তরল খাবার, যেমন, ডাবের পানি, চিড়া ভিজিয়ে তার পানি, ডালের পানি, ভাতের মাড়, চালেন গুঁড়ার জাউ খাওয়ার পরামর্শ দেন ওই চিকিৎসক।
সেই সঙ্গে সতর্কতা হিসেবে রাস্তার পাশের খোলা খাবার বা শরবত জাতীয় পানীয় পরিহার করতে বলেন তিনি।
যে কোনো খাবারের আগে ভালোভাবে হাত পরিষ্কার করাও ডায়রিয়া প্রতিরোধের অন্যতম উপায়। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের মায়ের দুধসহ অন্যান্য খাবার তাদের যথেষ্ট পরিমাণে খাওয়ানোতে জোর দিতে হবে।