শেরপুরের ঝিনাইগাতী বাজারের মাটির নিচে পাথরের স্তর। তাই সব জায়গায় নলকূপ বসানো যায় না। কিছু স্থানে নলকূপ বসানো গেলেও পানিতে থাকে আয়রন। তাই এ বাজারে সারা বছরই থাকে পানির সংকট। বিশেষ করে, বাজারের বিভিন্ন দোকানে এই সংকট আরও তীব্র।
নিজেদের অসহায়ত্ব ঘোচাতে এই সংকটকেই অবলম্বন করলেন আসমা আর আসিয়া। দূর-দূরান্ত থেকে ভ্যানগাড়িতে করে পানি এনে ঝিনাইগাতী বাজারে সকাল-বিকেল বিক্রি করেন তারা। এতে সারা দিনে যে আয় হয়, দুজনে ভাগ করে নিয়ে নিজেদের সংসার চালান।
৪০ বছর বয়সী আসিয়া বেগম ঝিনাইগাতী উপজেলার বন্দভাটপাড়া গ্রামের আব্দুল করিমের স্ত্রী।
আছিয়া জানান, তার স্বামী একসময় নাপিত ছিলেন। পরে তিনি অন্ধ হয়ে যান। এতে সংসারের উপার্জনও বন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় অন্যের কাছে হাত না পেতে ঝিনাইগাতী বাজারে পানি বিক্রি শুরু করেন তিনি। পানি বিক্রির আয় দিয়েই চালাচ্ছিলেন তিন সন্তান আর অন্ধ স্বামীসহ ৫ জনের সংসার। তবে তিন বছর আগে তার স্বামীও মারা যান।
আসিয়া বলেন, ‘আমার সঙ্গে পানি টানে আরেক দুঃখিনী আসমা। দুজনে মিলে প্রায় ২০ বছর ধরে পানি টানছি আর বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছি। একজন ভ্যান টানি আরেকজন ধাক্কা দেই। এভাবেই দোকানে দোকানে পানি দেই আমরা।’
আসিয়া জানান, পানি বিক্রি করে দৈনিক ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা আয় হয় তাদের। এই টাকা দুজনে সমান ভাগ করেন তারা।
জীবনযুদ্ধে আসিয়ার সঙ্গী আসমা বেগম জানান, শেরপুরের তাতালপুরে থাকতেন তিনি। সেখানেই কিশোরগঞ্জ জেলার নূর ইসলাম নামের এক শ্রমিকের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তার। কিন্তু তিন সন্তান জন্মের পর তাকে ফেলেই নিজের এলাকায় চলে যান স্বামী।
আসমা বলেন, ‘সেই থেকে আমিও বিধবা। প্রথমে ধানের খলায়, পরে কৃষিজমিতেও শ্রমিকের কাজ করেছি। একসময় বাবা-মাসহ ঝিনাইগাতী চইলা আসি। অল্প টাকায় একটা ঘর ভাড়া নিয়া থাকি। ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে ঝিনাইগাতী থাকলেও এখানে আমাগো কোনো জায়গা-জমি নাই। আসিয়ার সঙ্গে পানি বেইচা অনেক কষ্টে সংসার চালাই।’
এ সময় তিনি দুঃখ করে বলেন, ‘কত মানুষ ঘর পাইল। কিন্তু আমরা পাইলাম না। কত জনে ছবি তুলল, কোনো কামে আইল না।’
দুই নারীর জীবনযুদ্ধের বিষয়ে ঝিনাইগাতীর প্রবীণ সাংবাদিক এসকে সাত্তার বলেন, ‘আমরা অনেক দিন ধরেই দেখছি, এই দুজন অনেক কষ্ট করে বাজারে পানি দিয়ে আসছে। ভূমিহীন হলেও এদের কেউ সহায়তা করছে না। আশা করছি, প্রশাসন এদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবে।’
বাজারের ব্যবসায়ী আজহার আলী বলেন, ‘আমাদের পানি দিয়ে খুব উপকার করছে এই মহিলারা। সরকারি সাহায্য পাওয়ার যোগ্য হলেও এরা তা পাইতাছে না।’
শেরপুরের জেলা প্রশাসক মো. মোমিনুর রশীদ বলেন, ‘ভিক্ষাবৃত্তি না করে পানি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে তারা নিশ্চয়ই ভালো কাজ করছেন। আমরা এদের পরে সরকারি ঘর ও জমি দেয়ার ব্যবস্থা করব। কেউ আশ্রয়হীন থাকবে না।’