বড় হচ্ছে দেশে বইয়ের বাজার। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন পাঠক। এ প্রবণতা শুধু পাঠ্যপুস্তকেই সীমাবদ্ধ নেই, স্ফীত হচ্ছে জ্ঞানভিত্তিক সৃজনশীল বইয়ের প্রকাশও।
সব বই-ই দেশে ছাপা হচ্ছে। তা সত্ত্বেও কিছু বই আমদানি হয় এবং কিছু অংশের কপিরাইট নিয়ে মুদ্রণও হয়। ফলে বই, বইসংশ্লিষ্ট ছাপাখানা এবং প্রকাশকের সংখ্যা বাড়ছে।
দেশে বই পাঠের ওপর কোনো সংস্থার পক্ষ থেকে কোনো জরিপ এখনও হয়নি। অবশ্য নানা তথ্য-উপাত্ত বলছে, বই পড়া বাড়ছে। পাঠক বাড়ছে।
শুধু মুদ্রিত নয়, বই পড়া এখন ঢুকে পড়েছে ভার্চুয়াল জগতেও। এতে বই পড়ার প্ল্যাটফর্মও বদলে গেছে। পাঠকরা এখন ছাপাখানায় মুদ্রিত বই ছাড়াও মোবাইল, ডেস্কটপ কিংবা ল্যাপটপ থেকে অনলাইনে যুক্ত হয়েই ঘরে বসে পড়ে নিতে পারছে পছন্দের যেকোনো বই।
নির্দিষ্ট রিডিং অ্যাপে ক্লিক করা মাত্রই পাঠক পেয়ে যাচ্ছে ডিজিটাল বই। ফলে তরুণ প্রজন্ম থেকে শুরু করে এখন প্রবীণরাও ঢুঁ মারছেন অনলাইন মাধ্যমে। এ ছাড়া পছন্দের যেকোনো বই অনলাইনে সহজে অর্ডার করেও বইটি নিজের সংগ্রহে রাখতে পারছে ক্রেতারা।
দেশে বিভিন্ন রকম বইয়ের পাঠক আছে। তবে পাঠ্যবই ও পাঠ্য সহায়ক বইয়ের রয়েছে স্থায়ী ক্রেতা ও পাঠক। চাকরিপ্রত্যাশীদের কাছেও রয়েছে এ-সংক্রান্ত বইয়ের কদর। এ ছাড়া ধর্মীয় বইয়ের আছে নিয়মিত ও সুনির্দিষ্ট পাঠক।
একইভাবে জ্ঞানভিত্তিক সৃজনশীল বইয়েরও তৈরি হচ্ছে স্থায়ী পাঠক।
সৃজনশীল বইয়ের পাঠক প্রবৃদ্ধি
বই পড়ার ক্ষেত্রে জনসংখ্যার হিসেবে সৃজনশীল পাঠকের সংখ্যা দেশে তেমন সমৃদ্ধ না হলেও এর সংখ্যাটি ক্রমবর্ধমান।
একুশে বইমেলা দেশে সৃজনশীল প্রকাশনা প্রদর্শন ও বিপণনের প্রধান মাধ্যম। এ মেলায় বই বিক্রির পরিমাণ থেকেও দেশে বই পড়ার আগ্রহ ক্রমাগত বৃদ্ধির আভাস পাওয়া যায়।
বাংলা একাডেমির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত বইমেলায় ১৭ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছিল। ২০১৫ সালে বিক্রি বেড়ে দাঁড়ায় ২২ কোটিতে। ২০১৬ সালে তা আরও বেড়ে ৪২ কোটি ৫০ লাখ টাকায় উঠেছিল।
এভাবে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধির ভেতর ২০১৭ সালে বই বিক্রি হয় ৬৫ কোটি ৪০ লাখ টাকার, যা ২০১৮ সালে ৭০ কোটি ৫০ লাখ টাকায় দাঁড়ায়। ২০১৯ সালে বই বিক্রি আরও বেড়ে ৭৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা এবং ২০২০ সালে সর্বোচ্চ রেকর্ড গড়ে ৮২ কোটি টাকায় পৌঁছে।
শুধু বিক্রির হিসাবেই নয়, এ সময় বেড়েছে বই প্রকাশের সংখ্যাও। প্রতি বছর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা বেড়েছে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৮ সালে একুশে মেলায় প্রকাশিত বই ছিল ৪ হাজার ৫৯১টি। ২০১৯ সালে বই প্রকাশের সংখ্যা বেড়ে ৪ হাজার ৬৮৪ এবং ২০২০ সালে ৪ হাজার ৯১৯টি হয়। বাংলা একাডেমির বিবেচনায় এসব বই সংখ্যাগরিষ্ঠ, মানসম্মত ও জ্ঞানভিত্তিক সৃজনশীল।
দেশে বই পড়ায় বেসরকারি উদ্যোগ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের তৎপরতা থেকেও সৃজনশীল পাঠক বৃদ্ধির তথ্য মেলে। মাত্র ৩৪ টাকার বই এবং ১৫ জন সদস্য নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়। এখন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ৩০ লাখ সদস্যের মাইলফলক স্পর্শ করেছে। এর সদস্যরা জ্ঞানভিত্তিক সৃজনশীল বই পড়ার মধ্যে রয়েছে।
পাঠক বৃদ্ধির প্রমাণ মেলে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংখ্যা বৃদ্ধির তথ্যেও। একটা সময় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ১০-১৫টি। ষাটের দশকে তা বেড়ে ৬০-এ উন্নীত হয়। ৮০-দশকে তা এক শ কোটি অতিক্রম করে। এখন ২০৬টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান নিয়মিত বই প্রকাশ করছে।
বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির তথ্যও বই পড়ার প্রবণতা বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়। তারা জানাচ্ছে, বর্তমানে সারা দেশে প্রকাশক ও বই ব্যবসায়ীর সংখ্যা চার হাজারের বেশি, যা আশির দশকেও ছিল সহস্রাধিক।
প্রকাশনা শিল্পের বাজারও বড় হয়েছে। আশির দশকে এ বাজার ছিল মাত্র কয়েক শ কোটি টাকার, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকায়। এ ছাড়া কয়েক বছর আগের শতকোটি টাকার সৃজনশীল বইয়ের বাজার এখন ৫০০ থেকে ৭০০ কোটি টাকায় ওঠানামা করছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও সাহিত্য বিতান প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনের স্বত্বাধিকারী মো. শামসুল ইসলাম বাহার বলেন, ‘দেশে বই পড়ায় আগ্রহ মানুষের বাড়ছে। বাড়ছে সৃজনশীল বইয়ের পাঠকও। করোনা পরিস্থিতিতে মানুষ যখন আর্থিক সংকটে আছে, তখনও মানুষ বই কিনছে। এর মানে মানুষ বই পড়ার মধ্যেই আছে। এ প্রবণতা ক্রমে বাড়ছে।’
তিনি বলেন, ‘এক দশক আগেও দেশে ১০০ কোটি পিস বই ছাপা হতো না। এখন তার ব্যাপ্তি বেড়ে বছরে দেড় শ কোটি থেকে ২০০ কোটি পিসও ছাপা হচ্ছে। পাশাপাশি আমদানি হচ্ছে বিদেশি বইও। সব বই-ই তো বিক্রি হচ্ছে।’
বাড়ছে ডিজিটাল বইয়ের পাঠক
বাজারে অনেক সময় পছন্দের বইটি ধারে-কাছে খুঁজে পাওয়া যায় না। সেটি পেতে অনেক কষ্ট হয়। কিন্তু অনলাইনে কষ্ট করতে হয় না।
ইতোমধ্যে দেশে বেশ কিছু বই বিক্রির অনলাইন প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে। পাবলিশার ই-প্ল্যাটফর্মের তথ্য মতে, অনলাইনে ১৬৫টি অ্যাক্টিভ ই-পাবলিশার প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেখানে ২ হাজারের বেশি বাঙালি লেখক রয়েছেন। এসব পাবলিশারের তত্ত্বাবধানে সংরক্ষিত আছে ২৫ হাজারের বেশি বই।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, পাঠকের পাঠাভ্যাস বদলে যাওয়ায় এখন অনলাইনে বই বিক্রির প্রতিষ্ঠানগুলোও ভালো ব্যবসা করছে। এদের মধ্যে রকমারি ডটকম, অথবা ডটকম, পড়ুয়া, সর্বনাম, বইমেলা, ইবইঘরডটকম, নীলক্ষেতডটকম উল্লেখযোগ্য।
অনলাইনে বই বিক্রির শীর্ষস্থানীয় প্ল্যাটফর্ম রকমারি ডটকমের বিক্রির তুলনা করলেই এ ধারণা পাওয়া যাবে। প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, ২০১২ সালে ১০০ বই দিয়ে তারা অনলাইনে বই বিক্রির কার্যক্রম শুরু করেছিল। এখন বইয়ের সংখ্যা আড়াই লক্ষাধিক। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি বছরে ১০ লক্ষাধিক বই পাঠকের হাতে পৌঁছে দিচ্ছে।
এ ছাড়া বই পড়ার বিভিন্ন রিডিং অ্যাপেও পছন্দের বইয়ের খোঁজে সার্চ ও ডাউনলোড বাড়ছে। গুগুল প্লে স্টোরে প্রতিদিন এসব রিডিং অ্যাপের ডাউনলোড হচ্ছে হাজার হাজার।
বাংলাভাষীদের মধ্যে তেমনই একটি জনপ্রিয় ভারতীয় রিডিং অ্যাপ হলো ‘প্রতিলিপি’, যেখানে বাংলাদেশি পাঠকদের রয়েছে উল্লেখযোগ্য আনাগোনা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গুগল প্লে-স্টোর থেকে এই অ্যাপটি এখন পর্যন্ত সোয়া এক কোটি বার ডাউনলোড হয়েছে।
বই আমদানিও বাড়ছে
প্রতি বছর বিদেশি বই আমদানির পরিমাণও বাড়ছে। এসব বইয়ের সবই জ্ঞানভিত্তিক ও সৃজনশীল ধরনের, যেখানে রয়েছে বিদেশি মেডিক্যাল বুক, জনপ্রিয় ফিকশন বই ও ম্যাগাজিন।
বিদেশি বই আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য মতে, গত ৫ বছরে প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকার বই আমদানি হয়েছে। প্রতি বছর ২০০ থেকে আড়াই শ কোটি টাকার বই আমদানি হচ্ছে। বিশ্বের কয়েকটি দেশ থেকে বই আমদানি হলেও বেশির ভাগ বই-ই আসছে ভারত থেকে।
গত ২০১১-১২ অর্থবছরে শুধু ভারত থেকেই এসব বই আমদানি হয় ৫৮ কোটি ১৮ লাখ টাকার, যা ২০১৯ সালে ১৬০ কোটিতে উন্নীত হয়।
লেখক-প্রকাশকরাও বলছেন প্রবৃদ্ধির কথা
আগামী প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ওসমান গনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গবেষণাধর্মী এবং মেধা-মননের চর্চা হয়– এ ধরনের সৃজনশীল বইয়ের প্রকাশনা ও বিক্রির পরিমাণ আস্তে আস্তে বাড়ছে। পাঠক সেটা কিনছে বলেই এসব সৃজনশীল বই ছাপা হচ্ছে। ফলে বই ছাপানোর পরিমাণও আগের থেকে বেড়েছে।’
তিনি বলেন, ‘শুধু আগামী প্রকাশনীই এখন পর্যন্ত ৩ হাজার জ্ঞানভিত্তিক মেধা-মনন চর্চার বই প্রকাশ করেছে। গত বছর আমরা একাই এ ধরনের ৭ কোটি টাকার বই বিক্রি করেছি। আগের বছরগুলোয় বিক্রির পরিমাণ এত বেশি ছিল না। এর মানে হচ্ছে মানুষ বই পড়ছে। পড়ায় আগ্রহ বাড়ছে। ফলে প্রতি বছর বই প্রকাশের সংখ্যাও বাড়ছে।’
বই পড়ার প্রবণতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে উল্লেখ করে বাতিঘর প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী আতিকুর রহমান জানান, বর্তমানে জনসংখ্যার বিচারে সেটি এখনও উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে না গেলেও বাড়ার হারটি দৃশ্যমান। মানুষ বই থেকে দূরে ছিল। এখন তারা আবার ফিরে আসতে শুরু করেছে। এটা আর কমার সম্ভাবনা নেই। বরং দিনদিন বাড়বে।
গবেষণাধর্মী লেখক সৈয়দ জাহিদ হাসান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আপনি দেখবেন একুশে বই মেলায় ভিড়। অন্যান্য বইমেলায় ভিড় হয়। সারা বছর বইয়ের প্রসিদ্ধ স্থানগুলোতেও ভিড়। এগুলো বই পড়ায় মানুষের আগ্রহের বার্তাই দেয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে পড়ার ফরম্যাটটি অনেকের কাছে বদলে গেছে। মানুষ অনলাইনেও বই পড়ছে এবং কিনছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা যদি প্রান্তিক পর্যায়ে মেলা পৌঁছাতে পারতাম, যদি আমরা ইউনিয়ন পর্যায়ে পাঠাগার তৈরি করতে পারতাম, তাহলে পাঠকের সংখ্যা আরও বাড়ত। এর জন্য আমাদের লেখক, সরকার, প্রকাশক যে যেখানে আছে, যার যার জায়গা থেকে তা উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তাদের আরেকটু সচেতন করতে হবে।’