নেত্রকোণার খালিয়াজুরী উপজেলার হাওরাঞ্চলে পাহাড়ি ঢলের পানি ঢুকতে শুরু করেছে। গেল তিনদিনে নিম্নাঞ্চলের কয়েকটি হাওরের অন্তত ৫শ একর জমি তলিয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় কৃষকরা। এ কারণে একমাত্র বোরো ফসলের ওপর নির্ভরশীল কৃষক পরিবারগুলোতে আহাজারি শুরু হয়েছে। ধান পাকার আগেই ফসল তলিয়ে যাবার আশঙ্কা করছেন তারা।
খালিয়াজুরীর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) এএইচএম আরিফুল ইসলাম ও স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা ৩৭০ একর বোরো জমি প্লাবিত হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন।
খালিয়াজুরীর পুরানহাটি, বানিয়াহাটি, লক্ষ্মীপুর, পাঁচহাট ও জগন্নাথপুর গ্রামের কয়েকজন কৃষক জানান, বৃহস্পতিবার সকাল থেকে খালিয়াজুরীর ওপর দিয়ে প্রবাহমান ধনু, সুরমাসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বাড়তে শুরু করে। শনিবারের মধ্যে নদীগুলোর পাড় উপচে যায়।
রোববার দুপুর নাগাদ খালিয়াজুরী সদর ইউনিয়নের কীর্তনখোলা, লক্ষ্মীপুর, চুনাই হাওর, বাইদ্যারচর, কাটকাইলের কান্দা, টাকটার, মনিজান, লেবরিয়া, হেমনগর, চাকুয়া ইউনিয়নের গঙ্গাবদর, নয়াখাল ও গাজীপুর ইউনিয়নের বাগানী, বৈলং এবং ডাকাতখালী হাওরের নিম্নাঞ্চলের প্রায় ৫ শ একর বোরো জমি তলিয়ে যায়। এসব এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে নির্মিত বেশকিছু ফসল রক্ষা বাঁধ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে জানান তারা।
পুরানহাটি গ্রামের কৃষক মনির হোসেন বলেন, ‘গেল তিনদিনে আমার অন্তত ২০ একর জমির ধান তলিয়ে গেছে। এসব জমিতে কেবলমাত্র চাল গজাচ্ছিল (মিল্কিং স্টেজ)। পাকতে আরও অন্তত ১৫-২০দিন লাগতো। লক্ষ্মীপুর গ্রামের আনোয়ার হোসেন, আব্দুর রউফ, ফুল মিয়া ও পাঁচহাট গ্রামের মিজাজুল মিয়া জানান, তাদেরও অন্তত ১৫ একর জমির ফসল তলিয়েছে।
খালিয়াজুরী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) এএইচ এম আরিফুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের প্রাথমিক হিসাবে এখন পর্যন্ত ৩৭০ একর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। তবে বিকেল নাগাদ এই হিসাবে একটু তারতম্য হতে পারে।’
কৃষি কর্মকর্তা জসীম উদ্দিন বলেন, পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে এখানে ব্যাপক ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। এবারের বোরো মৌসুমে খালিয়াজুরীর ৮৯টি হাওরে মোট ২১ হাজার ১২০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, পুরোদমে ধান কাটা-মাড়াই শুরু হতে আরও অন্তত ১৫ দিন দরকার।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী এম এল সৈকত জানান, ভারতের চেরাপুঞ্জিতে বৃহস্পতিবার ১৯১ মিলিমিটার ও শুক্রবার ৩৫৭ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে সুনামগঞ্জের যাদুকাটা ও সুরমার পানি প্রবাহ বেড়ে খালিয়াজুরীর ধনু নদীর পানি উপচে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘ধনু নদীর পানি বৃদ্ধি আমাদের আশঙ্কার কারণ। খালিয়াজুরী পয়েন্টে এ নদীর বিপৎসীমা ৪ দশমিক ১৯ সেন্টিমিটার। কিন্তু রোববার সকাল নাগাদ ৩ দশমিক ৭১ সেন্টিমিটার পানি ছিল। অর্থ্যাৎ পানি এখন ১ সেন্টিমিটার নিচে আছে।
এ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কোনো ফসল রক্ষা বাঁধ ভাঙেনি। বাঁধগুলো আরও শক্ত ও মজবুত রাখার জন্য আমরা ১২ হাজার বস্তা জিও ব্যাগ এবং পর্যাপ্ত বাঁশ সংগ্রহ করে বাঁধে স্থাপন করছি।’
পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী এম এল সৈকত, খালিয়াজুরীর উপজেলা নির্বাহী অফিসার এএইচএম আরিফুল ইসলাম, কৃষি কর্মকর্তা জসীম উদ্দিন রোববার দুপুরে এ রিপোর্ট লেখার সময় হাওরের বিভিন্ন বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টগুলো পরিদর্শন করছিলেন। এ সময় তারা সংশ্লিষ্ট বিভাগকে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দেন এবং বাঁধ রক্ষায় কৃষকদেরও প্রস্তুত থাকতে বলেন। এর আগে শনিবার জেলা প্রশাসক কাজি আবদুর রহমানও খালিয়াজুরীর হাওর এলাকা পরিদর্শন করেন।
পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী এম এল সৈকত বলেন, ‘খালিয়াজুরীর ১৮১ কিলোমিটারসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার হাওরাঞ্চলে মোট ৩০০ কিলোমিটার ডুবন্ত ফসল রক্ষা বাঁধ রয়েছে। প্রতিবছরের মতো এবারও ৩৩ কোটি ১২ লাখ টাকা ব্যয়ে বাঁধগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘ফসল রক্ষা বাঁধগুলো যে উচ্চতায় নির্মাণ করার কথা, আমরা সে অনুযায়ীই নির্মাণ করেছি।’
উজান থেকে ভাটির দিকে পাহাড়ি ঢলের পানি নেমে আসতে দেখে মোহনগঞ্জ, কলমাকান্দা এবং মদন উপজেলার হাওরাঞ্চলেও কৃষকদের মাঝে দুশ্চিন্তা ছড়িয়ে পড়ছে।
২০১৭ সালে একই সময়ে উজান থেকে নেমে আসা ঢলের কারণে সৃষ্ট আগাম বন্যায় নেত্রকোণার খালয়াজুরী, মোহনগঞ্জ, মদন ও কলমাকান্দা উপজেলার শতভাগ ফসল তলিয়ে গিয়েছিল। এতে নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলেন হাজার হাজার কৃষক। এখনও অনেকে সে ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেননি। চার বছর পর আবার একই আশঙ্কা তাদের গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।