ইটনা উপজেলার ছিলনী গ্রাম। হাওর এলাকার এই গ্রামটিতে একটি জমির পাশে দাঁড়িয়ে দেখা যায়, কোমর পানিতে নেমে ধান কাটছেন কৃষক ফাইজুল ইসলাম। আর তার ৮ ও ১০ বছরের দুই ছেলে এবং ৬ বছরের মেয়েটি ধানের মুঠি টেনে টেনে জড়ো করছে। শ্রমিক সংকটে বাবার কাজে সহযোগী হয়েছে তারা।
ফাইজুল বলেন, ‘গত বছর ফসলও বেশি হয়েছে আবার ন্যায্যমূল্যও পাইছিলাম। এ জন্য এবার জমি করছিলাম চার একর। কিন্তু উজানের পানি এসে যখন থেকে জমিতে ঢুকতে শুরু করেছে, তখন থেকে ঘরের কারও খাওয়া-দাওয়া নাই। চোখেও ঘুম নাই।’
ফাইজুল জানান, এই ফসলের ওপর নির্ভর করে তার সারা বছরের খোরাক। খোরাকের পর যে ধান থাকে সেগুলো বিক্রি করে চালান সন্তানদের পড়াশোনা, চিকিৎসা আর অন্যান্য খরচ। ‘কিন্তু এবার সব গেল’ বলেই চোখের পানি মুছতে মুছতে চলে গেলেন জমিতে।
সন্তানদের নিয়ে জমিতে ধান কাটছেন ফাইজুল ইসলাম
হাতে গোনা আর মাত্র কয়েকটা দিন পরই পেকে যেত সব ধান। সোনার ফসল ঘরে তুলতেন কৃষকরা। কিন্তু পাহাড়ি ঢলের পানি এসে ঢুকতে শুরু করেছে কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন হাওরে। ইতোমধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৮০-১০০ হেক্টর জমির ধান। বিভিন্ন খাল ও নদী তীরবর্তী জমিগুলোর বেশির ভাগই ডুবে গেছে।
এ অবস্থায় তড়িঘড়ি করে আধাপাকা ধানই কাটতে শুরু করেছেন হতবিহ্বল কিছু কৃষক। আর এই ধান কাটতে কেউ কেউ নামছেন কোমর, এমনকি গলা পানিতেও।
জমিতে পানির পরিমাণ বেশি হওয়ায় ধান কাটার শ্রমিকও মিলছে না। বাধ্য হয়ে তাই পরিবারের ছোট-বড় সদস্যরাই কাঁচি হাতে নেমে গেছেন নিজেদের জমিতে।
সরেজমিন দেখা গেছে, পানির নিচে প্রায় তলিয়ে যাওয়া ধান কেটে মুঠিগুলো ছোট ছোট নৌকা কিংবা ত্রিপলের ওপর জমা করছেন কৃষকরা। পরে সেগুলো টেনে তুলছেন ট্রলিতে। নেয়া হচ্ছে ধানের খলায়। কিন্তু এত শ্রম আর বাড়তি খরচ করে আধাপাকা ধানে শেষ পর্যন্ত কোনো লাভ হবে কি না তা জানা নেই কারও। কৃষকের চোখে-মুখে তাই এখন হতাশার ছাপ।
আধাপাকা ধান কাটছেন কৃষকরা
রোববার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ইটনা উপজেলার বিভিন্ন হাওর ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। ধনপুর ইউনিয়নের কৃষক কেশব দাশ জানান, গত বছর যে জমিতে তিনি ৪০ মণ ধান পেয়েছেন এবার তার অর্ধেক পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ।
কেশব বলেন, ‘গত বছর এই জমি কেটেছি শুকনাতে। আবার ধানেও কোনো রোগবালাই ছিল না। আর এবার ধানে চিটা, আবার জমিতেও পানি ঢুকেছে। এখন কাটতে গিয়ে শ্রমিক লাগছে বেশি। সেই ধান বাড়িতে নিতে গিয়ে খরচও হচ্ছে দ্বিগুণ।’
পূর্বহাটি এলাকার কৃষক আবু তাহের জমি করেছিলেন ৭৫ শতাংশ। স্থানীয় মহাজন আর এনজিও থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে জমিতে ব্যয় করেছেন তিনি।
তাহের বলেন, ‘ধান পাকার আগেই পানি ঢুকে গেছে জমিতে। এখন না কাটলেও বিপদ। কখন জানি ডুবে যায়!’
আধাপাকা ধান কাটা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত তাহের আরও বলেন, ‘অনেকে বলতেছে পানি কমে যাবে। কিন্তু যদি না কমে তাহলে তো পুরোটাই তলিয়ে যাবে। তাই জমির ধান ভালো করে না পাকলেও কেটে ফেলতে বাধ্য হচ্ছি। খুবই দুশ্চিন্তায় আছি। শ্রমিক আর পরিবহন খরচ দিয়ে যা থাকবে তা দিয়ে নিজেই ক্যামনে চলমু আর ঋণই ক্যামনে শোধ করমু?’
একই এলাকার কৃষক বকুল মিয়া অন্যের জমি চাষ করেছেন অর্ধেক ফসলের বিনিময়ে। তিনি বলেন, ‘নিজের জমি নাই। জমি রাখার মতো টাকাও নাই। এ জন্য অর্ধেক ফসলের বিনিময়ে মালিকের কাছ থেকে জমি নিয়ে চাষ করেছিলাম। এখন উজানের পানি আমার সব শেষ করে দিল। এখন জমির মালিককে কী দিব আর আমিইবা কী নিব?’
ইটনা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা উজ্জল সাহা বলেন, ‘ভারতের মেঘালয় এবং আসামে ২৬৭ মিলিমিটার পরিমাণ বৃষ্টি হওয়ায় উজানের পানির ঢল সুনামগঞ্জ হয়ে এসে নেমেছে কিশোরগঞ্জের হাওরে।’
তিনি জানান, এখন পর্যন্ত ৮০-১০০ হেক্টর জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মূল হাওরের কোনো জমিতে পানি না ঢুকলেও নদীর তীরবর্তী ও খাল-বিলের নিচু জমিগুলোয় পানি প্রবেশ করেছে।
এ অবস্থায় আর যদি নতুন বৃষ্টি না হয় বা পানি না বাড়ে, তবে মূল হাওরের জমিগুলোয় কোনো সমস্যা হবে না। তবে পানি বাড়তে থাকলে তা বড় দুশ্চিন্তার কারণ হবে।