দেশের বিভিন্ন এলাকায় সেতু নিয়ে নানান সংকটে আছে মানুষ। কোথাও প্রয়োজন থাকলেও সেতু করা হচ্ছে না, কোথাও সেতু বানানো হলেও তা বছর না পেরোতেই ভেঙে পড়ছে, কোথাও আবার সেতুর সঙ্গে করা হয়নি সংযোগ সেতু।
কোথাও কোথাও দেখা গেছে, স্থানীয়রা নিজেদের উদ্যোগে বাঁশ, কাঠ দিয়ে সাঁকো বানিয়ে চলাচল করছেন।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে দ্রুত সময়ের মধ্যে এসব সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেয়া হয়েছে। তবে কবে নাগাদ সমাধান হবে সে বিষয়ে নেই সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য।
১৪ গ্রামের মানুষের প্রয়োজন একটি সেতু
কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার উত্তর ইউনিয়নকে ঘিরে রেখেছে গোমতী ও কাঠালিয়া নদী। ইউনিয়নের ১৪ গ্রামের মানুষের সদর উপজেলায় যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম নৌকা।
চরাঞ্চলের প্রায় ৪০ হাজার মানুষকে যেকোনো প্রয়োজনে সদরে যেতে দুই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয় নৌকায়।
ব্রিজ না থাকায় সদরের সঙ্গে উত্তর ইউনিয়নের মানুষের যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম নৌকা। ছবি: নিউজবাংলাসাধারণত দুটি এলাকা দিয়ে স্থানীয়রা যাতায়াত করেন। একটি কেরোসিন ঘাট হয়ে গোলাপচর দিয়ে এবং আরেকটি বাতাইকান্দি হয়ে ভিটিকান্দি দিয়ে। ভিটিকান্দিতে শুরু হয়েছে সেতু নির্মাণ। তবে গোলাপচরেও সেতু প্রয়োজন বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
গোলাপচরের কৃষক আব্দুল মমিন। কৃষিপণ্য নিয়ে সদরে যেতে নানান ভোগান্তি পোহাতে হয় তার।
নিউজবাংলাকে মমিন বলেন, ‘যেহানো বিরিজের দরকার নাই হেয়ানো বিরিজ অয়। আমডার চরে একটা বিরিজ দরকার, হেইডা কেউ দেহে না।’
প্রতিদিন নৌকায় করে স্কুলে যেতে হয় এলাকার শিক্ষার্থীদের। এভাবে যাতায়াত কষ্টসাধ্য হওয়ায় অনেকেই পড়াশোনায় আগ্রহ দেখায় না। স্কুল থেকে ঝরে পড়ে শিশুরা।
স্কুলশিক্ষক আবদুল মতিন বলেন, এভাবে সারা বছর নৌকা ও ট্রলারে করে যাতায়াত বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।
গোলাপচরে সেতু হলে উত্তর ইউনিয়নের মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়বে বলে মনে করেন ভিটিকান্দি এলাকার বাসিন্দা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ বিভাগের কর্মকর্তা এমদাদুল হক।
দাউদকান্দি উপজেলা প্রকৌশলী আফছার উদ্দিন খন্দকার বলেন, ‘গোলাপচর এলাকায় সেতু নির্মাণ করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এখানে সেতু করার সম্ভাবনা আছে। সেতু হলে এই জনপদ অনেক এগিয়ে যাবে।’
২০ বছর আগের বাঁশের সাঁকো আর কতদিন
ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার কাশিমুর ইউনিয়নে বানার নদীর ওপর ২০ বছর আগে বাঁশ ও কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয় বাঁশের সাঁকো। প্রতি বছরই সংস্কার করতে হয় ৯০ ফুট দীর্ঘ এই সাঁকো।
স্থানীয়রা জানান, উপজেলা শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পাশে বানার নদী। এ নদী পার হয়ে যেতে হয় কাশিমপুর ইউনিয়নের কাশিমপুর, রসুলপুর, কননাডা ও পাহাড় পাবইজান গ্রামে।
২০ বছর ধরে এই সাঁকো দিয়ে যাতায়াত করছে কাশিমুর ইউনিয়নের চার গ্রামের মানুষ। ছবি: নিউজবাংলাবানারপাড় এলাকায় বানার নদীতে একটি কংক্রিটের সেতু থাকলেও সেটি এই গ্রামগুলো থেকে বেশ দূরে। তাই সেতু থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে স্থানীয়রা নিজেদের উদ্যোগে বাঁশ, কাঠ দিয়ে সাঁকো বানিয়ে নিয়েছেন। ৩০ হাজার মানুষ ব্যবহার করছেন এই সেতু।
রসুলপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল হাই নিউজবাংলাকে জানান, তাদের গ্রামের অধিকাংশ মানুষ কৃষক। তাদের উৎপাদিত ফসল নিয়মিত বাজারে নিয়ে যেতে হয়। বাঁশের সাঁকো দিয়ে ফসল নিয়ে যাওয়া সম্ভব না হওয়ায় ৩ কিলোমিটার ঘুরে কংক্রিটের সেতু দিয়ে যেতে হয়।
কননাডা গ্রামের যুবক শামীম আহম্মেদের অভিযোগ, ‘নির্বাচন এলে প্রার্থীরা প্রতিবার সেতু নির্মাণের আশ্বাস দেন। এরপর ক্ষমতায় এলে তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না। বর্ষায় যখন নদীতে পানি অনেক বেড়ে যায়, তখন সেতু নড়বড়ে হয়ে যায়। নিজেদের টাকাতেই সংস্কার করতে হয় এই সেতু।
‘মাঝেমধ্যেই সাইকেল ও মোটরসাইকেল সাঁকো থেকে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটে। ছোট বাচ্চাদের জন্য এভাবে যাতায়াত করা খুব ঝুঁকিপূর্ণ।’
ষাটোর্ধ্ব সামাদ আলী বলেন, ‘সরকার এত উন্নয়ন করতাছে কিন্তু আমগোর উন্নয়ন নাই। একটা সেতু কইরা দিলে সবাই নিশ্চিতে যাতায়াত করতে পারত। জীবনমানের উন্নয়ন হইত। পোড়া কপাল আমগোর। মরার আগে একটা সেতুর দাবি জানাই আমি।’
কাশিমপুরের চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন তালুকদার বলেন, ‘আমি জনপ্রতিনিধি হিসেবে জনদুর্ভোগের কথা তুলে ধরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) জানিয়েছি। তিনি সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরে জানালে টেন্ডারের মাধ্যমে সেতু নির্মাণ হতে পারে। এ ছাড়া আমাদের উপজেলা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত সেতু নির্মাণ বাস্তবায়ন করা হবে।’
এ বিষয়ে ইউএনও আব্দুল্লাহ আল মনসুর জানান, বানার নদীতে সেতু নির্মাণের জন্য অনেক অর্থ প্রয়োজন। বাঁশের সেতুটি সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়া হবে। সেতু নির্মাণ জরুরি হলে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরে জানানো হবে।
২৬ বছরেও সংযোগ সড়ক পায়নি সেতুটি
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের উধুর ও ছিকোলিয়া গ্রামের মাঝে উধুর খালে প্রায় ২৬ বছর আগে তৈরি করা হয় একটি সেতু। এত বছর ধরে সেতুটি অব্যবহৃত পড়ে আছে। কারণ সেতুর সঙ্গে নেই সংযোগ সড়ক।
তাই সেতুর নিচে বাঁশের সাঁকো বানিয়ে নিয়ে চলাচল করছেন স্থানীয়রা।
একসময় গাজীপুরের পুবাইল ইউনিয়নের আওতাধীন ছিল এই দুই গ্রাম। গ্রামের লোকসংখ্যা প্রায় ২ হাজার। স্থানীয়দের অভিযোগ, ২০১৩ সালে গ্রাম দুটি সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত হলেও বাড়েনি সুযোগ-সুবিধা।
স্থানীয়রা জানান, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তৎকালীন সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টারের নির্দেশে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি) উধুর খালের ওপর একটি পাকা সেতু নির্মাণ করে দেয়।
৩ লাখ টাকা ব্যয়ে সেতু নির্মাণ করা হলেও দুই পাশে করা হয়নি পাকা রাস্তা। পরে ইট বিছিয়ে রাস্তা করা হলেও তা অনেক নিচে হওয়ায় সংযুক্ত হতে পারেনি সেতুটি।
উধুর গ্রামের ষাটোর্ধ্ব নিপেন্দ্র চন্দ্র দাস বলেন, ‘সিটি করপোরেশন হওয়ার পর থেকে ট্যাক্স বেড়েছে কিন্তু কোনো সুফল পাইনি। প্রতি বছরই সেতুর সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেয়া হয় কিন্তু আশ্বাসে দীর্ঘশ্বাসই বেড়েছে।’
প্রভাত চন্দ্র দাস বলেন, ‘গ্রামের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে সেতুর অভাবে দ্রুত হাসপাতালে নেয়া যায় না। বিশেষ করে গর্ভবতী নারী ও স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চারা ঝুকি নিয়ে সাঁকো পার হয়। বর্ষার সময় খুব অসুবিধা হয়।’
‘সেতুর নিচের সাঁকো দিয়ে স্থানীয় এমপি, মেয়রসহ অনেক নেতারা আসা-যাওয়া করেছেন। কেউই রাস্তার উদ্যোগ নেননি। সদ্য বরখাস্ত মেয়র জাহাঙ্গীর আলমও বেশ কয়েকবার সেতুটি পরিদর্শন করেছেন। তবুও আমরা রাস্তা পাইনি’, বলেন আনন্দ দাশ।
সেতুতে সংযোগ সড়ক না থাকায় উধুর গ্রামের মানুষকে গাড়ি নিয়ে ঘুরে যেতে হয় এশিয়া হাইওয়ে দিয়ে এবং ছিকোলিয়া গ্রামের মানুষকে যেতে হয় পুবাইল স্টেশন হয়ে। এতে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট বেশি সময় লাগে।
সিটি করপোরেশনের ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোমেন মিয়া বলেন, ‘একেবারে অহেতুকভাবে সরকারের টাকা অপচয় করে সেতুটি করা হয়েছিল। আমরা এখানে ইট বিছানো রাস্তার পরিবর্তে পাকা সড়ক করে দিয়েছি কিন্তু নতুন করে সেতু এখনও হয়নি। এ বিষয়ে একাধিকবার মৌখিক ও লিখিত আবেদন দেয়া হয়েছে।’
খুব অল্প সময়ের মধ্যে গ্রাম দুটি যুক্ত করার জন্য সেতু নির্মাণের ব্যবস্থা করা হবে বলে নিউজবাংলাকে আশ্বাস দিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত সিটি মেয়র আসাদুর রহমান কিরণ।