শরিয়াভিত্তিক বিনিয়োগের মাধ্যমে বেশি মুনাফার প্রলোভনে গ্রাহকের প্রায় ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া চক্রের মূল হোতা শাহ আলমসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
নরসিংদী ভেলানগর এলাকায় শনিবার রাতে গোপন বৈঠক চলার সময়ে র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১১-এর অভিযানে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা হলেন, চক্রের অন্যতম হোতা শাহ আলম, তার চার সহযোগী দেলোয়ার হোসেন শিকদার, কাজী মানে উল্লাহ, সুমন মোল্লাহ ও আ. হান্নান মোল্লাহ।
কারওয়ানবাজারে রোববার দুপুরে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক সমবায় সমিতির নামে প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ঘটনায় ভুক্তভোগীরা নরসিংদীসহ বিভিন্ন এলাকায় মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ দেন।’
কমান্ডার মঈন বলেন, ‘নরসিংদীর প্রায় ৫-৬ হাজার সাধারণ পেশাজীবী মানুষ একটি প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়ে ব্যবসায়ে অতিরিক্ত লভ্যাংশ পাওয়ার আশায় শত শত কোটি টাকা অর্থ বিনিয়োগ করে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। বেশির ভাগ মানুষ তাদের সারা জীবনের কষ্টার্জিত জমানো অর্থ হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
‘প্রতারক চক্রের সদস্যরা সাধারণ মানুষের প্রায় ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান। এমন পরিস্থিতিতে ভুক্তভোগীরা তাদের গচ্ছিত টাকা ফিরে পাওয়ার আশায় স্থানীয় সমবায় অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেন। যার ফলে জেলা সমবায় অধিদপ্তর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।’
ঘটনার প্রেক্ষাপট
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক বলেন, ‘২০২১ সালের মাঝামাঝিতে প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয় গুটিয়ে নিয়ে পরিচালনা পর্ষদের সবাই গা-ঢাকা দিলে বিষয়টি নরসিংদীতে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। নরসিংদীর পলাশ থানা পুলিশ প্রাথমিকভাবে লিখিত অভিযোগ গ্রহণ শেষে বিস্তারিত অনুসন্ধানের মাধ্যমে একটি মামলা করে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগীরা আইনি সহযোগিতার প্রত্যাশায় লিখিত অভিযোগ নরসিংদীতে অবস্থিত র্যাব-১১-এর কার্যালয়ে জমা দেন। এরপর র্যাব ছায়া তদন্ত ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায়।’
গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা জিজ্ঞাসাবাদে জানান, ২০১০ সালে নরসিংদীর চিনিশপুর ইউনিয়নের ঘোড়াদিয়া এলাকায় একটি শরিয়াভিত্তিক শাহ সুলতান মাল্টিপারপাস কোম্পানি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় স্থাপন করে একটি চক্র। তারা কৌশলে ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সুদমুক্ত ব্যবসায় প্রলুব্ধ করে বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করে। ধর্মের দোহাই দিয়ে সাধারণ জনগণকে ভুল বুঝিয়ে তাদের সংস্থার সদস্য করে।
জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, সুদমুক্ত জীবনযাপন ছিল তাদের প্রতিষ্ঠানের লোক দেখানো মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। চক্রের অন্যতম হোতা শাহ আলম নিজে কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে চারটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ২৪ জন জনবলের সমন্বয়ে পরিচালনা পর্ষদ গঠন করেন ও অতিরিক্ত ২০ জন পরিচালক নিয়োগ দেন।
যেভাবে চলত কার্যক্রম
র্যাব জানিয়েছে, চক্রের সদস্যরা তাদের আত্মীয় বা পরিচিতদের পরিচালক ও পরিচালনা পর্ষদে নিয়োগ দিতেন। পরে নরসিংদীর বিভিন্ন জনবহুল ও ব্যবসায়িক এলাকায় জাঁকজমকপূর্ণ শাখা অফিস স্থাপন করা হয়।
প্রতিষ্ঠানগুলো হলো শাহ সুলতান এমসিএস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, স্বদেশ টেক্সটাইল লিমিটেড, শাহ সুলতান টেক্সটাইল লিমিটেড ও শাহ সুলতান প্রোপার্টিজ লিমিটেড।
র্যাব আসামিদের বরাতে জানায়, মাঠ পর্যায়ে গ্রাহক ও অর্থ সংগ্রহের জন্য গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের প্রায় ৩ শতাধিক কর্মী রয়েছেন। যাদের কোনো বেতন দেয়া হতো না। গ্রাহকদের বিনিয়োগের মাধ্যমে এককালীন ১০ শতাংশ ও বছরে ৬ শতাংশ টাকা দেয়ার কথা বলা হতো। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা বিনিয়োগকারীদের বার্ষিক ১২ থেকে ১৬ শতাংশ মুনাফার প্রলোভন দেখাতেন।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘তারা গ্রাহকদের কাছ থেকে উচ্চ মুনাফায় মাসিক ভিত্তিতে ডিপিএসের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করতেন। ফলে তারা গ্রাহকসংখ্যা বৃদ্ধিতে সক্ষম হন। তারা বেশকিছু গ্রাহককে উচ্চ মুনাফায় লোন দিতেন। ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান না হলেও তারা ব্যাংকের মতোই গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ ও ঋণ দেয়ার কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। গ্রাহকদের সংগৃহীত অর্থ ল্যান্ড প্রজেক্ট টেক্সটাইল ও নিজস্ব অন্যান্য ব্যবসায় বিনিয়োগের মাধ্যমে সাধারণ গ্রাহকদের অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।’
র্যাবের এই মুখপাত্র আরও বলেন, ‘করোনার ক্রান্তিলগ্নে যখন মানুষের টাকার প্রয়োজন হয়, তখন ভুক্তভোগীরা তাদের আমানতকৃত টাকা উত্তোলনের আবেদন করেন। তখনই তারা করোনা মহামারিসহ বিভিন্ন অজুহাতে গচ্ছিত টাকা ফেরত না দিতে গড়িমসি শুরু করে। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওমর ফারুক ও উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ রানা গ্রাহকদের লগ্নিকৃত টাকা দিয়ে নরসিংদীর বিভিন্ন স্থানে ৫-৬ একর জমি নিজেদের নামে কেনেন। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির নামে নরসিংদীসহ বিভিন্ন স্থানে ৭-৮ একর জমি রয়েছে বলে জানা যায়।’