মুন্সীগঞ্জে এবার আলুর ফলন কম হওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষক ও কৃষিবিদরা। গত ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে অসময়ে বৃষ্টিপাতের কারণে প্রথম দফায় লাগানো মোট কৃষিজমির ৪০ ভাগ বীজ নষ্ট হয়ে যায়। পরে আলু চাষের নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ১৫ থেকে ২০ দিন দেরিতে চাষ করায় আবহাওয়াজনিত কারণে ফলন কম হবে বলে আশঙ্কা করছেন কৃষক ও কৃষিবিদরা।
মুন্সীগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক খুরশীদ আলম জানান, গত ডিসেম্বরে প্রথম দফায় আলু চাষ শুরু করেন কৃষকরা। আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৭ হাজার ৯০০ হেক্টর কৃষিজমি, যা মুন্সীগঞ্জের কৃষিজমির অর্ধেকেরও বেশি। প্রায় ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে আলু বীজ রোপণের পর ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে এ অঞ্চলে বৃষ্টিপাত শুরু হয়। নষ্ট হয় সদ্য বীজ বোনা আলু ক্ষেত।
১৫ থেকে ২০ দিন বিরতি দিয়ে পুনরায় বীজ বপন করে কৃষক। তবে তাতে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হয়নি। আবার অসময়ের বৃষ্টিপাত, নিম্নমানের আলুবীজ ও ঋতু পরিবর্তনের ফলে শীত চলে যাওয়ার কারণে আলুর ফলন খুবই কম হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
মুন্সীগঞ্জ সদরের মহাকালীতে নিজের আড়াই একর জমিতে তিন লাখ টাকা খরচ করে আলু চাষ করেছেন মাসুদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘প্রথম দফায় আমার ৫০ ভাগ জমিতে আলু বীজ বপন করার পর বৃষ্টিতে তা নষ্ট হয়ে গেল। এতে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হই। পুনরায় ২০ দিন পর আবার আলু বীজ বপন করি। আমার কাছে অবশ্য অতিরিক্ত বীজ ছিল, তাই অন্য চাষিদের মতো আড়াই গুণ দামে নতুন করে নিম্নমানের বীজ কিনতে হয়নি।
‘সে সময় ৬০০ টাকা বস্তা বীজের দাম হয়েছিল ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা। অন্যান্য বছর আরও আগে জমি থেকে নতুন আলু তোলা শেষ হয়ে যায়। কিন্তু এ বছর দেরিতে চাষ করতে বাধ্য হওয়ায় ফলন দেরিতে উঠছে। আমার জমিতে আলু উঠবে আরও ৪-৫ দিন পর। তবে আশঙ্কা করছি, গরম পড়ে যাওয়ায় আলুর ফলন অনেক কমে যাবে।’
মুন্সীগঞ্জ সদরের মোল্লাকান্দি ইউনিয়নের নয়াকান্দি গ্রামের কৃষক জুয়েল রানা বলেন, ‘আমি ২৪ কড়া (৬ গণ্ডা) জমিতে আলু চাষ করেছি। প্রথম দফায় এক বক্স বীজসহ ৮ বস্তা বীজ আলু লাগিয়েছিলাম। বৃষ্টিতে সব ক্ষেত নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ১ হাজার ৪০০ টাকা বস্তা দরে বীজ কিনে আবার আলু চাষ করি। প্রায় আড়াই মাস হলো চাষ করেছি।
‘এবার ক্ষেতে রোগের কারণে বেশির ভাগ আলু নষ্ট হয়ে গেছে। বেশি করে ওষুধ দিয়েছি। এতে খরচও বেড়েছে। তবে ফলন ভালো হবে না। গত বছর এই পরিমাণ জমিতে ১৩৩ বস্তা আলু হয়েছিল। এবার আলুর পরিমাণও কম হবে এবং মানও ভালো হবে না।’
জাবেদ রহমান নামের আরেক কৃষকও জানালেন আলুর ফলন কম হওয়ার আশঙ্কার কথা। তিনি বলেন, ‘নাবী ধ্বসা রোগে আক্রান্ত হয়েছে আমাদের ক্ষেত। এতে করে ফলন কম হবে, আবার মানও ভালো হবে না। আমি ১৬ একর জমিতে আলু চাষ করেছি। এবার মৌসুমটা প্রায় এক মাস পিছিয়ে যাওয়ায় রোগব্যাধির জন্য ওষুধও বেশি দিতে হচ্ছে। এতে খরচও বেড়ে গেছে।
‘গতবার ৬ হাজার মন আলু পেয়েছিলাম এই পরিমাণ জমি থেকে। এ বছর আবহাওয়া ও রোগের কারণে এত ফলন হবে না। তাই দাম ভালো থাকলেও এ বছর আলুতে কৃষকের খরচ উঠবে না।’
মুন্সীগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বলেন, ‘জাওয়াদের প্রভাবে যে বৃষ্টিপাত হয়েছিল, তাতে ১১ হাজার ৬০০ হেক্টর জমির আলুর আবাদ নষ্ট হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত এসব জমিসহ ৩৫ হাজার ৪৯০ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ করা হয়েছে। এ বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় দুই হাজার হেক্টর কম জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে। তবে বীজ ভালো না থাকা ও দেরিতে বপন করায় এবার ফলন কম হবে।’
তিনি বলেন, ‘ছত্রাকের আক্রমণসহ নাবী ধ্বসা রোগ সব সময়ই কমবেশি হয়ে থাকে। এ বছরও সেটা কিছুটা হয়েছে। তবে তা স্বাভাবিকের চাইতে বেশি নয়। ফলন কম হওয়ার মূল কারণ আবহাওয়া। আলুর ভালো ফলনের জন্য শীত দরকার। এবার দেরিতে বীজ বপন করায় আলুগাছ শীতের আবহাওয়াটা পায়নি।’
ক্ষতিগ্রস্ত হলে আলু চাষিদের জন্য সরকারি কোনো প্রণোদনা দেয়া হবে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে খুরশীদ আলম বলেন, ‘আলুকে প্রধান ফসল হিসেবে ধরা হয় না। সে কারণে এসব ক্ষেত্রে সরকারি সহায়তা দেয়া হয় না। ভবিষ্যতে যদি সরকার এসব ক্ষেত্রে কোনো সহায়তা দেয়, তবে তা কৃষকের মধ্যে বিতরণ করা হবে।’