‘আর কোনো ইচ্ছা নাই আমাদের। এখন একটা প্রেস কনফারেন্স কইরা আগুনে দিমু, গলামু– এইটা হলো শেষ চাওয়া। আপনারা যে লেখতাছেন, কথাগুলো তাদের কানে যায় না, ওই পর্যন্ত পৌঁছায় না। একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর কানে না পৌঁছানো পর্যন্ত অন্যরা এগুলো সংরক্ষণ করবে না।’
ক্ষোভে কথাগুলো বলছিলেন সভা-সমাবেশে সাউন্ড সিস্টেম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ‘কল-রেডী’র চার স্বত্বাধিকারীর একজন বিশ্বনাথ ঘোষ।
১৯৭১ সালে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে ব্যবহৃত মাইক্রোফোনসহ অন্যান্য সরঞ্জাম ব্যক্তিগত সংগ্রহে রেখেছে বিশ্বনাথ ঘোষের পরিবার। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও রাষ্ট্রীয় কোনো উদ্যোগে ৭ মার্চ ভাষণে ব্যবহৃত সরঞ্জামগুলো জাতীয়ভাবে সংরক্ষণ না করায় এই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিশ্বনাথ ঘোষ।
বিশ্বনাথ ঘোষ নিউজবাংলাকে জানান, ৭ মার্চ ভাষণে ব্যবহৃত সরঞ্জামের ৪০ ভাগ তারা সংরক্ষণ করতে পেরেছেন। বাকিগুলো তারা পাননি।
৭ মার্চ ভাষণে ব্যবহৃত মাইক্রোফোন, হর্ন, স্ট্যান্ড ও অন্যান্য সরঞ্জাম।
ইতিহাসের চূড়াস্পর্শী সেই ভাষণে ব্যবহার করা মাইক্রোফোন, মাইক, হর্ন, এমপ্লিফায়ার, স্ট্যান্ডসহ আরও সরঞ্জাম সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে পুরান ঢাকার সূত্রাপুরের লক্ষ্মীবাজারের ‘কল-রেডী’র অফিসে। নির্মিতব্য বঙ্গবন্ধুর বায়োপিকে সম্প্রতি এই সরঞ্জামগুলো ব্যবহারের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কলকাতায় সেগুলো রয়েছে। বায়োপিকের কাজ শেষে আবার নিয়ে আসা হবে।
৫০ বছর পর হলেও আশার কথা শুনিয়েছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরের সদস্য সচিব ও কিউরেটর মো. নজরুল ইসলাম খান। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ভাষণে ব্যবহৃত মাইক্রোফোনসহ অন্য সরঞ্জামগুলো সংরক্ষণের প্রক্রিয়া চলছে। আরো আগেই সংরক্ষণ করা সম্ভব হতো। করোনার কারণে সেটা পিছিয়েছে। এখন কাজ শুরু করা যাবে।
তবে এই স্মৃতিচিহ্নগুলো কোথায় রাখা হবে তা নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন আছে বলে জানান নজরুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, ‘এগুলো জাতীয় জাদুঘর না বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে থাকবে, কীভাবে রাখা হবে, এসব বিষয়ে আলোচনার প্রয়োজন আছে। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে সংরক্ষণের কাজ শুরু করা যাবে বলে আশা করি।’
আরজু লাইট হাউস থেকে কল-রেডী
সভা-সমাবেশে সাউন্ড সিস্টেম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কল-রেডীর গোড়াপত্তন হয় ১৯৪৮ সালে। দুই সহোদর দয়াল ঘোষ ও হরিপদ ঘোষের হাত ধরে এর যাত্রা শুরু। পুরান ঢাকার সূত্রাপুরের লক্ষ্মীবাজারের ছোট একটি দোকানে যাত্রা শুরু করেন তারা। আলোকসজ্জার পাশাপাশি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গ্রামোফোন ভাড়া দিতেন তারা। শুরুতে প্রতিষ্ঠানটির নাম ছিল আরজু লাইট হাউস। শুরুর কয়েক বছর পর প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করা হয় ‘কল-রেডী’।
৭ মার্চের ভাষণ দেয়া কল-রেডীর ঐতিহাসিক সেই মাইক্রোফোন।
প্রতিষ্ঠানের এখনকার অন্যতম মালিক বিশ্বনাথ ঘোষ জানান, দেশভাগের পর তখনকার পূর্ব বাংলায় আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু হলে মিছিল-মিটিং বা সমাবেশের জন্য মাইকের চাহিদা বাড়ে। সেই চাহিদা থেকেই দেশের বাইরে থেকে বেশ কিছু মাইকের সরঞ্জাম কিনে আনা হয়।
'৫২-র ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের সভা-সমাবেশগুলোতে কল-রেডীর সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহৃত হয়েছে।
আদি প্রতিষ্ঠাতা দয়াল ঘোষ মারা গেছেন ২০০৪ সালে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি চালাচ্ছেন বিশ্বনাথ ঘোষ, শিবনাথ ঘোষ, ত্রিনাথ ঘোষ সাগর ও সম্বোনাথ ঘোষ রানা। তারাই ধরে রেখেছেন বাবা-চাচার ব্যবসা ও স্মৃতি।
৭ মার্চ ও কল-রেডী
৭ মার্চের ভাষণের দিনের আগে আগে বঙ্গবন্ধু দয়াল ঘোষকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। দয়াল ঘোষের ছেলে বিশ্বনাথ ঘোষ বলেন, ‘বাবাকে সারা শহরে মাইক সেট করার নির্দেশ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেই অনুযায়ী শহরের বিভিন্ন প্রান্তে তিন শতাধিক হর্ন লাগানো হয়েছিল, যাতে লাখো মানুষের কাছে শেখ মুজিবের ভাষণ পৌঁছানো যায়।’
৭ মার্চের ভাষণ সমাবেশস্থল ও শহরের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা মানুষজনের কাছে যাতে পৌঁছায়, সে জন্য বঙ্গবন্ধুর সামনে ও পাশে অন্তত ২০টি মাইক্রোফোন লাগানো হয়েছিল।
কল-রেডীর বর্তমান ছবি
৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণের পর শহরের বিভিন্ন প্রান্তে লাগানো সব হর্ন একত্রিত করতে পারেননি কল-রেডীর মালিকরা। তখন কল-রেডীতে যারা কাজ করতেন, তারাই বিক্ষিপ্তভাবে এগুলো নিজেদের সংগ্রহে রাখেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেগুলো আবার নিয়ে আসা হয়।
তবে ৭ মার্চের ভাষণের পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর টার্গেটে পরিণত হয় কল-রেডী। বিশ্বনাথ ঘোষ জানান, ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কল-রেডীর দোকানটি পুড়িয়ে দেয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবার নতুন করে ব্যবসা শুরু করেন বিশ্বনাথ ঘোষের বাবা ও চাচা।
কল-রেডীর গোড়াপত্তনকারী দয়াল ঘোষের ইচ্ছা ছিল ৭ মার্চের মাইক্রোফোনসহ হর্নগুলো বঙ্গবন্ধুকে উপহার দেবেন। কিন্তু সেই ইচ্ছা পূরণ হওয়ার আগেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। সেই রাতেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মাইক সেট করার কাজে ব্যস্ত ছিলেন দয়াল ঘোষ। পরদিন বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার কথা ছিল। সেই উপলক্ষে রাতভর কাজ করছিলেন তিনি।
বঙ্গবন্ধুর বায়োপিকে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ভাষণে ব্যবহৃত সরঞ্জামের ব্যবহার হয়েছে। ছবিতে কল-রেডীর এক কর্ণধার বিশ্বনাথ ঘোষ।
৭ মার্চ ভাষণের স্মৃতিচিহ্নগুলো দয়াল ঘোষ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আগলে রেখেছেন। একইভাবে আগলে রাখছেন তার সন্তানরাও। বিশ্বনাথ ঘোষ বলেন, ‘আমরা যত্ন করে ডিভাইসগুলো সংরক্ষণ করেছি। কিন্তু এমন একটি ঐতিহাসিক বিষয় রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষণ করা হলে পরবর্তী প্রজন্ম ইতিহাস ও ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে পারবে। আমরা আমাদের জীবনে এই স্মৃতিগুলো বুক আগলে রাখব।
‘কিন্তু আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কী করবে জানি না, তারা বাপ-চাচার ব্যবসায় নাও আসতে পারে। হয়তো অন্য পথে হাঁটবে। তাই আমরা চাই, এই স্মৃতিগুলো সংরক্ষণ করা হোক।’