২০০৭ সালে নারায়নগঞ্জে থাকা অবস্থায় ধর্ষণের শিকার হন গার্মেন্টসকর্মী কল্পনা বেগম। এরপর শুরু হয় তার নতুন এক সংগ্রাম। সেই সংগ্রামের কথা ছড়িয়ে পড়লে তাকে জেলা, উপজেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে ‘জয়িতা’ উপাধি প্রদান করে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ।
তবে ধর্ষণের সেই দুঃসহ স্মৃতি নিয়েই জীবনযুদ্ধে এখনও লড়ে যাচ্ছেন আপোষহীন কল্পনা। অপমান, ঘৃনা আর কটু কথাকে উপেক্ষা করে কখনও কাজ করেন ইটভাটায়, কখনও নির্মাণশ্রমিক কিংবা বাড়ি বাড়ি কাপড় ফেরি করেন। কষ্টার্জিত টাকায় সংসার চালিয়ে খরচ যোগাচ্ছেন সেই ধর্ষণ মামলাটিরও।
এমন দৃঢ় মনোবল আর আত্মবিশ্বাসের জন্যই কল্পনাকে ‘জয়িতা’ ঘোষণা করা হয়। জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার চারাইলদার গ্রামের এক গরীব পরিবারে জন্মেছিলেন তিনি।
৫ ভাই-বোনের মধ্যে কল্পনা ছিলেন দ্বিতীয়। অষ্টম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় তার বিয়ে দেন বাবা-মা। কিন্তু মাদকসেবী স্বামীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সংসারের হাল ধরতে ৩ মাসের পুত্রকে নিয়ে চলে যান ব্যস্ত নগরী ঢাকায়।
কাজের সন্ধানে ছুটে বেড়ানো কল্পনার শেষ পর্যন্ত ঠাঁই হয় নারায়নগঞ্জের সুমন গার্মেন্টসে। দিন-রাত পরিশ্রম করে ভালোই চলছিল তার ছোট্ট সংসার। অভাব অনটন থাকলেও তার সেই সংসারে সুখের কোনো কমতি ছিল না। কিন্তু সেই সুখে বাধ সাধে সাত বখাটে।
দুঃসহ সেই স্মৃতি মনে করে নিউজবাংলাকে কল্পনা জানান, ২০০৭ সালের ২৯ মে সন্ধ্যায় কাজ থেকে বাসায় ফেরার পথে ওই সাত বখাটে তাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যায়। পরে পালাক্রমে ধর্ষণ ও নির্যাতন চালায় তার ওপর। পরে স্থানীয়দের সহায়তায় জ্ঞানহীন অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে র্যাব।
এ ঘটনায় পর নারায়নগঞ্জ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন কল্পনা। জানতে পারেন, সেই সাত ধর্ষক তার উপজেলারই বাসিন্দা।
দুঃখ করে কল্পনা বলেন, ‘দেড় যুগ পরও মামলাটির বিচারকাজ এখনও শেষ হয়নি।’
শুধু তাই নয়, ঘটনার পর স্থানীয় প্রভাবশালীদের হুমকির মুখে গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষ কল্পনাকে চাকুরিচ্যুত করেছিল। তার স্বামীও তাকে তালাক দিয়ে চলে যায়।
কল্পনা বলেন, ‘এক রাতেই আমার সংসারডা উল্টা-পাল্টা হয়ে গেছিল। অনেকবার আত্মহত্যার চিন্তা করছি। কিন্তু পারি নাই। এত কিছুর পরও নিয়তির কাছে হার মানি নাই। সংসারও চালাইছি, মামলাও চালাই গেছি।’
তবে কষ্টার্জিত টাকায় পরিচালিত মামলাটিতে একদিন বিজয়ী হবেন বলে দৃঢ় বিশ্বাস তার। তবে তার অভিযোগ, মামলার দীর্ঘদিন পরও কোনো আসামিকে এখনও গ্রেপ্তার করা হয়নি। তাই তার শত কষ্ট বিফলের পথে।
তিনি বলেন, ‘বাবা মারা যাওয়ার পরও গ্রামে আসতে পারি নাই। বাবার লাশটা দেখতে পারি নাই।’
একের পর হুমকির কারণে এখনও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তিনি। তার দাবি, আসামিদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনা হোক।
এ ছাড়া আছে আর্থিক অস্বচ্ছলতাও। তাই সরকারি সহায়তার দাবি জানান তিনি।
২০১৮ সালে বিভাগীয় পর্যায়ে কল্পনাকে দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ জয়িতা ঘোষণা করা হয়
জামালপুরের মানবাধিকার কর্মী জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, ‘আপোষহীন এই নারীকে অনুসরণ করছে অনেকেই। তার সংগ্রাম দেখে অনুপ্রানিত হয়েছেন অনেক নারী। সমাজের বিত্তবানদের উচিত তার পাশে দাঁড়ানো।’
জামালপুর মহিলা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কামরুন্নাহার বলেন, ‘মহিলা অধিদপ্তর ইতোমধ্যে জয়িতা ঘোষণা করে তাকে সামাজিক স্বীকৃতি দিয়েছে। অনেক আগে থেকেই উদ্যমী এই কল্পনা বেগমের সঙ্গে রয়েছে জেলা মহিলা অধিদপ্তর। আমাদের অধিদপ্তরের আওতায় বিভিন্ন কাজের প্রশিক্ষণ হয়। প্রশিক্ষণের পাশাপাশি আর্থিক সহায়তাও করি আমরা। কল্পনা বেগম চাইলেই এই সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন। এ ছাড়াও তার মানসিক, সামাজিক উন্নয়নেও সর্বাত্মক চেষ্টা করবে জেলা মহিলা অধিদপ্তর।’
বর্তমানে দ্বিতীয় স্বামীর ঘরে ছেলে-মেয়ে নিয়ে সংসার করছেন কল্পনা। কখনো থাকেন জামালপুরে আবার কখনো নারায়ণগঞ্জে।