করোনাভাইরাসের ধাক্কা সামলে আগের রূপে ফিরতে শুরু করেছে দেশ। টানা দুই বছরে ধরে লকডাউন, শাটডাউন, বিধিনিষেধ ধকল কাটিয়ে স্বাভাবিক রূপে ফিরেছে দেশ।
খুলে গেছে প্রাক-প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব শ্রেণিকক্ষ। অফিস-আদালত চলছে স্বাভাবিক গতিতে। পর্যটন কেন্দ্রগুলোও মানুষের সরব উপস্থিতিতে মুখর। সড়ক, রেল, নৌ, আকাশ পথে যাতায়াতেও নেই কোনো শর্ত, নেই কোনো বিধিনিষেধ। বাজার, দোকানপাট, শপিংমলগুলোতেও ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড়। সময়সীমা মেনে চলার কোনো বালাই নেই।
করোনাকালের নতুন টার্ম ‘নিও নরমাল লাইফ’ বা ‘নতুন স্বাভাবিক জীবন’-এ গত দুই বছরের ধরে শুনতে থাকা ‘সীমিত পরিসরে’ শব্দটি থেকেও মুক্তি পেয়েছে দেশের মানুষ।
দুই বছরে করোনাভাইরাসের লাগামা টেনে ধরা সম্ভব হওয়ায়, এখন শুধু সংক্রমণ ঠেকাতে মাস্ক পরার ওপরই গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার।
২০২০ সালের ৮ মার্চের কথা। গোটা বিশ্ব তখন করোনাভাইরাসের আতঙ্কে ভুগছিল। সেদিন বাংলাদেশেও থাবা বসায় করোনা। শনাক্ত হয় রোগী।
এরপর আর ঠেকিয়ে রাখা যায়নি ভাইরাসটিকে। সংক্রমণ ছড়াতে ছড়াতে পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়ে প্রাণঘাতী ভাইরাসটি।
শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায় ২০২০ সালের ১৭ মার্চ বন্ধ করা হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয় লকডাউন। সড়কে মানুষের অযাচিত উপস্থিতির ওপর চলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি।
প্রথম দফায় দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর প্রায় ১০ মাস পর ২০২১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি তা নিয়ন্ত্রণে আসে। শুরুর কয়েক মাসে পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে ছিল। কিন্তু মে-জুনে এসে বদলে যায় দৃশ্যপট।
২০২১ সালের মার্চের শেষে আবার দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানে। সেটি নিয়ন্ত্রণে আসে গত ৪ অক্টোবর। দেশে দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণে আসতে সময় লাগে ৬ মাস।
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স রুনু ভেরোনিকা কস্তাকে টিকা দেয়ার মধ্য দিয়ে দেশে শুরু হয় করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে টিকা দেয়ার কর্মসূচি। যা এখনও চলমান।
প্রথম ডোজ, দ্বিতীয় ডোজ শেষে এখন বুস্টার ডোজ দেয়া হবে। ১৮ ঊর্ধ্ব নাগরিকদের সবাইকে টিকার আওতায় আনার ঘোষণা পর মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদেরও টিকা দিচ্ছে সরকার।
করোনাভাইরাসের প্রথম দুই ঢেউ যেভাবে আতঙ্ক ছড়িয়েছে, সে রকম হয়নি তৃতীয় ঢেউ। তুলনামূলক কম প্রাণঘাতী বলে এ নিয়ে ভীতিও ছিল বেশ কম। এর মধ্যে শুরু যায় করোনাপ্রতিরোধী টিকাদান কর্মসূচি।
করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন তুলনামূলক দুর্বল। বিষয়টি জানা গিয়েছিল শুরুতেই। ধরনটি ব্যাপক সংক্রামক হলেও আক্রান্তদের মধ্যে শারীরিক জটিলতা কম থাকায় মৃত্যু কম। একইভাবে এটি তুলনামূলক দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আসার ইঙ্গিতও মিলছে।
গত ২০ জানুয়ারি তৃতীয় ঢেউ নিশ্চিত হওয়ার পর আরও আট দিন সংক্রমণ ঊর্ধ্বগামী থাকার পর তা কমতে থাকে। এখন সেই তৃতীয় ঢেউ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শনাক্তের হার সর্বোচ্চ বা পিকে ওঠার পর দুই সপ্তাহ সেখানে অবস্থান করে ধীরে ধীরে তা নিম্নগামী হয়, কিন্তু এবার তা আরও আগেই নিম্নগামী হচ্ছে, যা বিশেষজ্ঞদের আশা দেখাচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বৃহস্পতিবারের হিসাব বলছে, নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার শূন্য দশমিক ৭৬ শতাংশে নেমে এসেছে, যা গত দুই বছরে সর্বনিম্ন।
করোনা মহমারিতে বিশ্ব অর্থনীতি বিপর্যস্ত হলেও বাংলাদেশ তা সামলে নিতে পেরেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার পাশাপাশি বেড়েছে মাথাপিছু আয়।
প্রথম দফায় প্রায় দেড় বছর বন্ধ থাকার পর গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করে শিক্ষাঙ্গনের দুয়ার।
করোনার তৃতীয় ঢেউ আঘাত হানলে আবারও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সশরীরে ক্লাস বন্ধ করা হয় এ বছরের ২১ জানুয়ারি। এ দফায় শিক্ষাঙ্গনে সশরীরে ক্লাস বন্ধ থাকে এক মাস। ২২ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষাঙ্গনগুলো আবার প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে। ২ মার্চ শুরু হয় প্রাথমিকে সশরীরে ক্লাস। টানা দুই বছর বন্ধের পর গত ১৫ মার্চ প্রাক-প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের সশরীরে ক্লাস শুরু হয়।
১২ বছর ঊর্ধ্বে স্কুল পড়ুয়াদেরও আনা হচ্ছে করোনাপ্রতিরোধী টিকার আওতায়।
করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর পর বৃহস্পতিবার প্রথম নিজ কার্যালয়ে সশরীরে কোনো অনুষ্ঠানে হাজির হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্বাধীনতা পুরস্কার বিজয়ীদের হাতে নিজে হাত পুরস্কার তুলে দিতেই ছুটে আসেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বহুদিন পরে মুক্তি পেলাম তো! আসলে করোনাভাইরাসের সময় তো একেবারে বন্দিখানায় ছিলাম। আজকে আমার একটা ইচ্ছা ছিল যে, এখানে এসে নিজের হাতে…স্বাধীনতা পুরস্কার এটা তো একবার দিতে পারিনি। বারবার তো এভাবে নিজেকে বঞ্চিত করতে পারি না।’
বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দিতে পারাটাও সম্মানের জানিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘আমি মনে করি, বহুদিন পর অফিসে আসার সুযোগ পেলাম। এত দিন ডিজিটাল পদ্ধতিতে অনলাইনে চালাচ্ছিলাম। সে জন্য বোধহয় একটু বেশি কথা বলে ফেললাম। আপনারা কিছু মনে করবেন না।’
করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে এর আগে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় এবং পটুয়াখালীর পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সশরীরে হাজির হয়েছিলেন সরকারপ্রধান।
এ ছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র, স্কটল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, মালদ্বীপ ও আরব আমিরাত সফর করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুসারে সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের বেশি থেকে এর নিচে নেমে গেলে সেটা যদি দুই সপ্তাহ নিচেই থাকে তাহলে সেই অবস্থাকে বলা হয় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে। উল্টো পথে যাত্রা অর্থাৎ সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের ওপরে দুই সপ্তাহ থাকলে সেটাকে পরবর্তী ঢেউ আঘাত হেনেছে বলে ধরা হয়।
করোনার বিরুদ্ধে শক্তিধর অর্থনীতির দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের এই সন্তোষজনক অবস্থানের জন্য সরকারের নেয়া সিদ্ধান্তগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ মানছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজরি কমিটির সদস্য ও জ্যেষ্ঠ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আবু জামিল ফয়সাল মনে করেন, এই সাফল্যের বেশ কিছু কারণ রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘কারণ একটি নয়, অনেকগুলো কারণ আছে। আমাদের দেশে দেখছি মানুষ মাস্ক কম পড়েছে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনেছে। মানুষ সচেতন ছিল। মানুষ যতোটা পেরেছে এই রোগ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেছে।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঝিনাইদহ, নাটোরে সংক্রমণে ঠেকাতে সরকারের নেয়া পদক্ষেপ, টিকার সংস্থান করা, গণটিকা কর্মসূচিরও এই সাফল্যের অন্যতম কারণ বলেও মনে করেন এ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।
তিনি বলেন, ‘টিকা দেয়া হয়েছে, এটা ভালো দিক। এটাও একটা কারণ হতে পারে যে আমরা টিকা দিতে পেরেছি। যদিও সময় লেগেছে। কিন্তু টিকার তো একটা প্রভাব আছেই।’
দেশে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে এসেছে এমন কথা মানতে নারাজ রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন।
তিনি বলেন, ‘করোনা মহামারি তো এখনও শেষ হয়নি। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় করোনা মহামারি আছে। তাই এ কথা বলার সময় এখনও হয়নি। আমরা যতটুকু অগ্রাধিকার দিয়েছি ততটুকুই সফলতা পেয়েছি।’
করোনা শেষ না হওয়ার আগ পর্যন্ত কঠোর নজরদারি রাখতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।
মুশতাক হোসেন বলেন, ‘করোনা মহামারি যদি আবারও শুরু হয়, তখন আমাদের যেন বেগ পেতে না হয়, এ জন্য কঠোর নজরদারি বজায় রাখতে হবে। যত জায়গায় আমাদের ঘাটতি আছে তা পূরণে ব্যবস্থা নিতে হবে, না হলে এর শেষ ভালো হবে না। শেষের ধাক্কাও মারাত্মক হতে পারে।’
করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট তৈরি হওয়ারও আশঙ্কা করছেন এই বিশেষজ্ঞ।
তিনি বলেন, ‘নতুন ভ্যারিয়েন্ট তৈরি হলে যে কোনো মূহূর্তে সংক্রমণ আবারও ছড়িয়ে পড়তে পারে। নতুন ভ্যরিয়েন্ট না আসলেও সংক্রমণ শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যে আবারও সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে।’
এর কারণ ব্যাখ্যা করে ড. মুশতাক বলেন, ‘তিন মাসের বেশি সময় পর সংক্রমণ প্রতিরোধী ব্যবস্থার কার্যকারিতা কমে যায়। এখনও টিকা বা সংক্রমণের কারণে পপুলেশন ইউমিনিটি তৈরি হয়নি। তবে এটা ঠিক টিকা দেয়ায় গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তিদের মৃত্যু হার ঠেকানো গেছে। এ সফলতা বিশ্ববাসীর আছে।’