সংবাদকর্মী আহমেদ রাজু ও তার স্ত্রী ভোটার হয়েছেন রাজধানীর মোহাম্মদপুরে। এখন থাকেন কেরানীগঞ্জে। এই দম্পতির বড় সন্তান রাজিন রেহানের বয়স ২২ বছর। চার বছর আগে ভোটার তালিকায় নাম নিবন্ধনের বয়স হলেও এখন পর্যন্ত ভোটার হতে পরেননি তিনি।
রেহানের ব্যাংক হিসাব খোলা, নিজের নামে সিম কার্ড কেনাসহ নানা বিষয় আটকে যাচ্ছে নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে না পারায়।
জটিলতা কোথায়, সেটি জানালেন রেহানের বাবা আহমেদ রাজু। তিনি বলেন, ‘তিন বছর ধরে আমরা কেরানীগঞ্জের আটিবাজার থাকছি। অনলাইনে আবেদন করে নির্বাচন অফিসে যোগাযোগ করার পর দায়িত্বরত ব্যক্তি বললেন, ছেলের জন্মনিবন্ধনের সনদ আর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের প্রশংসাপত্র নিয়ে আসলে করে দেব।
‘নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী, তিন বছর থাকলে সেখানে সেই ব্যক্তিকে স্থায়ী বাসিন্দা ধরা হয়। তবে চেয়ারম্যান অফিস থেকে নানা টালবাহানা করে তারা বলছে, আমি এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা না, তাই তারা আমাকে ভোটার হতে দেবে না।’
আহমেদ রাজু বলেন, ‘ছয় দিন শাক্তা ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে পরে সেই প্রশংসাপত্র পেলাম, সেটারও অনেক ঝামেলা। তারা বলছে, যেখানে থাকেন সেই মেম্বারের সই লাগবে জন্মনিবন্ধন সনদের ওপর। তারপর বাড়ির বিদ্যুৎ বিলের কপি লাগবে।’
কিন্তু বিদ্যুৎ বিলের কপি পাওয়ার সুযোগ ছিল না। কারণ, রাজু যে বাসায় থাকেন, সেটিতে প্রিপ্রেইড মিটার বসানো। বিষয়টি জানানোর পর চাওয়া হলো গ্যাসের বিল। তবে তাতেও কাজ হয়নি।
কেরানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাচন অফিসের লোকজন রাজুকে জানান, তারা মোহাম্মদপুর থেকে ভোটার হয়েছেন, তাই তাকে সেখান থেকেই ভোটার হতে হবে।
তবে এই সংবাদকর্মী মোহাম্মদপুর অফিসে যাননি। কারণ হিসেবে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওখানে গিয়ে তো লাভ হবে না। আমি যেখানে থাকি, সেখানেই তো ভোটার হতে হবে।’
পরে নির্বাচন কর্মকর্তাদের কাছে ধরনা দিয়ে নানা কাগজপত্র নিয়ে যান ছেলেকে ভোটার করার আশায়। কিন্তু শেষে আটকে যান জন্মনিবন্ধন ইস্যুতে।
হঠাৎ করেই কয়েক কোটি জন্মনিবন্ধন সনদ বাতিল হয়ে গেছে। নির্বাচন অফিস থেকে রোহানের নম্বর দিয়ে সার্চ দিয়ে সার্ভারে সেটি পাওয়া যায়নি।
রাজু বলেন, ‘জন্মনিবন্ধনটা অনলাইনে করে নিয়ে আসতে বলেছিল। কিন্তু ২০১১ সালের আগে করা জন্মনিবন্ধনটা সার্ভার থেকে গায়েব হয়ে গেছে। ওই নম্বর দিয়ে পাসপোর্ট করা। নতুন করে করতে গেলে নম্বর পাল্টে যাবে।
‘নির্বাচন কমিশনে অনলাইনে যে আবেদন করেছি, সেখানেও জন্মনিবন্ধনের পুরোনো নম্বর দেয়া। নতুন করে জন্মনিবন্ধন করলে ভোটার হওয়ার আবেদনে দেয়া নম্বর কীভাবে পাল্টাব? একটা জটিল প্রক্রিয়া। তাই আর ছেলেকে ভোটার করতেই যাওয়া হচ্ছে না।’
রেহানের মতো বয়স হওয়ার পরও ১১ লাখ ১৪ হাজার ২২৯ জন ভোটার হতে পারছেন না। ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য অনলাইনে তারা আবেদন করলেও তা ঝুলে আছে। এসব আবেদন দ্রুত নিষ্পত্তি না করেই ভোটার উৎসব আয়োজন সেরে ফেলেছে সাংবিধানিক এ সংস্থাটি।
গত ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) মাসিক সমন্বয় সভার কার্যপত্রেও এই সমস্যার বিষয়টি উঠে এসেছে। এই কার্যপত্র অনুযায়ী কেবল ঢাকা অঞ্চলেই নতুন ভোটার হওয়ার আবেদন জমা পড়েছে ২ লাখ ৯ হাজার ৮৮টি। এর পরের অবস্থান কুমিল্লা অঞ্চলে। সেখানে ২ লাখ ২ হাজার ৬৮০টি আবেদন ঝুলে আছে।
ময়মনসিংহ অঞ্চলে আবেদন করেও ভোটার হতে পারছেন না ১ লাখ ৪৫ হাজার ১৬৪ জন, চট্টগ্রাম অঞ্চলে ১ লাখ ৪৩ হাজার ১৫৬ জন। খুলনা অঞ্চলে ৮৮ হাজার ৭৪ জন, রাজশাহী অঞ্চলে ৮০ হাজার ২১৪ জন, রংপুরে ৭৫ হাজার ৯৮৪ জন, সিলেটে ৭৫ হাজার ৮৮৯ জন, ফরিদপুর অঞ্চলের ৫৩ হাজার ৮৭১ জন এবং সবচেয়ে কম আবেদন জমে আছে বরিশাল অঞ্চলে ৩৯ হাজার ৯০৯ টি।
কমিশনের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি করার লক্ষ্যে অনলাইনে পেন্ডিং আবেদনগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য মাঠপর্যায়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
বিদায়ী কে এম নূরুল হুদা কমিশন ২০২১ সালে নতুন ভোটারের তথ্য সংগ্রহের উদ্যোগ নিলেও সেটি হয়নি। তথ্য সংগ্রহ বাড়ি বাড়ি হবে, নাকি নির্ধারিত কিছু কেন্দ্রে হবে সেই মতপার্থক্যের কারণে ওই উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি।
এরপর ভোটার নিবন্ধনে ইসির মাঠপর্যায়ে নির্বাচন অফিসে গিয়ে অফলাইনে ও অনলাইনে পাওয়া আবেদন এবং ২০১৯ সালে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সংগ্রহের সময়ে ১৬ বছর বয়সীদের যে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল তাদের তথ্য দিয়েই চলতি মাসে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হয়েছে।
কিন্তু ২০১৯ সালের পরে যারা আবেদন করেছেন, তাদের বেশির ভাগের আবেদন ঝুলে আছে।
১১ লাখের বেশি আবেদন ঝুলে থাকার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া; কাজ হচ্ছে অলরেডি।’
বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা কমিশনের সিদ্ধান্ত। কমিশন সিদ্ধান্ত নিলে এটা হবে। পরবর্তী মিটিংয়ে কথা হবে।’
কমিশনের সভা কবে হবে জানতে চাইলে অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, ‘কমিশন সভার তারিখ এখনও চূড়ান্ত হয় নাই।’
তবে ১১ লাখ আবেদনের কথা মানতে নারাজ জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক এ কে এম হুমায়ূন কবীর। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা কে আপনাকে বলছে? আমি তো জানি না। আপনাকে যে বলছে সে আপনার প্রশ্নের জবাব দেবে, আমি তো জানি না।’
তাহলে সংখ্যাটা কত- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমার তো জানা নেই। যা ভোটার দেখে তারা বলতে পারবে। আমি তো ভোটার দেখি না।’
নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে সংরক্ষিত তথ্য অনুযায়ী দেশে বর্তমানে ভোটার সংখ্যা ১১ কোটি ৩২ লাখ ৮৭ হাজার ১০ জন। এদের মধ্যে পুরুষ ৫ কোটি ৭৬ লাখ ৮৯ হাজার ৫২৯ জন আর নারী ৫ কোটি ৫৫ লাখ ৯৭ হাজার ২৭ জন।