বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ফোনকলে চিহ্নিত ‘শ্যুটার’ আকাশ, রুদ্ধশ্বাস গ্রেপ্তার অভিযান

  •    
  • ২৮ মার্চ, ২০২২ ২২:১১

সিনেমার কাহিনিকেও হার মানানো গ্রেপ্তার অভিযানে অংশ নেন মতিঝিল বিভাগ গোয়েন্দা পুলিশের চারটি টিমের প্রায় ৬০ জন সদস্য। একটানা নির্ঘুম তিন রাত এবং অক্লান্ত পরিশ্রমে তারা শ্যুটার আকাশকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হন।

মতিঝিল আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুর রহমান টিপু ও কলেজশিক্ষার্থী সামিয়া আফরান প্রীতি হত্যায় প্রধান সন্দেহভাজন শ্যুটার মাসুম মোহাম্মদ আকাশকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের মতিঝিল বিভাগ।

গ্রেপ্তার অভিযানে থাকা এক কর্মকর্তার কাছ থেকে আকাশকে খুঁজে বের করা এবং আটকের বিস্তারিত জানতে পেরেছে নিউজবাংলা।

সিনেমার কাহিনিকেও হার মানানো এই অভিযানে অংশ নেন মতিঝিল বিভাগ গোয়েন্দা পুলিশের চারটি টিমের প্রায় ৬০ জন সদস্য। একটানা নির্ঘুম তিন রাত এবং অক্লান্ত পরিশ্রমে তারা শ্যুটার আকাশকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হন। পুলিশের চৌকস গোয়েন্দা দলটিকে সহায়তা করেছে বগুড়া পুলিশও।

রাজধানীর শাহজাহানপুর আমতলা মসজিদ এলাকার মূল সড়কে গত ২৪ মার্চ রাত সাড়ে ১০টার দিকে টিপুকে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। টিপুর গাড়ি এ সময় যানজটে আটকে ছিল। পেছনে মোটরসাইকেলে অনুসরণ করা সন্ত্রাসীরা তখন গুলি চালায়। এলোপাতাড়ি গুলিতে রিকশা আরোহী কলেজছাত্রী সামিয়া আফরান প্রীতিও প্রাণ হারান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে জানান, প্রাথমিক পর্যায়ে হত্যার সময়ের একটি সিসিটিভি ফুটেজ ছাড়া তাদের কাছে আর কিছুই ছিল না। প্রধান শ্যুটারের মাথায় হেলমেট থাকায় কোনোভাবেই তাকে শনাক্ত করা যাচ্ছিল না।

ওই কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এরপর আমরা টিপু হত্যার আগে ও পরের বেশ কিছু সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করি। সেখানে লক্ষ করি এজিবি কলোনি বাজারে টিপুর রেস্তোরাঁর সামনে একটি মোটরসাইকেলে সন্দেহভাজন দুজনের অবস্থান। তখনও তাদের মাথায় হেলমেট থাকায় বোঝা যাচ্ছিল না এ দুজন আসলে কে।

‘তবে হত্যাকাণ্ডের সময়ের সিসিটিভি ফুটেজ আর এজিবি কলোনির ফুটেজ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় মোটরসাইকেল আরোহী দুজনই খুনের সঙ্গে জড়িত।’

জাহিদুল ইসলাম টিপু। ফাইল ছবি

তিনি বলেন, ‘খুনির কোনো ক্লু না থাকায় আমরা ঢাকা শহরের পাঁচজন শ্যুটারের বিষয়ে খোঁজ নিতে শুরু করি। আমরা জানি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শ্যুটাররা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে না। তাই তাদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুদের খুঁজে বের করার চেষ্টা শুরু হয়। শ্যুটারদের সঙ্গে কারা আছে সেটা নিশ্চিত হয়ে আমরা তাদের মোবাইল ট্র্যাকিং শুরু করি।

‘এর মধ্যে আমাদের কাছে তথ্য আসে হত্যার পরপরই আশপাশের এলাকা থেকে একজন শ্যুটার ঢাকা ছেড়ে খুলনার দাকোপের দিকে চলে গেছে। আরেকজন শ্যুটার হত্যাকাণ্ডের পর রাত সোয়া ১১টার দিকে গোড়ান ক্লাব এলাকা থেকে জয়পুরহাট জেলার দিকে চলে গেছে।’

এরপরেই গোয়েন্দারা সন্দেহের তালিকা ছোট করে দুজনে নামিয়ে আনেন।

ওই কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের একটি টিমকে খুলনার দাকোপে পাঠিয়ে দেয়া হয়। অন্যদিকে মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই জয়পুরহাটে যে শ্যুটার তার এক সঙ্গীসহ গেছে, সেখান থেকে তারা আবার বগুড়ার দিকে ব্যাক করছে। বগুড়ায় দুই-তিন ঘণ্টা থাকার পর ওই সঙ্গী ঢাকার দিকে ফিরে আসছে।

‘তখন আমরা অনুমান করি, ওই সঙ্গী শ্যুটারকে জয়পুরহাট বা বগুড়ায় রেখে ঢাকায় ফিরে আসছে।’

টিপু ও প্রীতি হত্যার ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ

অনুসন্ধানের এ পর্যায়ে আচমকা কাকতালীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ক্লু পান গোয়েন্দারা। অভিযানে থাকা গোয়েন্দা কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জয়পুরহাট, বগুড়া থেকে যিনি ঢাকায় আসছিলেন তার মোবাইলে একজন কল দিয়ে বলে, ‘‘ও কই?’’ জবাবে সে বলে, ‘‘আমার সাথে নাই।’’ এই বলেই সে ফোন কেটে দেয়।

‘এর পাঁচ মিনিট পরে আবার তার মোবাইলে একই নম্বর থেকে কল আসে। অপর প্রান্ত থেকে বলা হয়, ‘‘দিনা (শ্যুটার আকাশের স্ত্রী) বারবার ফোন দিচ্ছে, ও মনে হয় সন্দেহ করছে গতকালের ঘটনা নিয়ে।” এরপরেই আবার ফোন কেটে যায়। এর ১০ মিনিট পরে আবার একই নম্বর থেকে কল করে বলা হয়, ‘‘দিনা বারবার ফোন দিচ্ছে, আমি কী বলব?” তখন শ্যুটারের সঙ্গীর প্রান্ত থেকে বলা হয়, ‘‘তুই ২০ হাজার টাকা নিয়ে বাসা ভাড়া দিয়ে আয়।”

এই কথোপকথন শোনার পরেই আসল শ্যুটারের বিষয়ে নিশ্চিত হয় গোয়েন্দা পুলিশ। এরপর যাকে ২০ হাজার টাকা দিতে নির্দেশনা দেয়া হয়, তাকে শনাক্ত করে হেফাজতে নেয়া হয়।

গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ‘দিনাকে টাকা দিয়ে ফেরার সময় আমরা ওই ব্যক্তিকে ধরে ফেলি। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে সে জানায়, দিনা তাকে বলেছে টিভিতে টিপু হত্যার যে সিসিটিভি ফুটেজ দেখানো হচ্ছে সেখানকার শ্যুটারকে তার স্বামী আকাশের মতো মনে হচ্ছে। তাই আকাশ কোথায় সেটা জানতে বারবার দিনা তাকে ফোন করছে।’

পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে গোয়েন্দারা এরপর রাজধানীর বাসাবো এলাকায় আকাশের স্ত্রী দিনার বাড়িতে গিয়ে তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তবে দিনার কাছ থেকে আকাশের অবস্থানের বিষয়ে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

সন্দেহভাজন শ্যুটার মাসুম মোহাম্মদ আকাশ। ছবি: সংগৃহীত

গোয়েন্দারা দিনার কাছ থেকে আকাশের একটি ছবি পান। ঠিক সে সময় তথ্য আসে জয়পুরহাট, বগুড়া ঘুরে আসা ব্যক্তি ঢাকায় চলে এসেছেন। এরপরেই গোয়েন্দাদের একটি টিম তাকে নিজ বাসার সামনে ধরে নিজেদের হেফাজতে নেয়। ওই ব্যক্তির কাছেই পাওয়া যায় বগুড়ার একটি হোটেলে আকাশের অবস্থানের তথ্য।

ওই কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওই ব্যক্তিকে নিয়ে আমরা শ্যুটার আকাশকে ধরতে বগুড়ার দিকে রওনা হই। মাঝপথে মতিঝিল গোয়েন্দা বিভাগের মাথায় আসে, তারা যেতে যেতেই আকাশ বগুড়া ছেড়ে পালালে তাকে ধরা কঠিন হয়ে যাবে। তাই তারা আকাশের ছবিসহ বিস্তারিত তথ্য পাঠিয়ে দেয় বগুড়ার এসপি সুদীপ কুমার চক্রবর্তীর কাছে।’

এরপর বগুড়া পুলিশ শহরের চারমাথা এলাকার আবাসিক হোটেল খাজা থেকে আকাশকে গ্রেপ্তার করে। আকাশ হোটেলটির দ্বিতীয় তলার ১০১ নম্বর কক্ষে ‘মামুন’ পরিচয়ে অবস্থান করছিলেন। এক বাল্যবন্ধুর মাধ্যমে হোটেলটিতে উঠেছিলেন তিনি।

বগুড়া পুলিশের উপপরিদর্শক খোরশেদ আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঘটনার পরপরই ২৫ মার্চ বগুড়ার ওই হোটেলে আসেন আকাশ। ২৬ মার্চ ঢাকার ডিবি অফিসের এডিসি শাহিদুর রহমান স্যার বগুড়া পুলিশকে আকাশের ছবি পাঠান। তিনি জানান, শহরের সাতমাথায় খাজা নামের কোনো জায়গাতে শ্যুটার আকাশ অবস্থান করছেন। এ তথ্য জানার পরই খাজার সন্ধান শুরু করে বগুড়া পুলিশ।

‘একপর্যায়ে চারমাথা এলাকায় খাজা আবাসিক হোটেলের সন্ধান পাওয়া যায়। পরে দ্রুত তাকে গ্রেপ্তার করে ঢাকার গোয়েন্দা দলের কাছে হস্তান্তর করা হয়।’

ঢাকায় ফেরার পথে দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত গোয়েন্দা পুলেশের মাইক্রোবাস

আকাশকে গ্রেপ্তার অভিযানে বগুড়ায় যাওয়া গোয়েন্দা পুলিশের দল ছিল চারটি মাইক্রোবাসে। ফেরার সময় বহরের একটি মাইক্রোবাস দুর্ঘটনায় পড়ে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আসামিকে নিয়ে আমরা ঢাকায় ফেরার পথে ভয়াবহ দুর্ঘটনার মুখোমুখি হই। আমাদের বহরটি টাঙ্গাইল বাইপাসের কাছে পৌঁছালে সামনের গাড়িটি একটু স্লো করে। এ সময় পেছনের গাড়িগুলোও স্লো করা হয়। তখনই বহরের পেছনের মাইক্রোবাসের পেছনে একটি বাস সজোরে আঘাত হানে। এতে আমাদের ৫-৬ জন গোয়েন্দা কর্মকর্তা গুরুতর আহত হন। তারা এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।’

ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘সর্বোচ্চ সতর্কতার পরেও গ্রেপ্তার হওয়ায় আকাশ বিস্মিত হয়ে পড়ে। মতিঝিল বিভাগের গোয়েন্দা দল যখন প্রথম মুখোমুখি হয় তখন আকাশের প্রশ্ন ছিল, স্যার, আমি তো এই কাজে কোনো ভুল করি নাই, আপনারা আমাকে আইডেন্টিফাই করলেন কীভাবে?’

পুলিশের গাড়িকে ধাক্কা দেয়ার পর সড়ক বিভাজকে উঠে যাওয়া বাস

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে রোববার সংবাদ সম্মেলনে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার সাংবাদিকদের বলেন, ‘ঘটনার পর একটি গাড়ি নিয়ে আকাশ জয়পুরহাটে চলে যায়। পুলিশ নানা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ওই গাড়ির সংশ্লিষ্টদের আটক করে তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে জয়পুরহাটে আকাশের অবস্থান নিশ্চিত হয়।

‘দেশ ছেড়ে পালাতে সে জয়পুরহাটে অবস্থান করছিল। তবে পরে সে জয়পুরহাট থেকে বগুড়া শহরে আসে। সেখান থেকে বগুড়া জেলা পুলিশ সুপারের সহযোগিতায় গোয়েন্দারা তাকে আটক করে।’

এ বিভাগের আরো খবর