ইউক্রেনে রাশিয়া সামরিক অভিযান শুরুর পর ভোজ্যতেলসহ নিত্যপণ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে ইউরোপের শক্তিধর অর্থনীতির দেশ জার্মানিতে। দুই সপ্তাহ ধরে সুপারশপগুলোতে ভোজ্যতেলের কমতি দেখা গেলেও, গত কয়েক দিনে সেটি প্রকট হয়েছে বলে জানিয়েছেন দেশটিতে বসবাসরত প্রবাসী বাঙালিরা।
চাল, লবণ, টয়লেট টিস্যুর মতো পণ্য সরবরাহেও ঘাটতি তৈরি হয়েছে। কমে গেছে গমজাত খাদ্যের জোগান। শুকনা খাবারের অভাব দেখা দিয়েছে।
বন শহরে অভিবাসী পরিচালিত খুচরা দোকানগুলোতে কিছু তেল পাওয়া গেলেও তা দ্বিগুণ দামে কিনতে হচ্ছে বলেও অভিযোগ এসেছে।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলেতে কর্মরত সাংবাদিক অনুপম দেব কানুনজ্ঞ ফেসবুকে নিজের ভেরিফায়েড প্রোফাইলে দেয়া এক পোস্টে লিখেছেন, ‘ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে জার্মানির সুপারমার্কেটেও। শুরু হয়েছে প্যানিক বায়িং। এমনিতে লম্বা ছুটি থাকলে জার্মানদের অনেক কেনাকাটা করতে দেখা যায়। মহামারির শুরুর দিকে একই ঘটনা ঘটেছিল। তখন দেখা দিয়েছিল টয়লেট পেপারের সংকট, এখন দেখা দিয়েছে ভোজ্যতেলের সংকট।’
মহামারি বা যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এই অতিরিক্ত কেনাকাটা বা প্যানিক বায়িংকে জার্মান ভাষায় বলা হয় ‘হামশটারকয়ফে।’
অনুপম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছিল, তখন থেকে এই প্যানিক বায়িং জার্মান সংস্কৃতির একটা অংশ হয়ে গেছে। কোনো সংকট ছাড়া লম্বা ছুটিতেও জার্মানরা প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে জমা রাখতে পছন্দ করেন।’
বনের সুপারশপে ফাঁকা ভোজ্যতেলের তাক
তিনি বলেন, ‘এবারও জার্মানদের মনে ভয় তৈরি হয়েছে যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ময়দা, রান্নার তেলের সংকট তৈরি হতে পারে।’
সাধারণত নিত্যদিনের রান্নায় জার্মানরা ব্যবহার করেন সানফ্লাওয়ার তেল। তবে অলিভ অয়েলের চাহিদাও রয়েছে।
বন শহরের বেশ জনপ্রিয় সুপারশপ রেভে, এডেকা, আলডি, নেট্টোর তেলের তাক ফাঁকা পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
ডয়চে ভেলের বন কার্যালয়ে কর্মরত আরেক সাংবাদিক আরাফাতুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বনের অনেক সুপারমার্কেটের সয়াবিন তেল, চাল, নুডুলসসহ কিছু পণ্যের তাক খালি হয়ে গেছে। আজ এক দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করায় তিনি বললেন, যুদ্ধ শুরু করেছে পুতিন, আর খেসারত দিচ্ছি আমরা।’
আরাফাত জানান, কিছু পণ্যের সরবরাহ কমে গেছে, আর কিছু পণ্য বেশি বেশি কিনে মজুত করছেন অনেকে।
বিশ্ব চাহিদার অর্ধেক সানফ্লাওয়ার তেল এবং প্রায় ৩০ শতাংশ গমের জোগান আসে ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে। রাশিয়ার ওপর আন্তর্জাতিক অবরোধ আরোপের পর ক্রেমলিন জানিয়েছে, তারা গম রপ্তানি বন্ধে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অন্যদিকে, গম উৎপাদনে বেশ শক্তিশালী দেশ হিসেবে পরিচিত ইউক্রেন এই গ্রীষ্মে গম আবাদ করতে পারবে কি না তা নিয়েও সংশয় রয়েছে।
আলডি সুপারশপের সামনে ক্রেতার লাইন
এমন পরিস্থিতিতে জার্মানিতে ভোজ্যতেলের পাশাপাশি গমজাত খাবারের সংকটও দেখা দিয়েছে।
বনপ্রবাসী দীপিকা চক্রবর্তী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মঙ্গলবার বড় ছেলেকে সানফ্লাওয়ার তেল কিনতে পাঠিয়েছিলাম। চারটি সুপারশপ ঘুরেও সে তেল না পেয়ে খালি হাতে ফিরেছে। কিছুদিন ধরে এই সংকট দেখা যাচ্ছে।’
বাড়ির পাশের সুপারশপ এডেকা থেকে তেল কিনতে স্বামীকেও পাঠিয়েছিলেন দীপিকা। তিনিও তেল না পেয়ে ফিরেছেন খালি হাতে।
এর আগে করোনাভাইরাস মহামারির সংক্রমণ শুরু হলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় জার্মানিতে।
তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন বলে মনে করছেন বন শহরের বাসিন্দারা। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে চলমান সংকটের শিগগিরই সুরাহা হবে না বলেই তাদের শঙ্কা।
বন শহরে বসবাসরত গবেষক ও কলাম লেখক মারুফ মল্লিক বলেন, ‘ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। সুপারশপে তেল কিনতে গিয়ে আমি পাইনি। পরে খুচরা পর্যায়ের টার্কিশ দোকান থেকে তেল কিনতে হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘রাশিয়ার ওপর বিভিন্ন দেশের অবরোধ আরোপের পর তারাও তাদের পণ্য রপ্তানি বন্ধ রেখেছে। যার প্রভাব বাজারে পড়ছে।’
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের প্রেক্ষাপটে আতঙ্কিত হয়ে অনেক জার্মান নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও শুকনা খাবার কিনে ঘরে মজুত করছেন বলেও জানান মারুফ। তবে জার্মানির আইন অনুযায়ী পণ্য মজুতের সুযোগ ব্যবসায়ীদের হাতে নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এ কারণে দাম বাড়ানোরও কোনো সুযোগ নেই।’
মারুফ জানান, সাধারণত এক লিটার সানফ্লাওয়ার তেলের দাম পড়ে ১ ইউরো ৩৯ সেন্ট থেকে ১ ইউরো ৪৯ সেন্ট। তবে এই সংকটকালে তাকে সেটা কিনতে হয়েছে ২ ইউরো ৯৯ সেন্ট দিয়ে।
বাড়তি দামে কেনার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘আমি কিনেছি টার্কিশ দোকান থেকে। খুচরা পর্যায়ের দোকান। সেখানে ওই অর্থে খুব বেশি পণ্য থাকে না, যেমন থাকে সুপারশপে। ফলে তেলের জোগান কম থাকার সময় যখন তাদের কাছে কয়েক লিটার মজুত ছিল, সুযোগে একটু বাড়িয়ে বিক্রি করছে।’
বন শহরে বসবাসরত বাঙালি এক গৃহবধূ জানান, দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে তারা ভোজ্যতেলের সংকট পোহাচ্ছেন। বাধ্য হয়ে সানফ্লাওয়ার তেল ছেড়ে আপাতত বাটারঅয়েল দিয়ে রান্নার কাজ সামাল দিচ্ছেন তিনি।
চলমান সংকটের আপাত সমাধানে সুপারশপগুলো বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে বলে জানান সাংবাদিক অনুপম দেব কানুনজ্ঞ।
তিনি বলেন, ‘এরই মধ্যে অনেক সুপারমার্কেট ক্রেতার জন্য তেল রেশনিং, অর্থাৎ কেনার সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দিচ্ছে।’
নিত্যপণ্যের পাশাপাশি গ্যাসের সংকটের আশঙ্কাও করছেন জার্মানরা। অনেকে ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচতে জ্বালানি কাঠ কিনে জমিয়ে রাখছেন বলেও শুনতে পেয়েছেন অনুপম।