মানিক মিয়া এভিনিউ থেকে বিকাশ পরিবহনে করে কুড়িল পর্যন্ত দূরত্ব ৯ দশমিক ৯ কিলোমিটার। নির্ধারিত ২ টাকা ১৫ পয়সা হিসেবে ভাড়া হওয়ার কথা ২১ টাকা, কিন্তু বিকাশ পরিবহন নিচ্ছে ৪০ টাকা।
এই টাকায় অবশ্য যাওয়া যায় উত্তরার কামারপাড়া পর্যন্ত। সেই দূরত্বের হিসাবে ভাড়া হয়তো ঠিক আছে। যাত্রীদের প্রশ্ন হলো, কুড়িল গিয়ে কামারপাড়ার ভাড়া কেন দিতে হবে?
আবার কামারপাড়ার ভাড়া নিয়ে যাত্রী কুড়িলে নামিয়ে দেয়ার পরও সেখান থেকে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত যাত্রী তুলতেই থাকে বাসটি।
আরও পড়ুন: ওয়েবিলে বাস চলবে না: মালিক সমিতি
বাড়তি ভাড়া আদায়ে গত কয়েক বছর ধরে ওয়েবিল পদ্ধতি চালু হয়েছে রাজধানীতে। এই পদ্ধতিতে কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া না কেটে একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর একটি নির্দিষ্ট অঙ্ক আদায় করা হয়। কেউ মাঝপথে নেমে গেলেও তার কাছ থেকে আদায় করা হয় পুরো পথের দূরত্ব, যা লোকাল বাসের ক্ষেত্রে কখনও হওয়ার কথা নয়।
আইনে এভাবে ভাড়া কাটার কোনো বৈধতা নেই। যখন বাসভাড়া নিয়ে শোরগোল হয়, তখন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে ঘোষণা করে, ‘এক টাকাও বাড়তি আদায় করা যাবে না। কেউ আদায় করলেই শাস্তি পেতে হয়।
আরও পড়ুন : বাসে যাত্রী ঠকানোর ‘ওয়েবিল’
গত নভেম্বরে ডিজেলের দাম বাড়ার পর ওয়েবিলের নামে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিআরটিএ ঘোষণা দেয়, ওয়েবিলে কোনো বাস চলবে না। বাসমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহও সংবাদ সম্মেলন করে একই ঘোষণা দেন।
সে সময় বাড়তি বাসভাড়া আদায়ের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমকে ডেকে বেশ কয়েক দিন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে বিআরটিএ। দিনশেষে কত টাকা জরিমানা করা হলো, তাও বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হয়।
এর আগেও একই পদ্ধতিতে কাজ করে শেষে ক্ষান্ত দিয়েছে বিআরটিএ। এবারও তারা তাই করেছে। এখন আর ওয়েবিলের নামে দ্বিগুণের বেশি ভাড়া আদায়ের বিরুদ্ধে বিআরটিএর কোনো দৃশ্যমান তৎপরতা নেই।
এমনকি ২৫টি বাসের রুট পারমিট বাতিলের সিদ্ধান্ত জানিয়ে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে সেটির বিষয়েও আর কিছু করেনি সংস্থাটি। পরে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেল, সেই বাসগুলো কথা দিয়েছে, তারা আইন মেনে ভাড়া কাটবে। এরপর রুট পারমিট বাতিল না করে তাদের আরও সময় দেয়া হয়েছে।
রাজধানীর এই ছয়টি রুটে বাসভাড়া নতুন নির্ধারিত বাসভাড়ার দ্বিগুণেরও বেশি।
দুই কিলোমিটার পর পর ওয়েবিল, ভাড়া কিলোমিটারে ৫ টাকা
মোহাম্মদপুর থেকে ডেমরার স্টাফ কোয়ার্টার পর্যন্ত চলা স্বাধীন পরিবহনেও দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করা হয় বিকাশ পরিবহনের কৌশলেই। নিউ ইস্কাটনের বিয়াম গলি থেকে রামপুরা পর্যন্ত ভাড়া নেয় ২০ টাকা। দূরত্ব চার কিলোমিটার। হিসাব করে দেখা যায়, প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া পড়ছে পাঁচ টাকা।
কিন্তু সরকার যে বাসভাড়া ঠিক করেছে, তাতে ভাড়া হওয়ার কথা ১০ টাকা। তাহলে কেন ২০ টাকা নেয়?
জবাব হলো দুটি ওয়েবিল বসানো হয়েছে। একটি ওয়েবিল থেকে আরেকটির দূরত্ব দুই কিলোমিটার। তাতে সর্বনিম্ন ভাড়া আসে ১০ টাকা, সেই হিসাবে চার কিলোমিটারে দুটি ওয়েবিল বসিয়ে ভাড়া নেয়া হচ্ছে ২০ টাকা।
মিরপুর-১ নম্বর থেকে বনশ্রী যাওয়া আলিফ পরিবহনে চলাচল করা যাত্রী মৌসুমী ইসলাম বলেন, ‘শেওড়াপাড়া থেকে বিএএফ শাহীন কলেজের সামনে নামলে নিচ্ছে ২০ টাকা। এই ২০ টাকা ভাড়ায় যাওয়া যাবে গুলশান-১ পর্যন্ত। এর কারণ হচ্ছে ওয়েবিল। আমি শাহীনে নেমে কেন গুলশান-১-এর ভাড়া দেব?’
বাড্ডার নতুনবাজার থেকে বিমানবন্দর মোড় পর্যন্ত ৯ দশমিক ৩ কিলোমিটার দূরত্বে রাইদা পরিবহন ভাড়া নিচ্ছে ৩০ টাকা।
মগবাজার থেকে খিলক্ষেত পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার পথের জন্য প্রভাতী বনশ্রী ভাড়া নিচ্ছে ৪০ টাকা।
মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে স্বাধীন পরিবহনের বাসে ওয়েবিলে যাত্রীসংখ্যা লিখছেন চেকার। ছবি: নিউজবাংলা
ভাড়ার চার্ট ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে, থাকলেও মানে না শ্রমিকরা
স্বাধীন পরিবহনে উঠে এক যাত্রী বাংলামোটর থেকে রামপুরা যাবেন বলে ১০ টাকা ভাড়া দিলেন। যিনি ভাড়া কাটছেন, তিনি বললেন, ‘২০ ট্যাকা দেন। দুইডা ওয়েবিল আছে। ১০ ট্যাকা কইরা ২০ টাকা।’
স্বাধীন পরিবহনের বেশির ভাগ বাসেই ভাড়ার চার্ট ছিঁড়ে ফেলা হলেও সেই বাসে ছিল। আর সেটি দেখিয়ে সেই যাত্রী বললেন, ‘তোর চার্টে দেখ কত ভাড়া।’
পরিবহন শ্রমিক বললেন, ‘চার্ট মাইন্যা বাস চলে না।’
এরপর বাসের অন্য যাত্রীরা পক্ষ নিলেন সেই যাত্রীর। আর পরিস্থিতি বেগতিক দেখে চুপ করে গেলেন শ্রমিক।
কিন্তু সব বাসে ভাড়ার চার্ট নেই। সেগুলো ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। আবার আইন অনুযায়ী ভাড়ার কথা বললে শ্রমিকরা এভাবে চুপ হন না। আর ঝগড়াঝাটি করতে রাজি না হয়ে দাবি করা ভাড়া মিটিয়ে রাগে গজগজ করতে থাকেন যাত্রীরা।
আরও পড়ুন : যাবেন মগবাজার, ভাড়া দেবেন মতিঝিলের
ওয়েবিল আছে, জানেনই না বিআরটিএ চেয়ারম্যান
অনেক অভিযান, অনেক ঘোষণার পর ‘যেই লাউ সেই কদু’ পরিস্থিতি নিয়ে বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদারের মুখোমুখি হয়ে নিউজবাংলা জানতে পেরেছে, এই নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যান জানেনই না কোন কোন বাস ওয়েবিলে চলে।
এক প্রশ্নের জবাবে বিআরটিএ প্রধান বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট করে কোন গাড়ি, কত টাকা ভাড়া বেশি নিচ্ছে, সেটা বলেন। আমরা ওয়েবিল মানি না। ওয়েবিল তো স্বীকৃত না।’
তিনি পরে আবার বলেন, ‘যখনই যেটা পাড়তেছি, তাকে জরিমানা করছি। আপনি সুনির্দিষ্টভাবে বাসের নাম বলেন। আমরা ওই বাসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’
আরও পড়ুন : বাড়তি ভাড়া রোধে ব্যর্থ পুরোনো পথেই হাঁটছে বিআরটিএ
নিজেও ওয়েবিল মানেন না বলে নিউজবাংলাকে জানিয়েছেন বিআরটিএ প্রধান। বলেন, ‘ওয়েবিল মালিকদের মনগড়া। এটা তো আইন না। আমরা কোনো দিনই ওয়েবিলকে স্বীকার করি নাই, করবও না।’
যদি স্বীকার নাই করেন, তাহলে কেন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না- এমন প্রশ্ন ছিল জনাব মজুমদারের কাছে।
জবাবে তিনি স্বীকার করতে চাননি যে বিআরটিএ নিষ্ক্রিয়। তিনি বলেন, ‘শাস্তি তো হচ্ছেই। আপনি নিজেও অভিযোগ করতে পারেন। মোবাইল কোর্ট তো আমাদের প্রতিদিনই আছে। কেউ বেশি ভাড়া নিলে বা যাত্রীরা অভিযোগ করলে জরিমানা করছে।
‘আমাদের ম্যাজিস্ট্রেটরা জরিমানা করছেন, মামলা করছেন। যাত্রীরা ম্যাজিস্ট্রেটকে বলবে যে তাদের থেকে ভাড়া বেশি নেয়া হচ্ছে।’
মোহাম্মদপুর থেকে স্বাধীন পরিবহনে চলা যাত্রী মিজানুর রহমান বলেন, ‘বিআরটিএ-র ম্যাজিস্ট্রেট কোথায় থাকেন তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। তাদের পেলে না অভিযোগ দেব।’
বিআরটিএ চেয়ারম্যানকে এই যাত্রীর অভিযোগ জানালে তার বক্তব্য কিছুটা পাল্টায়। তখন তিনি বলেন, ‘ঢাকা শহরের অলিতেগলিতে ঘুরে দেখার মতো ম্যাজিস্ট্রেট নাই আমার। আমার সাতজন ম্যাজিস্ট্রেট কোথায় দেব বলেন?’
ওয়েবিলে কোন কোন বাস চলে, সেটি জানেন না ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার মুনিবুর রহমানও। তিনি নিউজবাংলাকে এ-সংক্রান্ত প্রশ্নে বলেন, ‘আপনার কাছে তথ্য থেকে থাকলে কমিশনার স্যার বরাবর চিঠি দেন। আপনি উল্লেখ করে দেন কোন কোন পরিবহন কোন কোন রুটে ওয়েবিলের মাধ্যমে টাকা নিচ্ছে। আমরা ব্যবস্থা নেব।’
ওয়েবিলে বাস চলবে না- এমন ঘোষণা দেয়ার পরও কেন চলছে, সে বিষয়ে জানতে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মসিউর রহমান রাঙ্গা ও মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহর বক্তব্য পায়নি নিউজবাংলা। তাদের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করলেও সেগুলো বন্ধ পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন: ২৫ বাস কোম্পানির রুট পারমিট বাতিলের সুপারিশ
সেই ২৫ বাসের রুট পারমিট বাতিল হয়নি
বিআরটিএ ২৫ বাসের রুট পারমিট বাতিলের ঘোষণা দিলেও সেসব বাসের যাত্রী টানার কারণ কী- এমন প্রশ্নে বিআরটিএ চেয়ারম্যান বলেন, ‘ঢাকা মেট্রোর আঞ্চলিক পরিবহন কমিটির (মেট্রো আরটিসি) এর সভাপতি ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শফিকুল ইসলাম। মেট্রো আরটিসি থেকেই রুট পারমিট শুরু হয় এবং রুট পারমিট বাতিলের সিদ্ধান্ত সেখানে হয়।
‘২৫ বাসের রুট পারমিট বাতিল বিষয়ে আমরা তাদের চিঠি দিয়েছি। আমি জানি যে, এ বিষয়ে সেখানে একটা মিটিংও হয়েছে এবং সিদ্ধান্তও হয়েছে। এ বিষয়ে এখনো আমরা লিখিত পাই নাই। মেট্রো আরটিসিতে একটু খবর নেন তারা কী করেছে।’
শফিকুল ইসলামের কাছেও জানা গেল না, সেই বাসগুলো নিয়ে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন কত দূর। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন তো এমন ৫০টা চিঠি আমি স্বাক্ষর করি। তিনি (বিআরটিএ চেয়ারম্যান) কবে চিঠি পাঠিয়েছেন সেটা সুনির্দিষ্টভাবে আমার মনে নাই। বিআরটিএ যদি এমন প্রস্তাব আমাদের কাছে পাঠিয়ে থাকে, তবে এটা বাতিল না করার কোনো কারণ নাই। তবে এটা করা হয়েছে কি না বা কী পর্যায়ে আছে সেটা আমি জানি না।’
পরে ডিএমপি কমিশনারের পরামর্শে এ বিষয়ে সবশেষ তথ্য জানতে যোগাযোগ করা হয় ডিএমপি ট্রাফিকের অতিরিক্ত কমিশনার মুনিবুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এই ২৫ কোম্পানি আমাদের কাছে অঙ্গীকার করেছে যে তারা যেটা করেছে (অতিরিক্ত ভাড়া আড়ায়), সেটা ঠিক করেনি। তারা নিয়ম অনুযায়ী ভাড়া নেবে এবং এর ব্যত্যয় ঘটলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
‘তারা আবেদন করায় কমিটি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে এই ২৫ কোম্পানির বাস বন্ধ করলে সাধারণ মানুষের যাতায়াতে সমস্যা হবে। করোনার কারণে এমনিতেই বাস কমে গেছে, এই বাসগুলো বন্ধ করে দিলে আরও ঝামেলা হবে। ঢাকার মানুষের সুবিধার কথা মাথায় রেখে আমরা তাদের অবজারবেশনে রেখেছি। পরবর্তী মিটিংয়ে গত তিন মাসের অবজারবেশন তুলে ধরা হবে এবং ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
আর পড়ুন: ভাড়া বেশি নিলে বাস ডাম্পিং
‘ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে কী করেন, সেটা জনগণকে জানান’
যাত্রীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তাদের (বিআরটিএ) ম্যাজিস্ট্রেট যে কাজ করে তার ফলাফল কী? কিছুটা কমছে বলতে কতটা কমছে, সেটার রেজাল্ট দেন।’
যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত বাসভাড়া নেয়া কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। বিআরটিএ নির্ধারিত ভাড়া বেঁধে দিলেও তাতে গা নেই ড্রাইভার-হেল্পারদের। ছবি: পিয়াস বিশ্বাস/নিউজবাংলা
তিনি বলেন, ‘আমাদের (বিআরটিএ) অভিযান চালানোর আগে এই পথে ছিল ১৫ টাকা, অভিযান চালানোর পরে হয়েছে ১২ টাকা। এমন একটা উদাহরণ দিক তারা। না হলে আপনি কীসের কাজ করলেন?’
মোজাম্মেলের ধারণা, বাস মালিকদের ভয় পায় বিআরটিএ। নইলে অবৈধ ওয়েবিল কীভাবে খোদ রাজধানী শহরে চলে, সেই প্রশ্ন রেখেছেন তিনি। বলেন, ‘বাসের রুট পারমিট বাতিল করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। জনগণের বিরুদ্ধে কাজ করলেও তারা মালিকদের বিরুদ্ধে কিছুই করবে না।’