শেরপুরের সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ে লোকালয়ে বন্যহাতির আক্রমণ ঠেকাতে সরকার যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তার কোনোটিই কাজে দেয়নি। কোটি কোটি টাকা খরচ হলেও সুফল না পাওয়ায় পরিকল্পনা প্রণয়নে দুর্বলতার বিষয়টি প্রকট হয়েছে। এবার পরিকল্পনা করা হচ্ছে অভয়ারণ্য তৈরির।
জেলার তিন উপজেলা শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ীর সীমান্তজুড়ে গারো পাহাড়ে বসবাস বন্যহাতির একাধিক দলের। সীমান্তঘেঁষা হওয়ায় ভারত থেকেও দলে দলে আসত হাতি। আবার চলেও যেত। আসা-যাওয়ার এই সময়ে পাহাড়জুড়ে বিচরণ ছিল তাদের।
নির্ধারিত করিডর বা রাস্তা দিয়েই চলাচল করতে হাতি পছন্দ করে বলে জানিয়েছেন পরিবেশবাদীরা। তবে অবৈধভাবে মানুষ বনে বসবাস করায় এসব করিডর বা রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়।
পাহাড়ে বসবাসকারীরা বনের সংবেদনশীলতার সঙ্গে পরিচিত। তবে ভারতের আসামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে নানা সময় মানুষ এ গারো পাহাড়ের বনভূমি দখল করে বাড়িঘর নির্মাণ করে বসবাস শুরু করার পর দেখা দেয় সমস্যা। সংকুচিত হতে থাকে বনাঞ্চল। বন্ধ হয়ে যায় হাতির চলাচলের পথ। সংকট দেখা দিতে থাকে হাতির খাদ্য সরবরাহে।
হাতি যখন তার পুরোনো পথে চলাচল করতে থাকে, তখনই অবৈধভাবে গড়ে ওঠা বাড়িঘর সামনে পড়ে যায়। তখনই সেগুলো গুঁড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে চলতে চায় প্রাণীগুলো। মানুষও দিতে থাকে বাধা। শুরু হয় হাতি ও মানুষের দ্বন্দ্ব।
আবার খাদ্যের অভাবে লোকালয়ে হাতি এসে ফসল, গাছপালা খেয়ে নষ্ট করে। এতে মানুষ আক্রমণ করে হাতির ওপর। হাতিও চালায় হামলা। বন বিভাগ ও পরিবেশবাদী সংগঠনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এতে ২৭ বছরে শতাধিক মানুষ হাতির আক্রমণে মারা যায়। আর মানুষের আক্রমণসহ বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে এবং বিষাক্ত খাবার খেয়ে মারা যায় অন্তত ৫০টি হাতি।
প্রথমে বন বিভাগ চিন্তা করে, প্রাণীগুলো হয়তো খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে আসে। এ জন্য বনের ভেতর হাতির খাবার তৈরির একটি প্রকল্প হাতে নেয় তারা। ২০১৪-১৫ সালের দিকে বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় প্রায় ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে হাতির খাদ্য তৈরির একটি প্রকল্প হাতে নেয় বনবিভাগ। সে প্রকল্পের তেমন কোনো সুফল মেলেনি।
হাতির আক্রমণ ঠেকাতে দেয়া জিআই তার। ছবি: নিউজবাংলা
রাংটিয়ার সিদ্দিক খান বলেন, ‘আমরা দেখলাম আগে হাতি জঙ্গলের ভেতরে থাকত। আমাগোর বাড়ি-ঘরে আইত না। সরকার যহন আকাশমণি ও ইউকিলিপটাস গাছ নাগাইল, তহন বনের মধ্যে খাবার না পাইয়া আমাগোরে ফসলে হানা দিয়া খাইয়া নষ্ট করছে। বাড়িঘরে হামলা করছে। আবার আমাগোরে ফলের বাগানগুইলাও খাই ফেলাইতাছে।’মধুমালা বেগম বলেন, ‘হাতিরে খেদাবার গেলে হাতি আমাগোরে মাইরা ফেলায়। আমরা সরকারের কাছে কত কইলাম হাতি গুইলারে এডা ব্যবস্থা করবার। হুনছি নাখ নাখ টেহা আইছে বনের মধ্যে হাতির খাবার তৈরি করার জন্য। কিন্তু আমরা তো এডার কোনো ফল পাইলাম না। নাখ নাখ টেহা মাইনসেরা খাইয়া ফেলাইছে।’
সেই প্রকল্প ব্যর্থ হওয়ার পর পর ১১ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে সোলার ফ্যানসিং প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলেও রক্ষণাবেক্ষণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় এবং নিম্নমানের কাজ করায় শুরু থেকেই এ সোলার ফেনসিং অকার্যকর ছিল। ফলে এ প্রকল্পটির উদ্দেশ্যও ভেস্তে যায়। এ ব্যাপারে নকশীর আবু হানিফ বলেন, ‘আমরা আশা করছিলাম সোলার ফ্যানসিং আমাগোরে উপকার অবো। কিন্তু কোনো রহমের জিআই তার নাগাইয়া বেডারা টেহা নিয়া ভাইগা গেছেগা। এডা দিয়া আমাগোরে কোনো দিন কোনো উপকারে আসে নাই। হাতি আরও বেশি আইছে। এইগুইলা দিয়া আমাগোরে কি নাব (লাভ) অইব?’
শেরপুর গারো পাহাড়ের বনাঞ্চল। ছবি: নিউজবাংলা
ভারত তাদের সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেয়ায় বাংলাদেশে আসা ২-৩টি দলের শতাধিক হাতি স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছে গারো পাহাড়ে। এসব হাতি স্থানীয় লোকজনের অত্যাচারে স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে পারছে না। হাতিকে মানুষ উত্ত্যাক্ত করে অতিষ্ঠ করে তুলছে।হাতিগুলো অনিরাপত্তার মধ্য দিয়ে চলাচল করছে বলে দাবি করেছেন প্রকৃতি ও পরিবেশবাদী সংগঠন সবুজ আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মেরাজ উদ্দিন। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গারো পাহাড়ি এলাকায় ২৭ বছরে অন্তত ৫০টির মতো হাতি নানা কারণে মারা পড়লেও এর সঠিক কারণ এখনও আমাদের অজানা। ময়নাতদন্ত করা হলেও কী রিপোর্ট এসেছে, কারা কীভাবে হাতিগুলোকে হত্যা করল, তা আজও জানানো হয়নি।’
ময়মনসিংহ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ কে এম রহুল আমীন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি নানাভাবে হাতি রক্ষা করার জন্য। আমাদের প্রকল্পগুলো যে একেবারে ফেইল করেছে তা ঠিক না। আমাদের যেখানে যে সমস্যা হচ্ছে তা সমাধান করার চেষ্টা করছি।’
শেরপুরের জেলা প্রশাসক মোমিনুর রশিদ বলেন, ‘ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি গাছ পাহাড়ে কিছুটা ক্ষতি করেছে। এ জন্য সরকার সুফল প্রকল্পের মাধ্যমে নানা প্রজাতির গাছ লাগানো ব্যবস্থা করেছে। এসব গাছ বড় হলে এ সমস্যা আর থাকবে না।
‘তা ছাড়া মানুষের মধ্যেও সচেতনতার অভাব রয়েছে। হাতিগুলোকে অত্যাচার করাও ঠিক না। এ জন্য গারো পাহাড়ে হাতির অভয়ারণ্য করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে অনেক দূর পর্যন্ত আমরা এগিয়েছি।’