গরিব মানুষকে বিনা পয়সায় দাঁতের চিকিৎসা দেয়া আহমেদ মাহী বুলবুলকে ছুরিকাঘাত করার পর সঙ্গে সঙ্গেই ঘটনাস্থলের পাশের একটি হাসপাতালে নিয়ে যান কয়েকজন। সেখানে চিকিৎসা না দিয়ে ফিরিয়ে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে।
স্বজনরা অভিযোগ করেছেন, এই চিকিৎসককে চিকিৎসা না দিয়ে ফিরিয়ে দেয় মিরপুরের বেগম রোকেয়া সরণির আল হেলাল স্পেশালাইজড নামে সেই হাসপাতাল। যদিও হাসপাতাল বলছে, সেখানে নেয়ার আগেই মৃত্যু হয় বুলবুলের। আর পুলিশের উপস্থিতিতে তাকে পাঠানো হয় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। অবশ্য স্বজনদের বর্ণনা ও পুলিশের বক্তব্য অনেকটা একই রকম।
বুলবুল ছিলেন দন্ত চিকিৎসক। পাশাপাশি করতেন ঠিকাদারির কাজ। পথশিশুদের সেবায়ও তিনি ছিলেন অন্তপ্রাণ। গড়ে তুলেছিলেন একটি সংগঠন। এসব কাজে প্রায়ই এখানে-সেখানে দৌড়াদৌড়ি করতে হতো তাকে।
রোববার ভোর সাড়ে ৫টায় দুই সন্তানের জনক বুলবুল তার বাসা শ্যাওড়াপাড়া থেকে বের হন নোয়াখালী যাবেন বলে। অন্য একজন প্রকৌশলীও সঙ্গে যাবেন এমন কথা ছিল। কিন্তু আর কোথাও যাওয়া হয়নি বুলবুলের। জীবনের চাকা থেমে গেল ছুরির আঘাতে।
পুলিশ ও স্বজনরা জানান, কাজীপাড়াতেই তিনজন সন্দেহভাজন ছিনতাইকারী ঘিরে ধরে বুলবুলকে। করে ছুরিকাঘাত।
মেয়েকে নিয়ে দন্ত চিকিৎসক বুলবুল। ছবি: সংগৃহীত
সুরতহাল প্রতিবেদনে দেখা যায়, বুলবুলের ডান পায়ের ঊরুতে আনুমানিক এক ইঞ্চি জখম। তাছাড়া শরীরের অন্যান্য অংশে কোনো আঘাত নেই।
ঊরুর এই একটি আঘাতেই মৃত্যুর কারণ হিসেবে চিকিৎসক পরিবারটিকে জানিয়েছেন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কথা।
চাচাতো ভাইয়ের বর্ণনা
বুলবুলের চাচাতো ভাই জাহাঙ্গীর আলম জানান, মিরপুরের কাজীপাড়া মেট্রোরেল স্টেশনের ২৭৮ নম্বর পিলারের পশ্চিম পাশে মূল রাস্তায় বুলবুলকে ঘিরে ধরে কয়েকজন ছিনতাইকারী। সেখানে টাকা নিয়ে টানাটানির একপর্যায়ে ঊরুতে ছুরিকাঘাত করে তারা।
পুলিশ জানায়, আসামিরা বুলবুলকে ছুরিকাঘাত করে পূর্ব কাজীপাড়ার দিকে দৌড়ে পালিয়ে যায়।
জাহাঙ্গীর বলেন, ‘বুলবুল অটোরিকশায় করে বাসা থেকে কাজীপাড়ার দিকে যায়। তাকে তিনজন ফলো করে। ঘটনাস্থলে গেলে তার কাছ থেকে টাকা নেয়ার জন্য আটকায়। টাকা নিয়ে টানাটানির একপর্যায়ে তাকে ছুরিকাঘাত করে।’
সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে আসে একটি বাস ও অটোরিকশা। বাসের চালক ও সহকারী এবং অটোর চালক ছুটে আসতেই টাকা-পয়সা না নিয়ে পালিয়ে যায় ছিনতাইকারীর দল।
জাহাঙ্গীর জানান, তিনজনে মিলে ধরাধরি করে বুলবুলকে পাশের আল হেলাল স্পেশালাইজড হাসপাতালে নিয়ে যায়। এই অবস্থাতেও হাসপাতালে চিকিৎসা না দিয়ে ফিরিয়ে দেয়া হয় বুলবুলকে।
নিহত চিকিৎসকের ভাই বলেন, ‘বুলবুল মরেছে আল হেলাল হাসপাতালের গাফিলতির কারণে। তাকে তারা ভর্তি করে নাই। আল হেলালে নিয়ে যাওয়ার সময় বুলবুলের জ্ঞান ছিল, শ্বাস নিচ্ছিল। হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে তাকে ভর্তি করলে ও প্রাথমিক চিকিৎসা দিলে সে মরত না। সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যালে নেয়ার পথেই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর জন্য আল হেলাল হাসপাতালও দায়ী।’
রাজধানীর কাজীপাড়া এলাকার মেট্রোরেলে এই পিলারের সামনেই ঘটে ছুরিকাঘাতের ঘটনা। ছবি: নিউজবাংলা
বুলবুলের কাছে ১২ হাজারের মতো টাকা ও তার ফোন নিতে পারেনি দুর্বৃত্তরা। পুলিশ এই ফোন দিয়েই এই চিকিৎসকের পরিবারকে সংবাদ দেয়।
স্বীকার করেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ
মরণাপন্ন রোগীকে চিকিৎসা না দিয়ে ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়ে জানতে হাসপাতালের ওয়েবসাইটে থাকা ফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলে তারা কথা বলিয়ে দেন হাসপাতাল পরিচালক আবু শামীমের সঙ্গে, যিনি নিজেও একজন চিকিৎসক এবং অধ্যাপকও।
বুলবুলের পরিবারের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পুরোটাই অস্বীকার করে উল্টো বর্ণনা দেন আল হেলাল পরিচালক। তিনি বলেন, ‘ওরা যখন নিয়ে আসে, আমি পুরা দেখলাম, আমার পুরা টিম ওখানে চলে গেছে। ডাক্তার ও নার্স তাকে এক্সামিন (পরীক্ষা-নিরীক্ষা) করে দেখে, অনেক আগে মারা গেছে। মিনিমাম হাফ এন আওয়ার আগে।
‘পরে পুলিশ এসেছে, পুলিশের উপস্থিতিতে তাকে সোহরাওয়ার্দী হাসতাপালে পাঠিয়ে দিই।’
অধ্যাপক শামীমের দাবি, পুরো ঘটনা সিসি ক্যামেরায় ধারণ করা আছে, সেটি পরীক্ষা করলেই পরিবারের বক্তব্য সঠিক কি না তা জানা যাবে।
এই ফুটেজ পাওয়া যাবে কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি তো আগামীকাল থাকব না। আমার টেকনিশিয়ান আছে। তারা পারবে কি না…।’
স্বজনদের অভিযোগের সঙ্গে মেলে পুলিশের বর্ণনা
জাহাঙ্গীর জানান, যে তিনজন বুলবুলকে আল হেলাল হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন তারা সেখানে চিকিৎসা না পেয়ে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন দেন।
আল হেলাল হাসপাতাল কাফরুল থানা এলাকায় হওয়ায় সেখানে প্রথমে যায় কাফরুল থানা পুলিশ।
কাফরুল থানার উপপরিদর্শক শ্যামল কুমার হালদার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি ডা. বুলবুলকে প্রথমে পেয়েছি আল হেলাল হাসপাতালের সামনে। সঙ্গে প্রত্যক্ষদর্শী তিনজন ছিলেন। তারা বুলবুলকে ঘটনাস্থল থেকে নিয়ে আসেন। আল হেলালের কর্তৃপক্ষ নাকি তাদের বলেছে, প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এ কারণে উন্নত চিকিৎসার জন্য শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে।
‘সেখান থেকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক পরীক্ষা করে বুলবুলকে মৃত ঘোষণা করেন।’
তাৎক্ষণিকভাবে কাফরুল থানা থেকে পুলিশ এলেও ঘটনাস্থল পড়েছে মিরপুর মডেল থানার অধীনে। পরে বিষয়টির ভার নেয় এই থানা।
মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাজিরুর রহমান বলেন, ‘ডা. বুলবুলকে প্রথম চিকিৎসা দেয় নাই। ৮টায় পুলিশ জানতে পারে। প্রথমে কাফরুল থানার পুলিশ হাসপাতালে নিয়েছে। পরে আমরা গেছি।’
জড়িত তিনজন
বুলবুলকে ছুরিকাঘাতে তিনজনের সম্পৃক্ততা পাওয়ার কথা জানিয়েছে পুলিশ।
ঢাকা মহানগর পুলিশের মিরপুর বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে ছিনতাইকারী মনে হচ্ছে।’
একই বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) আ স ম মাহাতাব উদ্দিন বলেন, ‘একজন ডাক্তার এভাবে মারা গেছেন, এটা খুবই মর্মান্তিক। আমরা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি। আশা করি শিগগিরই আসামিদের গ্রেপ্তার করতে পারব।’
পথশিশুদের সঙ্গে দন্ত চিকিৎসক বুলবুল। ছবি: সংগৃহীত
১০ বছরের সংসারে দুই সন্তান
এক দশক আগে বুলবুল বিয়ে করেন শাম্মী আহমেদকে। তিনি ‘ভূমি’ নামে একটি এনজিও দেখাশোনা করেন।
এই দম্পতির দুটি সন্তান আছে। বড় মেয়ে আওনের বয়স বয়স ৬, ছেলে সামির জন্ম বছর দেড়েক আগে হয়েছে।
বুলবুলের শ্বশুর ইয়াকুব আলী জানান, সোমবার সকাল ১০টায় রংপুরে গ্রামের বাড়িতে বুলবলকে সমাহিত করা হবে।