বাগানজুড়ে বাহারি ফুল, বসার জন্য আছে বেঞ্চ। পাশেই ছোট্ট একটা পুকুর, তাতে সাঁতার কাটতে দেখা যায় নানা প্রজাতির মাছের পোনা।
পার্কের প্রবেশপথে গেট সাজানো হয়েছে বাঁশের মধ্যে পরিত্যাক্ত ছোট-বড় প্লাস্টিকের বোতল লাগিয়ে। ভেতরে বসার ছাউনিগুলোও বোতল দিয়ে সাজানো।
পার্কটি নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের গোপীনাথ রায়ের গড়া। রণচন্ডি ইউনিয়নের বাফলা গ্রামে নিজ জমিতে প্রথমে ফুলের চাষ শুরু করেন। ধীরে ধীরে এটিকে পার্কে পরিণত করেন।
প্রত্যন্ত গ্রামটিকে জমিয়ে তুলেছে এই গোপীনাথ পার্ক। দর্শণার্থীদের আনাগোনা এ গ্রামে এখন লেগে থাকে নিয়মিতই। স্থানীয়রা বলছেন, গোপীনাথের কারণে এ গ্রামের নাম ছড়িয়েছে চারপাশে।
ছয় বিঘা জমির উপর গড়ে উঠেছে এই গোপীনাথ পার্ক।
গোপীনাথ জানান, এই বাগানে গাঁদা, রজনীগন্ধা, গোলাপ, জারবেরা, চন্দ্রমল্লিকা, জিনিয়া, ডালিয়াসহ অন্তত ৭৫ জাতের ফুলের চাষ করেছেন। জাতীয় বিভিন্ন দিবস ছাড়াও বিয়ে বা জন্মদিনের অনুষ্ঠানের জন্য জন্য এখান থেকেই লোকজন ফুল নেয়।
যে পার্ক নিয়ে গ্রামবাসী এখন গর্বিত, তা গড়তে চাওয়ায় একসময় তারা বিদ্রুপ করেছিলেন বলে জানান গোপীনাথ।
তিনি বলেন, ‘এলাকার কিছু লোক মোক পাগলা কইছিলো, খ্যায়া দায়া কাম নাই কইছিলো, ওমরায় এ্যালা ফির কয় (ওরাই এখন আবার বলে) ভালোয় কাম করছিস’।
গোপীনাথ বলেন, ‘মানসির (মানুষের) কথা বাদ দেন, মোর বউও প্রথমে যখন ফুল চাষ শুরু করনু তখন নাক সিটকা সিটকি শুরু করছিলো, এ্যালা কিছু কয় না।’
এই ফুলচাষী জানান, প্রতিদিন দেড় থেকে দুই হাজার টাকার ফুল তিনি বিক্রি করেন। আর পার্কের জন্য রাখেন জনপ্রতি ১০ টাকা।
পরিবার নিয়ে রংপুর থেকে ঘুরতে আসা রফিকুল ইসলাম জানান, রংপুরে বিনোদনের জন্য বড় বড় কেন্দ্র তৈরি হয়েছে। তবে প্রত্যন্ত গ্রামে একজন কৃষক যে উদ্যোগ নিয়েছেন নিশ্চয় তিনি প্রশংসার দাবিদার।
তিনি বলেন, ‘অনেকদিন থেকে শুনে আসছিলাম কিশোরগঞ্জে একটি বাগান তৈরি হয়েছে, সেটি দেখে মুগ্ধ হলাম। পরিবার নিয়ে চমৎকার পরিবেশে দিন কাটানো গেল।’
কলেজ ছাত্রী মুন্নি আকতারও পার্ক দেখে মুগ্ধ। তিনি বলেন, ‘শুনছি কিন্তু কখোনও দেখিনি। আজ এখানে এসে স্বচোক্ষে দেখে মন জুড়ায় গেল। বড় বড় পর্যটন কেন্দ্র থাকলেও গ্রামে এরকম একটি পার্ক কম নয়।’
গোপীনাথের ছেলে দিপু রায় বলেন, ‘বাবা-মা, আমি এবং আমার স্ত্রী আমরা সবাই এখানে সময় দিচ্ছি। অন্য কোনো কাজ নেই। গাছের পরিচর্যা থেকে শুরু করে বাগান দেখাশোনা সবই আমরা করি।’
দিপু জানান, মহান স্বাধীনতা দিবস, মহান বিজয় দিবস, জাতীয় শোক দিবস, জাতীয় শিশু দিবস ছাড়া নানা অনুষ্ঠানের জন্য এখান থেকে সবাই ফুল নিয়ে যান লোকজন। ছুটির দিনগুলোতে পার্কে উপচে পড়া ভিড় থাকে।
তিনি বলেন, ‘আমার বাবা যে উদ্যোগ নিয়েছে সেটি আমি বড় আকারে রূপ দিতে চাই।’
গোপীনাথ বলেন, ‘আগে আমি ধানের চারার ব্যবসা করতাম, কিন্তু এটি মৌসুমি ব্যবসা ছিল। আমি চিন্তা করলাম আর কী করা যায়, মানুষকে কীভাবে আকৃষ্ট করা যায়। এক পর্যায়ে ফুলের নার্সারি করার উদ্যোগ নিলাম। ২০০১ সালে ১৪ শতক জমিতে ২৫ প্রকার ফুলের চাষ শুরু করলাম।
‘ধীরে ধীরে বাগান ৬ বিঘা জমিতে বাড়ানো হয়েছে। ৭৫ জাতের ফুলের চাষ হচ্ছে এখন। রংপুর ও বগুড়া থেকে চারা নিয়ে এসে এখানে চাষ করছি।
এই দিয়ে সংসার চলে আমাদের। পরিকল্পনা আছে বিনোদনের জন্য এটিকে বড় একটি রূপ দেয়া। এজন্য কৃষি বিভাগ থেকে আমি প্রশিক্ষণ নিয়েছি। তারা সহযোগিতা করেছে আমাকে।’
প্রতিবেশী জবা রানী রায় বলেন, ‘প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকা থেকে বাগানে ঘুরতে আসেন মানুষজন। বিভিন্ন দিবস ছাড়াও শুক্রবার লোকের ভিড় বেশি থাকে। গোপী নাথের কারণে এই এলাকা পরিচিতি লাভ করেছে এবং দিনদিন সুনাম ছড়িয়ে পড়ছে।’
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা তুষার রায় বলেন, ‘গোপীনাথকে আমরা কৃষি বিভাগ থেকে প্রয়োজনীয় সাহায্য করে আসছি। তাকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। কৃষি বিভাগ তার পাশে থাকবে।’