রাজধানীতে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যা মিশনে অংশ নেয়া সন্ত্রাসীরা গুলি চালনায় সুদক্ষ। প্রধান শ্যুটারের বাম হাতে চালানো স্বয়ংক্রিয় পিস্তলের গুলিতে নিহত হন টিপু। এ সময় এলোপাতাড়ি গুলিতে রিকশা আরোহী কলেজছাত্রী সামিয়া আফরান প্রীতিও প্রাণ হারান।
প্রধান শ্যুটার দাবি করে মাসুম মোহাম্মদ আকাশকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের মতিঝিল বিভাগ। আকাশকে শনিবার রাতে বগুড়া থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
রাজধানীর শাহজাহানপুর আমতলা মসজিদ এলাকার মূল সড়কে গত ২৪ মার্চ রাত সাড়ে ১০টার দিকে টিপুকে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। টিপুর গাড়ি এ সময় যানজটে আটকে ছিল। পেছনে মোটরসাইকেলে অনুসরণ করা সন্ত্রাসীরা তখন গুলি চালায়।
তদন্তকারীরা বলছেন, টিপুকে তার মালিকানাধীন গ্র্যান্ড সুলতান রেস্তোরাঁয় আগের দিনই হত্যার টার্গেট নেয় সন্ত্রাসীরা। তবে এজিবি কলোনি বাজারের ওই রেস্তোরাঁয় ভিড় থাকায় পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। পরদিন ২৪ মার্চও রেস্তোরাঁয় হত্যার পরিকল্পনা ছিল, তবে টিপু আগে বেরিয়ে যাওয়ায় তাকে রাস্তায় গুলি করা হয়।
সন্দেহভাজন প্রধান শ্যুটার আকাশ গ্রেপ্তার হওয়ার পর গোয়েন্দাদের এমন তথ্য দিয়েছেন।
টিপু ও প্রীতি হত্যার পর ঘটনার মোটিভের পাশাপাশি জড়িতদের চিহ্নিত করার কাজ শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর একাধিক সংস্থা। আশপাশের বিভিন্ন ভবনের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়। এসব ফুটেজের বিশ্লেষণে খুনিদের গতিপথ সম্পর্কে অনেকটাই নিশ্চিত হন তদন্তকারীরা।
টিপুর গ্র্যান্ড সুলতান রেস্তোরাঁর বিপরীত দিকের একটি তৈজসপত্র সামগ্রী বিক্রির দোকানের সিসিটিভি ফুটেজ যাচাই করেছেন গোয়েন্দারা। এতে দেখা যায়, ২৪ মার্চ রাত ১০টার দিকে টিপু ও তার দুই বন্ধু রেস্তোরাঁর সামনে সড়কে পার্ক করে রাখা সাদা রঙের মাইক্রোবাসটিতে চড়ছেন। ঠিক সে সময় রাস্তার বিপরীতে পার্ক করে রাখা একটি সাদা রঙের প্রাইভেট কারের পেছনে হত্যাকারীদের মোটরসাইকেল এসে থামে। টিপুর গাড়িটি চলতে শুরু করলে মোটরসাইকেল ঘুরিয়ে এর পিছু নেয় হত্যাকারীরা।
টিপুর গাড়িচালক মনির হোসেন মুন্না নিউজবাংলাকে জানান, রেস্তোরাঁ বন্ধ করে বাসায় যাওয়ার জন্য টিপু গাড়ির সামনের আসনে বসেন, আর পেছনের আসনে ছিলেন তার দুই বন্ধু। প্রতিদিনের মতো এজিবি কলোনি বাজার থেকে ডান দিকের রাস্তা ধরে আইডিয়াল স্কুলের সামনে দিয়ে গিয়ে শাহজাহানপুর মির্জা আব্বাস ডিগ্রি কলেজের গলি দিয়ে খিলগাঁও রেলগেটের দিকে এগোয় গাড়িটি। এ সময় কেউ গাড়ি অনুসরণ করছে বলে মনে হয়নি মুন্নার।
মুন্নার মতোই তথ্য জানান টিপুর বন্ধু মিজানুর রহমান মিরাজ। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা তো অন্যান্য স্বাভাবিক দিনের মতোই গাড়িতে চড়লাম। কোনো মোটরসাইকেল আলাদাভাবে আমার চোখে পড়েনি।’
শাহজাহানপুর-খিলগাঁও সড়কে উঠে টিপুর গাড়ি রেলগেটের দিকে এগোলে সামনে গাড়ির জট দেখে হত্যাকারীদের মোটরসাইকেলটি উল্টোপথে কিছুটা রাস্তা এগিয়ে গিয়ে আবার ঘুরিয়ে দাঁড় করানো হয়। এরপর শ্যুটার রাস্তা পার হয়ে গিয়ে ৩০ সেকেন্ডে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে পালিয়ে যায়।
গাড়িচালক মুন্না নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শ্যুটার আমাদের গাড়ির সামনে দিয়ে ঘুরেই ভাইয়ের (টিপু) সিটের পাশে যায়। তখনও কিছুই বুঝি নাই। ভাইয়ের জানালার গ্লাসের সামনে এসে কিসের যেন একটা চেইন খুলে অস্ত্র বের করল। এটা দেখে আমি আর ভাই ওর দিকে তাকাইছি, এর মধ্যেই প্রথম গুলিটা করে দিছে। ওইটা গ্লাস ভেঙে আমার ডান হাতে লাগে। গুলির সঙ্গে সঙ্গে আমি গাড়ি টান দিয়ে একটু সামনে গিয়ে রিকশার কারণে আটকা পড়ে গেলাম। তখন একটা রিক্শাতেও আমাদের গাড়ির ধাক্কা লাগে।
‘ও (শ্যুটার) পিছে থেকে দৌড়াই আইসা আবার গুলি করল। এরপর আবার আমাদের গাড়ির সামনে দিয়েই রাস্তার ডিভাইডার পার হয়ে চলে যায়।’
মুন্নার বক্তব্যের সঙ্গে ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজের মিল পাওয়া গেছে।
ডিএমপির মতিঝিল বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রথম আমরা যে ফুটেজটা পাই তাতে পুরো হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটা বোঝা যায়। ওই ফুটেজ বিশ্লেষণ করে আমরা প্রথমে নিশ্চিত হই মিশনে থাকা দুইজন এসেছিল উল্টোপথে একটি মোটরসাইকেলে করে। একইভাবে ওই ফুটেজে শ্যুটারের বুকে ঝোলানো ব্যাগ আর জামাকাপড়ের রং দেখে আমরা টার্গেট লক করি।
‘এরপর একটার পর একটা ফুটেজে ওই মোটরসাইকেলে ট্রাভেলের একটা রোডম্যাপ পাওয়া যায়। দেখা গেছে এজিবি কলোনি বাজারের মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটের গ্র্যান্ড সুলতান রেস্তোরাঁ থেকে টিপুর গাড়িটিকে অনুসরণ করা হয়েছে। হত্যার উদ্দেশ্যেই টিপুর রেস্তোরাঁর সামনে গিয়েছিল তারা, কিন্তু ততক্ষণে টিপুর গাড়ি চলতে শুরু করায় তখন সেটি সফল হয়নি, সুযোগ পেলে সেখানেই মিশন শেষ হতো।’
এর আগে রোববার ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আকাশকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান এ কে এম হাফিজ আক্তার। তিনি জানান, ‘এই হত্যার জন্য আকাশের সঙ্গে কনট্রাক্ট হয় ঘটনার পাঁচ দিন আগে। তিন দিন আগে এই মিশনের জন্য কমলাপুরের ইনল্যান্ড ডিপো এলাকায় নির্দেশদাতাদের পক্ষ থেকে একটি গুলিভর্তি অস্ত্র ও একটি মোটরসাইকেল দেয়া হয়। হত্যার আগের দিন মিশন চালানোর পরিকল্পনা নিয়ে এজিবি কলোনিতে অবস্থান করছিল আকাশ। তবে সেদিন সুযোগ না হওয়ায় পরদিন হত্যা করা হয়।’
টিপু হত্যার পর ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, শ্যুটার বাম হাতে শুটিংয়ে অভ্যস্ত। ফুটেজটি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, শ্যুটার বাম হাত ব্যবহার করে গুলি ছুড়ছে এবং পালিয়ে যাওয়ার সময়ও পিস্তলটি তার বাম হাতে দেখা যায়। আকাশ গ্রেপ্তার হওয়ার পর এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে নিশ্চিত করেন, আকাশ গুলি চালনায় খুবই দক্ষ। দুই হাতেই তিনি অস্ত্র চালাতে পারেন, তবে বাম হাতের ব্যবহার বেশি করেন।
৭.৬৫ এমএম ক্যালিবার পিস্তলে হত্যা
টিপুকে হত্যায় আকাশ সরবরাহ করা অস্ত্রটি ছিল ৭.৬৫ মিলিমিটার ক্যালিবারের একটি অটোমেটিক পিস্তল। এতে দুই চেম্বার ও ১৬ রাউন্ড গুলির ম্যাগাজিন ছিল। ঘটনাস্থল থেকে একটি আস্ত গুলিসহ মোট ১২ রাউন্ড গুলির খোসা উদ্ধার করে সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট।
পুলিশ ও গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়েছেন, বুলেটগুলো ৭.৬৫ এমএম পিস্তলের। গোয়েন্দা পুলিশ ও মতিঝিল বিভাগের একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তারা বলেন, অটোমেটিক ট্রিগার প্রযুক্তির এই অস্ত্রের বৈশিষ্ট্য হলো অস্ত্রটি একবার লোড করে ট্রিগার চেপে ধরে রাখলে ধারাবাহিকভাবে একটার পর একটা বুলেট নিক্ষিপ্ত হয়। আবার ট্রিগার ছেড়ে দিলেই বুলেট নিক্ষেপ বন্ধ হয়ে যায়। অস্ত্রটি অটোমেটিক হওয়ায় মাত্র ৫ থেকে ৭ সেকেন্ডের মধ্যে ১২ রাউন্ড বুলেট ছুড়তে পেরেছিলেন শ্যুটার।
আকাশ গ্রেপ্তারের পর ডিবি প্রধান সংবাদ সম্মেলনে জানান, হত্যা মিশনের পর অস্ত্রটি হাতবদল হওয়ায় সেটি এখনও জব্দ করা যায়নি।
নিউজবাংলার অনুসন্ধান বলছে, বৃহত্তর মতিঝিল এলাকার ১০ জন শ্যুটারের জন্য ছয় মাস আগে ১০টি অবৈধ ৭.৬৫ এমএম অটোমেটিক পিস্তলের জোগান এসেছে। ভারত থেকে আনা প্রতিটি অস্ত্রের সঙ্গে ৪ রাউন্ড করে বুলেট ছিল। কমলাপুরে যে অস্ত্রটি শ্যুটার আকাশের হাতে তুলে দেয়া হয় সেটি ওই ১০টি অস্ত্রের একটি হতে পারে।