ত্রুটিপূর্ণ নীতির কারণে করোনাভাইরাসে আক্রান্তরা মহামারির শুরুর দিকে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। অনেক এলাকায় সমাজচ্যুতির মতো ঘটনাও ঘটছে। রোগী চিহ্নিত করার নামে লাল পতাকা টানিয়ে জনমনে আতঙ্ক ছড়ানো হয়েছে। ভাড়া বাসা থেকে বের করে দেয়া হয়েছে চিকিৎসকদের।
মঙ্গলবার রাজধানীর মহাখালীতে ব্র্যাক সেন্টারে আয়োজিত ‘বাংলাদেশ কোভিড-১৯: প্রথম দুই বছর ও সামনের দিনগুলো’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, করোনা রোগীর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে না দিয়ে স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকতাদের দিলে এ ধরনের বৈষম্য ঘটনা ঘটত না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, ‘এমন অনেক অ্যাকটিভিটিস আমরা করেছি যার মাধ্যমে রোগীরা বৈষম্যের শিকার হয়েছে। আক্রান্ত রোগীদের মানবিক দিক থেকে দেখা উচিত ছিল। তাদেরকে সহযোগিতা করা উচিত ছিল। তারা যেন বৈষম্যের শিকার না হয়। এই বৈষম্যের কারণ ছিল স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের কাছে নেতৃত্ব না থাকা।’
তিনি বলেন, ‘জেলা প্রশাসকদের এখানে সব কাজের কাজি বানাতে গিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ছিল না। ফলে পরিকল্পনা হয়েছে এক, মাঠ পর্যায়ে বাস্তবে হয়েছে আরেক। হাসপাতালগুলোতে ইনফেকশন প্রতিরোধী ব্যবস্থা ছিল না। ফলে ডেল্টার সময়ে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। এ জন্য জনস্বাস্থ্যে আমাদের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।৷ প্রতিটি জেলায় ৩০ লাখ মানুষের বসবাস হলেও এপিডেমিওলজি নেই।’
তবে লকডাউন নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এটি অনেক বড় প্রভাব ফেলেছে বলেও জানান এই রোগ নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞ।
করোনা নিয়ন্ত্রণে পরিকল্পনা সংকট ছিল জানিয়ে বেনজির আহমেদ বলেন, ‘কোনো কাজ সঠিকভাবে করতে হলে তার জন্য ভালো একটা পরিকল্পনা দরকার। তবে আমাদের কোভিড নিয়ন্ত্রণে শুরুর দিকে পরিকল্পনায় অনেক গ্যাপ ছিল। আমরা ভালো কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারিনি। এমনকি যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল, তা শুধু কাগজে কলমে ছিল। বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রে দৃশ্যমান উদ্যোগ পাওয়া যায়নি।’
তিনি আরও বলেন, করোনা নিয়ন্ত্রণে অনেক দেশ ভালো ভালো গবেষণা প্রকাশ করেছে। তবে এক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে রয়েছি। আমাদের হাতে গোনা কয়েকটি গবেষণা হয়েছে। এছাড়া বড় কোনো গবেষণা আমরা করতে পারিনি।
অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘করোনা যখন বিশ্বব্যাপী ব্যাপক তাণ্ডব চালায় তখন ইতালির প্রধানমন্ত্রী কোনো উপায় না দেখে আকাশের পানে চেয়েছিলেন, সেখানে আমাদের সরকার প্রধান প্রতিদিনই মাস্ক পড়তে বলেছিলেন। এক কোটি মানুষকে প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। করোনার ঊর্ধ্বমুখী অবস্থায় কেউ বাইরে চিকিৎসা নিতে যায়নি। প্রথমদিকে সামনে থেকে চিকিৎসা দিতে গিয়ে অনেকে মারা গেছেন। ব্যবস্থাপনায় দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ সব থেকে এগিয়ে।’
সরকারের রোগতত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ড. মোশতাক হোসেন বলেন, ‘আমাদের দেশের মানুষ সবকিছু মানে কিন্তু পালন করতে পারে না। যেটা আমরা করোনায় সরকার ঘোষিত নির্দেশনা বাস্তবায়নের দিকে তাকালেই দেখতে পাই। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীরা যখন করোনাকে উড়িয়ে দিয়েছেন, তখন বাংলাদেশের সরকার প্রধান মানুষকে মাস্ক পড়তে বলেছেন। আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। কারণ তখন এটি জানা ছিল না।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রধান সংকট প্রাতিষ্ঠানিক হেলথ কাভারেজ নেই। একই সঙ্গে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরও ঠিকভাবে সম্পৃক্ত করা যায়নি। ফলে করোনায় এক কোটি মানুষকে খাদ্য বিতরণকালে অনিয়মের খবর এসেছে। কী পরিমাণে হয়েছে সেটি বের করা দরকার। অনেক দেশের আগেই লকডাউন দেয়া হলেও এর ইতিবাচক ফল এসেছে। আমাদের প্রস্তুতি ও অর্জন মাঝামাঝি। যে দেশের হেলথ কাভারেজ যত ভালো, তারা ততটাই উন্নত। আমাদের গ্রামে কমিউনিটি ক্লিনিক থাকলেও শহরাঞ্চলে নেই। ফলে গ্রামে সংক্রমণ কম ছড়ালেও শহরে বেশি ছড়িয়েছে।’
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক রওনক জাহান বলেন, ‘যে কোনো গবেষণা বা সেমিনারে আলোচনা হলেই অনেকগুলো সুপারিশ করা হয়। তবে আমার দেখা জীবনে এই সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়েছে খুবই কম। সার্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিশ্চিতের জন্য ২০১১ সালে আমরা বেশ কিছু সুপারিশ করেছিলাম। পরে এ বিষয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। তবে ১১ বছর অতিবাহিত হলেও আমাদের দেয়া সুপারিশ এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। আমরা দেখেছি, সার্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা থাকা এলাকায় করোনা নিয়ন্ত্রণ করা গেছে।’