ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় একটি বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। কাজ শেষ না করেই টাকা তুলে নেয়া, ফাটল ও টাইলস উঠে যাওয়া অবস্থায় স্থানীয় সরকারকে বুঝিয়ে দেয়ার অভিযোগ তুলেছেন এলাকার লোকজন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় লোকজনের প্রতিবাদের মুখে নতুন করে সংস্কারকাজ শুরু করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স নাঈমা এন্টারপ্রাইজ। অবশ্য প্রতিষ্ঠানটির দাবি, তারা কাজ শেষ করে বুঝিয়ে দিলেও দীর্ঘদিন অরক্ষিত থাকায় স্মৃতিস্তম্ভটির এমন অবস্থা।
মুক্তাগাছার কুমারগাতা ইউনিয়নের আয়মন নদীর তীরে ডৌয়াখোলায় একটি ময়লার ভাগাড় ভরাট করে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভটি।
২০২০-২১ অর্থবছরে ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে কাজ শেষ করে গণপূর্তকে বুঝিয়ে দেয় নাঈমা এন্টারপ্রাইজ। পরে কাজটি বুঝে নিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে চিঠি দেয় গণপূর্ত বিভাগ। চিঠি পেয়ে ইউএনও গিয়ে দেখেন নির্মাণ শেষ করা হয়নি, কিন্তু চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, কাজ শেষ। কাজ বুঝে না নিলেও তখনই প্রায় ৫৬ লাখ টাকা তুলে নেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি।
২০২০-২১ অর্থবছরে ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণকাজ শুরু হয় স্মৃতিস্তম্ভের। ছবি: নিউজবাংলা
স্মৃতিস্তম্ভের বিভিন্ন অংশে ফাটল দেখা দেয়ায় সেটি মেরামতের দাবি করেন এলাকাবাসী। পরে গণপূর্ত বিভাগ প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে নাঈমা এন্টারপ্রাইজকে অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময় দেয়।
স্থানীয়রা জানান, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ওই স্থানে তিন শতাধিক মানুষকে হত্যা করে ফেলে রেখে যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। সেসব শহীদের স্মরণে স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে নির্মাণ করা হয় স্মৃতিস্তম্ভটি।
তাদের দাবি, নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে কোনো রকমে এটি নির্মাণ করা হয়েছে। নির্মাণের নামে সরকারি টাকা হরিলুট করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের তদারকির অভাবেই এমনটি হয়েছে।
আব্দুর রহমান নামের একজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, ‘এটি নির্মাণে কোনো আন্তরিকতা ছিল না৷ শুরু থেকেই নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করার অভিযোগ তোলা হয়েছে। কিন্তু কেউ কর্ণপাত করেনি। ইচ্ছেমত কাজ করে টাকা উত্তোলন করেছে ঠিকাদার।’
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাসেম বলেন, ‘নকশা অনুযায়ী স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়নি। যেখানে টাইলস দেয়ার কথা সেখানে দেয়া হয়নি, কাজে যথেষ্ট ত্রুটি রয়েছে। আবারও শুরু হওয়া সংস্কারকাজ ভালোভাবে সমাপ্ত না করলে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাসহ এলাকার লোকজন আন্দোলনে নামবে।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নাঈমা এন্টারপ্রাইজের পরিচালক আব্দুল মোমেন খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে কাজ শেষ করে গণপূর্তকে বুঝিয়ে দিয়েছি। তখন প্রায় ৫৬ লাখ টাকা তুলেছি। আমার কাজে কোনো অনিয়ম হয়নি।’
তাহলে এখন আবার সংস্কারের কারণ কী, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকার কারণে স্মৃতিস্তম্ভটি মাদকসেবীদের নিরাপদ স্থানে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তারা আড্ডা দেয়। এতে টাইলসসহ স্তম্ভের বিভিন্ন ক্ষতি হয়েছে। গণপূর্ত থেকে বলার কারণে শ্রমিক দিয়ে সেগুলো মেরামত করা হচ্ছে।’
স্মৃতিস্তম্ভের বিভিন্ন অংশে ফাটল দেখা দেয়ায় সেটি মেরামতের দাবি করেন এলাকাবাসী। ছবি: নিউজবাংলা
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল্লাহ আল মনসুর বলেন, ‘গণপূর্ত থেকে চিঠি পাওয়ার পর আমি স্মৃতিস্তম্ভে গিয়ে দেখি গেট ভাঙা, টাইলস লাগানোই হয়নি। বিভিন্ন জায়গায় পলেস্তারাও করা হয়নি। সে অবস্থায় বুঝে নেয়া সম্ভব ছিল না।’
তিনি বলেন, ‘তখন কোনো কর্মকর্তা সেটি বুঝিয়ে দিতে আমার কাছে আসেননি। তবুও আমি গণপূর্তকে বলেছি, নকশা ও প্রাক্কলন অনুযায়ী স্তম্ভটি আমাকে বুঝিয়ে দিন, আমি বুঝে নেব। কিন্তু তারা প্রকল্পের ব্যয়সহ কিছু জানায়নি।’
ইউএনও আরও বলেন, ‘এখন কাজটি শেষ করতে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৩ সাল পর্যন্ত করা হয়েছে। মানে কাজ অসমাপ্ত ছিল।’
প্রকল্পটি তদারকির দায়িত্বে ছিলেন গণপূর্ত বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী মোস্তাক আহমেদ। অভিযোগের বিষয়ে নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘কাজটি সম্পূর্ণ শেষ করেই উপজেলা প্রশাসনকে বুঝে নিতে চিঠি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা বুঝে নেয়নি।’
তার দাবি, বুঝে না নেয়ায় অরক্ষিত থাকায় গেট ভেঙে গেছে, টাইলস উঠে গেছে। সেগুলোসহ আরও কিছু কাজ করতে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
নির্মাণ শেষ না করে টাকা তুলে নেয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, 'কাজ শেষ হওয়ায় ঠিকাদার টাকা উত্তোলন করতে পেরেছে। এর চেয়ে বেশি কিছু আমার মনে নেই। নির্বাহী প্রকৌশলী স্যার সব বলতে পারবেন।’
এ বিষয়ে গণপূর্ত ময়মনসিংহ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদ আহসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি এখানে নতুন এসেছি। কী কারণে এমন হয়েছে তা জানার চেষ্টা চলছে। নির্মাণকাজে কোনো অনিয়ম হয়ে থাকলে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’